‘করোনা সংকটকালে তথ্যপ্রযুক্তি এগিয়েছে ১০ বছর’

আরিফ নিজামীবলা হচ্ছে করোনা সংকট পৃথিবীকে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনে আরও ১০ বছর এগিয়ে দিয়েছে। যে বিষয়গুলো ছিল দূর-ভবিষ্যতের, এখন তা বর্তমান। এর আগে কখনও এত মানুষ অনলাইনে সক্রিয় ছিল না। দেশের মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ও মোট ব্যান্ডউইথের ব্যবহার এখন সর্বোচ্চ। এপ্রিল মাসে গড়ে দেশে ব্যান্ডউইথ ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৫০ জিবিপিএস (গিগাবিটস পার সেকেন্ড), যা স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ বেশি। সাবমেরিন ক্যাবল ও ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল থাকায় আইএসপি বা টেলকো অপারেটরগুলোর ব্যান্ডউইথ পেতে সমস্যা না হলেও গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থায় আছে দুর্বলতা। গ্রাহকদের অভিযোগ নিয়মিতই আছে এসব নিয়ে। এককথায় বলা যায়, করোনা সংকটকালে তথ্যপ্রযুক্তি এগিয়েছে ১০ বছর। কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

১. মোবাইল নেটওয়ার্কে চাপ: আমাদের এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ‘কানেক্টেড’ থাকার মূল মাধ্যমই হলো মোবাইল নেটওয়ার্ক। মোবাইল ইন্টারনেট সেবার মান ঠিক রাখার অন্যতম ফ্যাক্টর হচ্ছে কে কতটুকু তরঙ্গ ব্যবহার করে সেবা দিচ্ছে। এই সময়ে কম তরঙ্গ ব্যবহার করে এত বেশি ব্যান্ডউইথের সেবা দিতে গিয়ে ভোগান্তি হওয়ারই কথা। লকডাউনের কারণে রিচার্জের দোকান বন্ধ থাকায় ভোগান্তিও আছে। তথ্যমতে, শুধু গ্রামীণফোনেরই প্রায় ১ কোটি নিয়মিত গ্রাহক এপ্রিল মাসে কোনও রিচার্জ করেননি। এর অন্যতম কারণ হতে পারে অর্থের স্বল্পতা বা রিচার্জ করার মাধ্যম খুঁজে না পাওয়া।

২. অনলাইন ক্লাসরুম: অনেক দিন থেকে ডিজিটাল শিক্ষা, ই-শিক্ষা নিয়ে কাজ চলে এলেও আমাদের শিক্ষকরা কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যে টেকনিক্যালি পিছিয়ে আছে তা দেখা যাচ্ছে বেশ। শুধু কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অনলাইনে পড়ালেখা চালু করতে পারলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি স্কুল-কলেজ আছে পিছিয়ে। জুম অ্যাপনির্ভর এই ই-লার্নিংয়ে শিক্ষার্থীরা কতটুকু মানিয়ে নিচ্ছে তা বোঝা যাবে খুব শিগগিরই। অনেক দেশে সরকারের পক্ষ থেকে স্কুল পড়ুয়াদের আইপ্যাড বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে, যা বাসায় পৌঁছে দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ডিভাইস ও কানেক্টিভিটি না থাকলে ই-লার্নিং এগুবে না। সংসদ টিভিকে লার্নিং প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করার উদ্যোগটা অসাধারণ।

৩. গ্রোসারি: দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে অনলাইনে গ্রোসারি (চাল, ডাল, তেল, লবণ আইটেম ইত্যাদি) ক্রেতার সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। বেশিরভাগ ই-কমার্স খুব দ্রুত গ্রোসারি চালু করেছে। পণ্য পেতে অনেক দেরি হওয়ার অভিজ্ঞতাও হচ্ছে গ্রাহকদের। পণ্য পেতে লেনদেনটা এখনও বেশি হচ্ছে ক্যাশ অন্য ডেলিভারিতে (সিওডি)।

৪. স্বাস্থ্য ব্যবস্থা: টেলিমেডিসিনে আগ্রহ না থাকলেও এখন উপায় না পেয়ে গ্রাহক ছুটছে অ্যাপের দিকে। কল করলেই মিলছে স্বাস্থ্যসেবা। ভিডিওতে ডাক্তার দেখছেন রোগী। অনলাইন প্রেসক্রিপশনে বাসায় মিলছে ওষুধের ‘হোম ডেলিভারি’।

৫. গ্রাহক সেবা: লকডাউন বা ছুটি শুরুর পরপরই অনেক কল সেন্টার বন্ধ বা জনবল প্রায় নেই হয়ে গিয়েছিল। তা এখন আবার কিছুটা ঠিকঠাক হচ্ছে। এখনও অনেক করপোরেট কলসেন্টার বন্ধ আছে। এআই বা চ্যাটবটের সেবাগুলো সবাই ‘অ্যাডাপ্ট’ না করায় শুধু এজেন্টনির্ভর সেবাগুলো সবচেয়ে বেশি ভুগেছে।

৬. দেশীয় আইটি ব্যবসা: অনেক আইটি প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে স্টার্টআপগুলো অর্থাভাবে ভুগছে। ক্যাশ ফ্লো বা ক্রেডিট স্কোর ঠিকঠাক মেইটেইন না করার ঝামেলায় সরকারি প্রণোদনা ঋণ মিলবে কিনা তা নিয়েও অনেকে সন্দিহান। অনেক কোম্পানি জনবল ছাঁটাই করেছে, ছেড়ে দিয়েছে অফিস স্পেস।

৭. পিছিয়ে আছেন টেক জায়ান্টরা: এত মানুষের চাপ সামলানো যে আসলেই কঠিন তা বোঝা যাচ্ছে ফেসবুকে নতুন নতুন পাওয়া নানা বাগের কারণে। গুগল, ফেসবুক দুই জায়ান্টই এতদিন জুমের মতো কোনও সহজ ভিডিও চ্যাটিং সার্ভিস চালু না করায় আক্ষেপ করছে। তবে দ্রুত লঞ্চ করেছে একই ধরনের সার্ভিস।

আশার কথা, দেশ বিদেশের টেক প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুতই নতুন নতুন স্ট্র্যাটেজি ও সেবা দেওয়া শুরু করতে পিছ পা হচ্ছে না। পাঠাও, সহজ’র মতো সব কোম্পানি কিছু না কিছু করার চেষ্টা করছে।

লেখক: তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা, প্রেনিউর ল্যাব লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ফেসবুক ডেভেলপার সার্কেল ঢাকার লিড।