করোনাকালে বদলে গেছে প্রশিক্ষণও, নির্ভরতা অনলাইনে

এটুআই আয়োজিত ফ্রি অনলাইন ক্লাস
করোনার এই সময়ে দীর্ঘদিন ধরে বাইরে বের হওয়া এক কথায় বলা যায় বন্ধ। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই তাদের কর্মীদের জন্য চালু করেছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম কার্যক্রম। এর ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানের চলমান প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও বন্ধের উপক্রম হয়। কিন্তু প্রযুক্তিগত সুবিধা থাকায় শুরু হয় অনলাইনে প্রশিক্ষণ পর্ব। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, অধিদফতর তাদের প্রশিক্ষণ কাজ চালিয়ে গেছে অনলাইনে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো করোনাকালে তাদের কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবেও এ সময়ে বিভিন্ন কোর্সের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। এমনকি প্রযুক্তি পণ্যের একটি ব্যবসায়িক সংগঠন তাদের সদস্যদেরও এই সময়ে নতুন প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

অনলাইন প্রশিক্ষণে বর্তমানে কাজে লেগেছে জুম, গুগলের মিট, মাইক্রোসফটের টিমস, স্কাইপ, হ্যাংআউটস ইত্যাদি সফটওয়্যার। তবে করপোরেট পর্যায়ে অনলাইন প্রশিক্ষণে সিসকোর ওয়েবেক্স সফটওয়্যারটি বেশি ব্যবহার হচ্ছে বলে জানা গেছে। এসব প্রশিক্ষণের মধ্যে রয়েছে, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ। নতুন প্রযুক্তি যেমন ব্লক চেইন, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), প্রযুক্তিতে নেতৃত্বের গুণাবলি ইত্যাদি বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল মার্কেটিং, ভাষা শিক্ষার মতো বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে অনলাইনে।

এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষক ড. রোকনুজ্জামান বলেন, ‘কোভিড-১৯ কাজের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করলেও শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মতো বিষয় লাইভে এনেছে। মনে হচ্ছে, এই বিচ্ছিন্নতা কিছু শিল্পে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্দিষ্টভাবে বলা যায়, বিশেষ করে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ খাত বেশি ভারনারেবল বলে মনে হচ্ছে। এজন্য এই দুই মাধ্যম চলে এসেছে অনলাইনে। আর অনলাইন চ্যানেলগুলোই (অনলাইন প্রশিক্ষণ) দিনে দিনে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।’

ড. রোকনুজ্জামান মনে করেন, প্রযুক্তি দিন দিন অগ্রসর হচ্ছে। পক্ষান্তরে শিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থীরা এই মাধ্যমের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। করপোরেট বা পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণও অনলাইন মাধ্যমে এসে গেছে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই একটা চাপ থাকবে। আর এসব অনলাইনে একটা সংস্কৃতি তৈরি করবে।

অনলাইন প্রশিক্ষণ চালু করেছে সরকারের আইসিটি বিভাগ। স্টার্টআপ ও তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে ডিজিটাল মার্কেটিং-বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করে আইসিটি বিভাগের বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ প্রকল্প (আইডিয়া)। প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে চার দিনের এই প্রশিক্ষণটির সহ-আয়োজক হিসেবে রয়েছে কোডার্স ট্রাস্ট বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটির একটি টিম অনলাইনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে। স্টার্টআপ বাংলাদেশ-আইডিয়া প্রকল্পসহ ওমেন এন্ট্রাপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, নিবেদিতা, স্টার্টআপ ঢাকা ও স্টার্টআপ চট্টগ্রাম থেকে ৮০ জনের বেশি প্রশিক্ষণার্থী এতে অংশ নেন। আইসিটি বিভাগের অধীন এটুআইও (একসেস টু ইনফরমেশন) অনলাইনের মাধ্যমে একাধিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে বলে জানা গেছে।

সদস্যদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে করোনাকালে অনলাইনে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস)। গত মে মাস থেকে বিসিএস সদস্যদের দক্ষতা বাড়াতে স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। ‘ইন্ট্রোডাকশন টু ব্লকচেইন’ শীর্ষক একটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ কর্মসূচি শুরু হয়, যা এখনও চলছে।

বিসিএস সভাপতি মো. শাহিদ-উল-মুনীর বলেন, ‘করোনার এই সময়কে কাজে লাগিয়ে আমরা অনলাইনে প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করেছি। প্রযুক্তির হালনাগাদ বিষয়গুলো সাধারণ জীবনকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে। আশা করছি, সংকটের এই সময়ে অনলাইনে আমরা নিয়মিতভাবে এই ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবো।’

তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এরিনা এক্সেলেন্স’র প্রধান নির্বাহী ফজলে রাব্বী বলেন, ‘আমাদের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের কিছু প্রশিক্ষণ এখন লাইভে চলছে।’  তিনি বলেন, ‘কর্মীদের প্রশিক্ষণের দরকার আছে। আমি মনে করি, আগামীতে সব প্রশিক্ষণ অলাইনেই হবে। এই প্র্যাক্টিস অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। তবে করোনার কারণে এটা আরও  দ্রুতগামী হয়েছে। তবে এ সময়ে অনলাইনে যারা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, আর যারা নিচ্ছে—তাদের কোয়ালিটিটা চেক করে নিতে হবে। কিছু প্রশিক্ষণ হয়তো খারাপ হবে, আবার কিছু ভালো হবে। কিন্তু এভাবেই কাজটি এগিয়ে যাবে। বিষয়টিকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখছি।’

অনলাইনে জাপানি ভাষা শেখাচ্ছে ড্যাফোডিল পরিবার। তাদের সঙ্গে রয়েছে জাপানের জে-ইলার্নিং। বাংলাদেশে ‘জে-ইলার্নিং’ নামে জাপানি ভাষা শেখার একটি কার্যকরী অ্যাপ্লিকেশন (মোবাইল ও ডেস্কটপ) চালু হয়েছে।

ড্যাফোডিল পরিবারের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ নূরুজ্জামান বলেন, ‘জে-ইলার্নিং আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় উপযোগী একটি অ্যাপ্লিকেশন।’ তিনি আরও বলেন, ‘জে-ইলার্নিং অ্যাপস শিক্ষার্থীদের ভাষা শিখতে সহায়তা করবে। এই অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে আগ্রহীরা ঘরে বসে অল্প খরচে জাপানি ভাষায় এন-৩ লেভেল পর্যন্ত কমপ্লিট করতে পারবেন।’

তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রেনিউর ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা আরিফ নিজামি বলেন, ‘‘প্রশিক্ষণ দক্ষতা উন্নয়নের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ ছাড়াও লিডারশিপ, কমিউনিকেশনসহ নানা ‘সফট স্কিল’ উন্নয়ন করতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য কাজে লাগবে এমন বিষয় শিখতে হবে। তবে প্রশিক্ষক কে এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভুলভাল শিখলে লাভ থেকে ক্ষতি বেশি হবে। আর কিছু কিছু বিষয় শিখতে ভালোমানের পিসি বা গ্রাফিকস কার্ড লাগার কথা। সেগুলা বাসায় বসে করা সম্ভব নাও হতে পারে,  ভালো হার্ডওয়্যার না থাকলে। গুগল, ফেসবুকও অনেক কোর্স ফ্রি দিচ্ছে। কোরসেরা, এডেক্সসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কোর্স ফ্রি করে দিয়েছে। সেগুলো কাজে লাগানো যেতে পারে।’