নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বায়তুস সালাত জামে মসজিদে একসঙ্গে ছয়টি এসির বিস্ফোরণের পর আবারও সামনে এলো কী কী কারণে এসির বিস্ফোরণ হয় বা আদৌ এসি বিস্ফোরিত হয় কিনা। এসি ব্যবহারকারীরা কী ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলে এ দুর্ঘটনা এড়াতে পারবেন, কতদিন পরে এসি সার্ভিসিং করানো উচিত।
অন্যদিকে জনসমাগম হয় এমন স্থানে এবং ধর্মীয় উপাসনার জায়গাগুলোতে (মসজিদ, মন্দির, গির্জা, কমিউনিটি সেন্টার ইত্যাদি) এসি ব্যবহারের আগে কিছু নিয়ম মানলে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে মসজিদে এসি বিস্ফোরণের মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। এটা নিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। সাধারণ মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। আমাদের বাসা-বাড়িতে, পাড়ার মসজিদে, কমিউনিটি সেন্টারে যে এসির ব্যবহার হয় এবং সেখানে হরহামেশাই আমাদের যাতায়াত থাকে, তাতে করে আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি কয়েকটি কথা বলতে চাই। এই ঘটনা থেকে আমাদের সাধারণ কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয় আছে। এসি যেহেতু প্রধানত একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র, তাই বাসায় এসি ইনস্টল করার সময় এটাতে উপযুক্ত সাইজের ক্যাবল (তার) ব্যবহার করতে হবে। এখন উপযুক্ত সাইজটা নিয়ে অনেক কথা রয়েছে। একজন বৈদ্যুতিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি বলতে চাই, বাসায় সাধারণত এক টন, দেড় টন, দুই বা আড়াই টনের এসি ব্যবহার করা হয়। প্রথম দুটির ক্ষেত্রে আমরা যেন অবশ্যই ৪ মিলিমিটারের (যেটাকে ফোর আরএম বলে) ক্যাবল ব্যবহার করি। এর চেয়ে সরু মানের তার যেন আমরা ব্যবহার না করি। এরচেয়ে আরেকটু বড় সাইজের এসি হলে ৬ আরএম-এর ক্যাবল যেন ব্যবহার করি।’
বুয়েটের এই সহযোগী অধ্যাপক আরও বলেন, ‘এসি নিয়ে একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। এতে করে গণভাবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কতগুলো বিষয় ক্লিয়ার হওয়া দরকার। খবরে এসেছে যে নারায়ণগঞ্জের মসজিদে একসঙ্গে ছয়টি এসির বিস্ফোরণ হয়েছে। ইলেক্ট্রিক্যাল ভিউ পয়েন্ট থেকে বৈদ্যুতিকভাবে একসঙ্গে এটা ঘটার কোনও কথা না। সব এসি একসঙ্গে ব্লাস্ট করবে (বৈদ্যুতিক সূত্র থেকে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে যেমন শর্ট সার্কিট হতে পারে, ওভার হিটিং হয়ে সেখানে আগুন লেগে যেতে পারে) না। একটা দুটো জায়গা থেকে প্রথমে ধরে সেখান থেকে সূত্রপাত হতে পারে। কিন্তু একসঙ্গে সব ব্লাস্ট হয়ে যাওয়ার কথা না। লক্ষণ দেখে বোঝা যাচ্ছে, সাধারণ ইলেক্ট্রিক্যাল কারণ থেকে একসঙ্গে এরকম হয়ে যাওয়ার কথা নয়। অন্য কোনও সোর্স থেকে সেখানে গ্যাস বা এমন কিছু একটা জমা হয়ে থাকতে পারে যেটা সামান্য স্ফুলিঙ্গে বা হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গিয়ে আবার চলে এসে ওখানে এসিগুলো একসঙ্গে সুইচিং হয়ে যায়। এসব জায়গা থেকে স্পার্কিং হয়ে ওখানে আগুন লেগে যেতে পারে। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে ওই এনভায়রনমেন্টে কিছু একটা ছিল যেটা অগ্নিকাণ্ডের উৎস। গ্যাসীয় কোনও উৎস। কিন্তু সেটা বৈদ্যুতিক উৎস না।’
তিনি জানান, ‘আরেকটা বিষয় হতে পারে, এসিতে যে গ্যাস ব্যবহার হয় সেটাই একটা সোর্স হিসেবে কাজ করতে পারে কিনা। এসিতে ক্লোরো ফ্লোরো বা ফ্রেয়ন গ্যাস ব্যবহার করা হয়। এটার যে বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত করা হয় তা হলো, ননফ্লেমেবল বা সহসা এটায় আগুন ধরে না। এটা লিক করলে খুব একটা গন্ধ পাওয়া যায় না। এটা বাতাসের চেয়ে চারগুণের মতো ভারী। প্রথমে লিক হলে ভারী হওয়ায় এটা মাটিতে চলে আসে। আবার তাপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা চলেও যায়, বাতাসে জমে থাকে না। সেগুলো ইমফ্লেমেবল না হলে আগুন লাগে না। তবে হ্যাঁ, এ ধরনের গ্যাসেও আগুন লেগে যেতে পারে অতি উচ্চ তাপমাত্রায়। কোনও কারণে আগুন লেগে যদি তাপমাত্রা ৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে যায়, তারপরে এসিতে যে গ্যাস থাকে সেই গ্যাস থেকেও আগুন লাগতে পারে। কিন্তু এই ৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আগুন তুলবে কে। সেজন্য অন্য গ্যাসের উপস্থিতি সেখানে থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এজন্য সোশ্যাল গ্যাদারিংয়ের জায়গায় এগুলো (এসি) চালানোর আগে দরজা জানালা খুলে রেখে বা ফ্যান চালিয়ে আলো বাতাস চলাচলের মতো ব্যবস্থা করে তারপরে জানালাগুলো আটকে এগুলো চালু করে দেওয়া উচিত। এটা নিয়মিতভাবে করা উচিত। গ্যাসের উপস্থিতি মাপার জন্য সেন্সর আছে। কমার্শিয়ালি হলে তো অবশ্যই বসাতে হবে। যেসব জায়গায় অনেক মানুষ জড়ো হয় সেখানে এটা বসিয়ে তারপর এটা থেকে ওখানে গ্যাসের অস্তিত্ব আছে কিনা সেটা দেখতে হবে।’
ইয়াসির আরাফাত বলেন, মসজিদ, মন্দির বা অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন তারা যদি এটার ব্যবস্থা আগে থেকে করে রাখেন তাহলে আমরা আগের মতো নির্ভয়ে সেখানে যেতে পারবো। কেননা, এসির গ্যাসে নিজের থেকে আগুন লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম। অন্য কোনোভাবে অতি উচ্চ তাপমাত্রা তৈরি না হলে ওই গ্যাসে আগুন জ্বলে না। আর একসঙ্গে সব এসিতে বৈদ্যুতিক কারণ থেকেও আগুন লাগে না। তবে বৈদ্যুতিক কারণ থেকে দুর্ঘটনা ঘটলে কোনও কোনও একক এসি ব্লাস্ট করত পারে।
সন্দীপ বিশ্বাস আরও বলেন, ‘এসি বিস্ফোরণের বিষয়ে আমরা কয়েকটি কেস স্টাডি পর্যালোচনা করে দেখেছি, এসির ভেতরে বিস্ফোরণ হওয়ার মতো তেমন কিছু নেই। শর্ট সার্কিট থেকে বা অন্যকোনও বিস্ফোরণে (অন্য কোনও গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার কারণেও হতে পারে) এসিতে আগুন ধরে যেতে পারে বা বিস্ফোরণ হতে পারে। এসির ভেতরে কোনও কারণে যদি ফায়ারিং হয় তাহলে কম্প্রেসারের তেলটা কালো হয়ে যেতে পারে। প্রথম দেখা মনে হতে পারে তেলটা পুড়ে গেছে।’
এসি দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে সন্দীপ বিশ্বাস কয়েকটি উপায়ের কথা বলেছেন। এর মধ্যে রয়েছে কন্ডেন্সারে প্রচুর ধুলোবালি জমলে ভেতরে প্রচুর চাপ সৃষ্টি হতে পারে। তাই নিয়মিতভাবে ধুলোবালি পরিষ্কার করা। কপার পাইপে যদি কোনও ব্লক থাকে তাহলে প্রেশার তৈরি হতে পারে। এসির ক্যাবল (তার) রেটিং অনুযায়ী লাগাতে হবে। এক টনের এসিতে এক টনি ক্যাবল, দেড় টনি এসিতে দেড় টনি ক্যাবল ব্যবহার করতে হবে। সুইচ বোর্ড ভালো হতে হবে। তা নাহলে হাই কারেন্ট ফ্লো হলে সেখান থেকে ‘ফায়ার’ হতে পারে। ক্যাবল সঠিক না হলে স্পার্ক হতে পারে। এছাড়া তিনি নিয়মিত এসি সার্ভিসিংয়ের বিষয়ে পরামর্শ দেন।