এলোমেলো আইআইজি খাত: বকেয়া পরিশোধ না করায় ‘ব্লক’ হচ্ছে ব্যান্ডউইথ

২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর আইআইজিগুলোর ব্যবহৃত ব্যান্ডউইথের একটা অংশ ব্লক করে দেয় সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড। পরে বকেয়া পরিশোধ করে আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) প্রতিষ্ঠানগুলোগুলো স্বাভাবিক সেবায় ফেরে।

সোমবার (১৫ জানুয়ারি) রাজস্ব ভাগাভাগির (রেভিনিউ শেয়ারিং) ২২ কোটি টাকা বকেয়া থাকায় আইআইজি প্রতিষ্ঠান আমরা টেকনোলজিসের ৮০ শতাংশ ব্যান্ডউইথ ব্লক (ক্যাপিং) করেছে বিটিআরসি। ফলে অপারেটরটির সেবাদানে বিঘ্ন ঘটেছে। শিগগিরই আরও দুটি আইআইজির ব্যান্ডউইথ ব্লক করতে যাচ্ছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের বকেয়া অর্থ পরিশোধ না করায় এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বিটিআরসি।

এই দুই ঘটনায় আবারও হঠাৎ এলোমেলো দেশের আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) খাত। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে রাজধানীর (মহাখালীর) আইটি হাব বলে পরিচিত খাজা টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় আইআইজিগুলো ও কয়েকটি আইএসপি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে গত ২৪ নভেম্বর বকেয়া অর্থ পরিশোধ না করায় সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড আইআইজিগুলোর ব্যান্ডউইথ ক্যাপিং করে। ফলে সে সময় এই খাত এলোমেলো হয়ে পড়ে। সেই এলোমেলো খাত এখনও গুছিয়ে উঠতে পারেনি।

প্রসঙ্গত, দেশে আইআইজি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৪টি। আর আইটিসি (ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল) প্রতিষ্ঠান আছে ৬টি। আইটিসিগুলো ভারত থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানি করে। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আয়ের ১০ শতাংশ বিটিআরসির সঙ্গে রাজস্ব ভাগাভাগি (রেভিনিউ শেয়ারিং) করে থাকে। নিয়ম হলো ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো (আইএসপি) কোনও আইএসপি থেকে ব্যান্ডউইথ কিনতে পারবে না। তাদের ব্যান্ডউইথ কিনতে হবে আইআইজি থেকে।  

আমরা টেকনোলজিসের ব্যান্ডউইথ ব্লকের (ক্যাপিং) বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিআরসির কমিশনার অধ্যাপক ড. মুশফিক মান্নান চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রত্যেকটা টেলিকম অপারেটরকে বিটিআরসির বকেয়া ও রাজস্ব ভাগাভাগির টাকা পরিশোধ করতেই হবে। আইআইজিগুলো এর বাইরে নয়। আইআইজিগুলোর রেভিনিউ শেয়ারিংয়ে অনেক টাকা বকেয়া রয়েছে।’

জানা গেছে, আরও দুটি প্রতিষ্ঠান ক্যাপিংয়ের আওতায় পড়তে যাচ্ছে। শিগগিরই প্রতিষ্ঠান দুটির বিষয়ে নির্দেশনা জারি হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইআইজি প্রতিষ্ঠান দুটো হলো ম্যাঙ্গো টেলিসার্ভিসেস ও আইটেল। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির কাছে প্রতিষ্ঠান দুটোর রাজস্ব ভাগাভাগির বিশাল অংকের টাকা বকেয়া রয়েছে। বার বার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও বকেয়া পরিশোধ না করায় বিটিআরসি এই উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

দেশের আইআইজি ফোরামের মহাসচিব আহমেদ জুনায়েদ জানিয়েছেন, দুটি আইআইজি প্রতিষ্ঠান দেশে ব্যবহৃত ব্যান্ডউইথের (৫ হাজার ৪০০ জিবিপিএস) এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে। অবশিষ্ট ব্যান্ডউইথ বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে করে। বাকিগুলোর মধ্যে দুই-একটির অবস্থা একটু ভালো। ফলে এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় দেশে ব্যান্ডউইথ খাতের প্রকৃত অবস্থা কী। তিনি বলেন, অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যে দুই-তৃতীয়াংশ ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করার কথা সেটার হিসাব পুরোপুরি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি বিদ্যমান।   

দেশের ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির সভাপতি এমদাদুল হক বলেন, রাজধানীর মহাখালীর খাজা টাওয়ারে (আইটি হাব বলে পরিচিত) আগুন লাগায় অনেক আইআইজি ও আইএসপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই ক্ষতি থেকে হাতে গোনা কয়েকটি আইআইজি প্রতিষ্ঠান বের হতে পারলেও খাতটি এলোমেলো হয়ে পড়ে। যা থেকে এখনও এই খাত বের হয়ে আসতে পারেনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের আইআইজি খাত এলোমেলো হওয়ার পেছনে অন্তত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি তার বকেয়া আদায়ের জন্য হঠাৎ করে ২০টা আইআইজির ব্যান্ডউইথ বন্ধ করে দেয়। এই সিদ্ধান্ত খাতটিকে চাপে ফেলে দেয়। এই ঘটনার আগে ও পরে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি আইআইজিগুলোকে বকেয়া রেভিনিউ শেয়ারের অর্থ পরিশোধের জন্য চাপ দিতে থাকে। এই চাপ এখনও অব্যাহত আছে। খাজা টাওয়ারের আগুনের ঘটনায় (গত ২৬ অক্টোবর) আমরা টেকনোলজিস তার গ্রাহক– তিন বড় মোবাইল অপারেটরকে হারায়। ফলে অপারেটরটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাজা টাওয়ারের আগুনের ঘটনায় আমরা টেকিনোলজিস তার ৯০ শতাংশের বেশি গ্রাহক হারিয়েছে। এছাড়া ব্যান্ডউইথ ক্যাপিং হতে যাওয়া দুটি প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক থাকলেও রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের অর্থ বকেয়া পড়েছে। এবার প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে অ্যাকশান নিতে যাচ্ছে বিটিআরসি।

আইআইজি প্রতিষ্ঠান বিডিহাবের প্রধান নির্বাহী আমিনুল হাকিমের খাজা টাওয়ারে আগুন লাগার পরে জানিয়েছিলেন, ‘খাজা টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডে সব মিলিয়ে পাঁচশত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে আইআইজিগুলোর ক্ষতির পরিমাণ ৩০০-৩৫০ কোটি টাকার মতো। যেসব ডিভাইস পুড়ে গেছে বা পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে সেগুলো ঠিক করা যাবে না। অপর দিকে বাজারে বাজারে ডিভাইসের সরবরাহে ঘাটতি আছে।’ সেই ঘাটতি আর প্রতিষ্ঠানগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।