কেন শীতের প্রকোপ নেই ডিসেম্বরেও?

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ডিসেম্বরেও শীতের প্রকোপ নেই দেশে। বিগত কয়েক বছরের ডিসেম্বরেও রাজধানীর ঢাকার রাতের তাপমাত্রা থাকতো ১২ ডিগ্রির আশেপাশে। এখন তা ১৬ ডিগ্রির নিচে নামছেই না। কখনও কখনও থাকছে এরচেয়েও বেশি। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গত বছরের ডিসেম্বরে বেশ কয়েকটি জায়গায় শৈত্যপ্রবাহ হলেও এবার কেবল দেশের সর্ব উত্তরের অঞ্চল পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা নেমেছিল ৯ এর নিচে।

গত বছরের (২০২২ সালে) ২৪ ডিসেম্বর দেশের উত্তরের জেলায় নওগাঁ ও পঞ্চগড়ের ওপর দিয়ে বইছিল শৈত্যপ্রবাহ। সেদিন দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তেঁতুলিয়া ও বদলগাছিতে ছিল এই তাপমাত্রা। এছাড়া প্রায় আট অঞ্চলের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি ছিল। সৈয়দপুর ও দিনাজপুরে ১০ দশমিক ২, ঈশ্বরদীতে ১০ দশমিক ৩, বরিশালে ১০ দশমিক ৪, চুয়াডাঙ্গা, তাড়াশ ও রাজশাহীতে ১০ দশমিক ৫, মাদারিপুরে ১০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল।

এক বছর পর একই দিনে, অর্থাৎ এ বছর ২৪ ডিসেম্বর দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে তেঁতুলিয়ায় ১১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া দিনাজপুরে ১৩ দশমিক ১, বদলগাছিতে ১২ দশমিক ৫, রাজশাহীতে ১৩ দশমিক ২, সৈয়দপুরে ১৪ দশমিক ৩ এবং যশোরে ১৫ দশমিক ৬, ঈশ্বরদীতে ১৩ দশমিক ২, বরিশালে ১৪ দশমিক ৬, মাদারীপুরে ১৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস অনুযায়ী এই মাসে শীত তীব্র হওয়ার কথা। মাসের শেষে শৈত্যপ্রবাহের কথাই আমরা বলেছিলাম। কিন্তু বঙ্গোপসাগরসহ সারা দেশের  ঊর্ধ্ব আকাশে একটি বাতাসের ঘুর্ণন (সঞ্চারণশীল বাতাস) চলছে গরম বাতাস আর ঠান্ডা বাতাসের। এ র ফলে শীতের বাতাস নিচে নামতে পারছে না। ইতোমধ্যে কয়েক জেলায় বৃষ্টি হলেও আকাশ পরিষ্কার হয়নি। এর ফলে বাতাসে জ্বলীয় বাষ্পের পরিমাণও বেশি। এসব কারণে শীতের হিমেল বাতাস আমরা পাচ্ছি না। চলতি মাসে আর তাপমাত্রা খুব একটা কমার সম্ভাবনা নেই। দুই একটা এলাকায় ১০ ডিগ্রিতে নামলেও শৈত্যপ্রবাহ আর নাও হতে পারে।

এই মাসে শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনার কথা বলা হলেও তা আসেনি

ডিসেম্বরের আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, সামগ্রিকভাবে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। দিন ও রাতের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে পারে। তবে এ মাসে দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিক অপেক্ষা কিছুটা বেশি থাকতে পারে। মাসের শেষার্ধে দেশের কোথাও কোথাও একটি থেকে দুটি মৃদু (৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) অথবা মাঝারি (৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। দেশের নদী অববাহিকায় ভোররাত থেকে সকাল পর্যন্ত মাঝারি থেকে ঘন এবং অন্য এলাকায় হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে।

শীত না পড়ার বিষয়ে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ডিসেম্বর মাসেও শীতের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গ্লোবাল সার্কুলেশনের (বাতাসের সঞ্চালন) পরিবর্তন ঘটছে। এই সঞ্চালন বদলে গেছে। এসব কারণে যে মাসে শীত পড়ার কথা সে মাসে আমরা শীতের আমেজ পাচ্ছি না। আবার দেখা যাবে যখন শীত পড়ার কথা না, সেই সময়ে আমরা শীতের আমেজ পাচ্ছি।

গ্লোবাল সার্কুলেশন আসলে কী?

সুর্যটা এক সময় একেবারেই পৃথিবীর দক্ষিণে চলে যায়, আবার এক সময় একেবারে উত্তরে চলে আসে। সবচেয়ে দক্ষিণে থাকে জুন মাসের ২১/২২ তারিখ, আর সবচেয়ে উত্তরে থাকে ডিসেম্বর মাসের ২১/২২ তারিখ। এর অর্থ হচ্ছে সূর্য এখন সবচেয়ে দক্ষিণে অবস্থান করছে। যেখানে দক্ষিণ সেখানে এখন সূর্যের তাপটা সবচেয়ে বেশি পড়ছে। তাপ বেশি হওয়ার কারণে বাতাসটা গরম হয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। এদিকে উত্তর থেকে বাতাস দক্ষিণে নেমে আসছে৷

শহরাঞ্চলের বাইরে শীতের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে

আইনুন নিশাত জানান, বাংলাদেশের ওপরে যে বাতাস আছে তা আসে মূলত মঙ্গোলিয়া, চীন, তিব্বত থেকে হিমালয়ের ওপর দিয়ে আসছে। এটা উত্তরের ঠান্ডা বাতাস। এই  সময় বিভিন্ন কারণে নিম্নচাপ হয়। তাপমাত্রা যদি ২৬/২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে হয় তাহলে কোনও জায়গায় নিম্নচাপ হতে পারে। এখন বঙ্গোপসাগরে বাতাস আসছে দুদিক থেকে। উত্তর থেকে হিমেল বাতাস, আর দক্ষিণের গরম বাতাস। এই বাতাসের সংমিশ্রণের কারণেই নিম্নচাপের সৃষ্টি হবে এবং প্রচুর বৃষ্টি হবে। স্যাটেলাইটে এখন দেখলে দেখা যাবে বঙ্গোপসাগরের ওপরে বাতাস ঘুরছে। এর ফলে উত্তরের ঠান্ডা বাতাস ওপরেই থেকে যাচ্ছে।

খুব একটা কমবে না তাপমাত্রা

আবহাওয়া অধিদফতর রবিবার (২৪ ডিসেম্বর) জানায়, উপ-মহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও আশেপাশের এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে, যার বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে।

আগামী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারী থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে।

তাপমাত্রার বিষয়ে বলা হয়, সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে।

স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হতে পারে এবারের শীতকালে

সোমবারের পূর্বাভাস বলা হয়, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারী থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

এরপর দিন অর্থাৎ মঙ্গলবারের পূর্বাভাসে বলা হয়, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের নদী অববাহিকায় এবং উত্তরাঞ্চলে মাঝারী থেকে ঘন কুয়াশা এবং এছাড়া দেশের অন্যত্র হালকা থেকে মাঝারী ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে। সারাদেশে রাত ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।