X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিঋণ পৌঁছাচ্ছে না কৃষকের হাতে

গোলাম মওলা
২০ আগস্ট ২০১৭, ১০:২৪আপডেট : ২০ আগস্ট ২০১৭, ১৮:৩৯

কৃষি ঋণ বরগুনা সদর উপজেলার রোডপাড়া গ্রামের জয়নাল মিয়া কৃষি ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ডিস ব্যবসা লাগিয়েছেন। একইভাবে মাগুরার নিজনান্দুয়লী পশ্চিমপাড়ার আজগর আলী কৃষক পরিচয় দিয়ে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসায় লাগিয়েছেন। বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে এই তথ্য উঠে এসেছে। তবে এমন চিত্র কেবল এই দুইটিই নয়, সমগ্র দেশ জুড়েই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেও দেখা গেছে, কৃষকদের ঋণের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে অকৃষি কাজে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, ঋণ বিতরণে দালাল বা তৃতীয় পক্ষের দৌরাত্ম্যের কথা। এক্ষেত্রে কৃষকরা বলছেন, ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজসের কারণেই প্রকৃত কৃষকের কাছে কৃষিঋণ যাচ্ছে না। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালীরাই কৃষি ঋণ পাচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক অশোক কুমার দে কৃষি ঋণ বিতরণে দুর্নীতি হচ্ছে উল্লেখ করে বলেন, কৃষি ঋণে দুর্নীতির সঙ্গে ব্যাংকের ভেতরের কর্মকর্তারাও জড়িত। তিনি জানান, এরই মধ্যে এক ব্যাংকের ৯ কর্মকর্তাকে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সময় কৃষিঋণ সংক্রান্ত একটি ব্যাংকের দুর্নীতির বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার জন্য আমাকে বিশেষভাবে রংপুরে পাঠানো হয়েছিল। আমি অনিয়ম পাওয়ার পর তা শক্ত হাতে দমন করার পাশাপাশি ওই ব্যাংকের ৯ কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করেছি। তিনি বলেন, ব্যাংকের কর্মকর্তারা বাণিজ্যিক ঋণে কমিশন বা ঘুষ পেলেও কৃষিঋণে সে সুযোগ কম। এ কারণে কৃষিঋণ বিতরণে তাদের অনাগ্রহ দেখা যায়। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কৃষিঋণ কৃষি খাতে ব্যবহার না করে গ্রহীতা অন্য কাজে ব্যবহার করছেন। এর বাইরে কৃষিঋণের একটা অংশ বিভিন্ন প্রকল্প ও বৈদেশিক বাণিজ্যেও ব্যবহৃত হচ্ছে । ফলে এ ঋণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত কৃষকরা। এ ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্য ব্যাংকগুলোকে বিষয়টি তদারকি করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অকৃষি খাতে ঋণ বিতরণে নিরুৎসাহিত করতে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক অর্ডার-১৯৭৩ এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক অর্ডিন্যান্স-১৯৮৬ এর মধ্যে কার্যক্রম সীমিত রাখতে বিশেষায়িত এই দুটি ব্যাংকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রসঙ্গত, কৃষিঋণ থেকে প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি গত দুই বছর আগে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন থেকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই নির্দেশ অনুযায়ি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) কার্যক্রমের ওপর তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এনজিওগুলো থেকে যে কৃষিঋণ বিতরণ হচ্ছে, তার বেশিরভাগ অংশ কৃষি কাজে ব্যবহার না হয়ে অন্য খাতে ব্যয় হচ্ছে। এ কারণে এমআরএর পক্ষ থেকে এনজিওগুলোকে অধিক সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

আবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর (বিবিএস) তথ্যমতে, মাত্র ১১ শতাংশ কৃষক তাদের ঋণের অর্থ কৃষি কাজে ব্যবহার করছেন। গৃহস্থালি অন্যান্য প্রয়োজনে ঋণের অর্থ ব্যয় করছে প্রায় ৫৮ শতাংশ পরিবার। শুধু তাই নয়, বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৪১ লাখ পরিবার কৃষি ও পল্লি ঋণের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করলেও তাদেরকে ঋণ দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে ১৩ শতাংশ পরিবার কোনও ধরনের তদবির করতে না পারায় তাদের কৃষিঋণ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এছাড়া আরও ৭ শতাংশ পরিবার ব্যাংক কর্মকর্তাদের খুশি করতে না পারায় তারা ঋণ পায়নি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঋণ বিতরণের সময় ঋণ গ্রহীতার সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে তারপর ঋণ দিতে হবে।  এছাড়া ঋণ গ্রহীতারা কেন কৃষি খাতের ঋণ অন্য খাতে ব্যবহার করছেন, তার আসল কারণ বের করতে হবে।

কৃষি ব্যাংকের বরগুনার মুখ্য আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-মহা ব্যবস্থাপক নারায়ন চন্দ্র মন্ডল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কৃষকের ঋণের চাহিদার ভিত্তিত্বে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে ও সরেজমিনে গিয়ে মাঠ পরিদর্শন করা হয়। ঋণের আবেদনকারী প্রকৃত কৃষক কিনা, তার জমি চাষ করা হয় কিনা তা যাচাই বাচাইয়ের মাধ্যমে কৃষিঋণ দেওয়া হয়। তিনি জানান,  তার শাখার কৃষকরা  ঋণ নিয়ে শতভাগই কৃষি কাজে ব্যবহার করেন।

এদিকে কৃষিঋণ না পাওয়া মাগুরা সদর উপজেলার কাটাখালি এলাকার কৃষক সাইদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমার এলাকায় যারা চাকরি করে এবং ব্যবসা করে, তারা অনেকেই কৃষি ঋণ পেয়েছেন। কিন্তু আমি কৃষক হওয়া সত্বেও অনেকের কাছে ধরণা দিয়েও কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ পাইনি।

 এ প্রসঙ্গে কৃষি ব্যাংকের মাগুরা প্রধান শাখার সুপার ভাইজার মুন্সি রকিব হোসেন বলেন, ঋণ নেওয়ার পরে অনেকে তা যথাযথ ব্যবহার করে না, এটা সত্যি। তবে এ সংখ্যা খুব বেশি না।

মাগুরা কৃষি ব্যংক আঞ্চলিক কর্মকর্তা আমজাদ আলী বলেন, ঋণ দেওয়ার আগে আমরা প্রকল্পটি ভালোভাবেই তদন্ত করে নিই। ঋণ নেওয়ার পর কেউ কেউ অন্য খাতে ব্যবহার করে এটা ঠিক। তবে সেক্ষেত্রে আমরা দ্বিতীয়বার তাকে ঋণ না দেওয়ার জন্য সুপারিশ করি।

চলতি বছরে ২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কৃষি ও পল্লিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত অর্থবছরে তুলনায় ১৬ দশমিক ২৪ শতাংশ বেশি। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বাইরে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক ২০ কোটি ও বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) ৭২০ কোটি টাকার কৃষি ঋণ বিতরণ করবে।

(সংবাদটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বাংলা ট্রিবিউনের মাগুরা প্রতিনিধি মাজহারুল হক লিপু ও বরগুনা প্রতিনিধি তরিকুল রিয়াজ)

/টিএন/আপ-এসএনএইচ/

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে