X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

এনবিআরের নজরদারিতে অর্ধশত প্রতিষ্ঠান

গোলাম মওলা
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২২:১২আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২২:১৭

 

এনবিআরের নজরদারিতে অর্ধশত প্রতিষ্ঠান যে সব প্রতিষ্ঠান নানা কৌশলে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ইতোমধ্যে আলোচিত অর্ধশতাধিক বড় প্রতিষ্ঠানকে নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। এই তালিকায় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রয়েছে বেশকিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামও। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

সম্প্রতি এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) বিভাগ এমন অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে একটি তালিকা তৈরি করেছে। তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ইতোমধ্যে বিশেষ নিরীক্ষাও চালাচ্ছে এলটিইউ।

এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা কর বা ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিশেষ করে সরকারের দেওয়া বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিয়ে যারা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে, তাদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে থাকবে এনবিআর।’

অবশ্য এনবিআর চেয়ারম্যান সংস্থাটিতে যোগ দেওয়ার দিনই দেশের যেসব ধনী কর দেন না, তাদের খুঁজে বের করতে এনবিআরের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। তার যোগদান উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীর নাম শুনি, তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি জানি। কিন্তু কর দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা সবার পেছনে থাকেন। আমরা তাদের খুঁজে বের করে সম্মান জানাতে চাই।’

সূত্র জানায়, তালিকায় থাকা প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় আমদানি-রফতানি, স্থানীয় ক্রয়-সংক্রান্ত হিসাবের কাগজপত্র, প্রাসঙ্গিক দলিল, আয়কর বিভাগসহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে আড়াআড়িভাবে যাচাইপূর্বক সম্ভাব্য ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক পরিহার করে বছরভিত্তিক ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হচ্ছে। এ জন্য এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) থেকে আমদানি-রফতানির তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

এনবিআর সূত্র জানায়, ভ্যাট ফাঁকি বিষয়ে খতিয়ে দেখতে দু’জন সহকারী কমিশনার ও চারজন উপ-কমিশনারের নেতৃত্বে ৬টি টিম গঠন করে দেওয়া হয়েছে। এটি তত্ত্বাবধান করছেন এলটিইউ’র একজন অতিরিক্ত কমিশনার।

এদিকে গত পাঁচ বছর কী পরিমাণ ভ্যাট দিয়েছে ও কোন কোন উৎস থেকে দিয়েছে, তাও নিরীক্ষা করে দেখছে এনবিআর। এর আগে উৎপাদন প্রক্রিয়া, মজুদ পণ্য ও সেবা, উপকরণ পরিদর্শন, মূসক পুস্তক, বাণিজ্যিক দলিল, হিসাব ও নথিপত্র, ব্যাংক লেনদেন, অডিট রিপোর্ট জমা দিতে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এলটিইউ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

নজরদারিতে থাকা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ইতোমধ্যে দাবি নামার চিঠিও পাঠানো হয়েছে বলেও এনবিআর সূত্র জানায়। এরই অংশ হিসাবে সম্প্রতি গ্রামীণফোনের কাছে স্থান ও স্থাপনা ভাড়ার বিপরীতে যথাযথভাবে ভ্যাট পরিশোধ না করায় ৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা ফাঁকি অভিযোগে চিঠি এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট।

জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশনস সৈয়দ তালাত কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা এনবিআরের নোটিশ পেয়েছি। বর্তমানে আমরা নোটিশটি পর্যালোচনা করছি, তাই এই মুহূর্তে এ সম্পর্কে আমাদের পক্ষে মন্তব্য করা সম্ভব নয়।’ এর আগে গ্রামীণ ফোনের কাছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব ফাঁকির দাবিনামা জারি করে এনবিআর। এর মধ্যে পাওনা ২ হাজার ১৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা আদায়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপ চেয়ে সম্প্রতি একটি চিঠি দিয়েছে এনবিআর। যদিও এনবিআরের সব দাবির বিরুদ্ধে গ্রামীণফোন মামলা করায় রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি ঝুলে রয়েছে।

এদিকে বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা লিমিটেডের বিরুদ্ধে আরও ৯২৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি অভিযোগে ৫টি চিঠি পাঠিয়েছে এনবিআর।

এনবিআরের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার রবির ভাইস প্রেসিডেন্ট (কমিউনিকেশনস অ্যান্ড করপোরেট রেস্পন্সিবিলিটি) ইকরাম কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা চিঠি পেয়েছি। এনবিআর যে রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ তুলেছে, আমরা তা আইনগতভাবে মোকাবিলা করবো।’

উল্লেখ্য, ৯২৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি ছাড়াও এর আগে রবির কাছে কয়েকবার রাজস্ব ফাঁকির দাবিনামা জারি করে এনবিআর।

একই চিত্র বাংলালিংকের ক্ষেত্রেও। এনবিআরের হিসাবে রিপ্লেসমেন্টের নামে পুরনো সিম বিক্রির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ১৬৮ কোটি ৯১ হাজার ৪৯ হাজার ৫২ টাকা ৪৪ পয়সা।

এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে স্থান ও স্থাপনা ভাড়ার ওপর প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকার ভ্যাট (মূসক) ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে প্রতিষ্ঠানটি এই বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর এনবিআর থেকে পাওনা আদায়ে বাংলালিংককে চিঠি (ডিমান্ড নোট) দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে বাংলালিংকের হেড অব ট্যাক্স আবিদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এনবিআর থেকে যখন বাংলালিংককে দাবিনামার চিঠি (ডিমান্ড নোট) দেওয়া হয়, তারপরই আমরা আপিল করেছি।’

এর আগে ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত স্থান ও স্থাপনা ভাড়া হিসেবে ৩৪ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সিম রিপ্লেসমেন্টের নামে বাংলালিংকের ৫৩২ কোটি ৪১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে এনবিআর।

এদিকে জনতা ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত গার্মেন্টস খাতের অ্যানন টেক্স গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে এনবিআর। এছাড়া বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির অভিযোগে সম্প্রতি গ্যালাক্সি সুয়েটার্স অ্যান্ড ইয়ার্ন ডায়িংয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর।

উল্লেখ্য, রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া গ্যালাক্সি সুয়েটার্স অ্যানন টেক্স গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান।

এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ইউনুস বাদল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এনবিআর আমাদের প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি বাড়ালেও কোনও অনিয়ম পাচ্ছে না।

একইভাবে বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণের মাধ্যমে প্রায় ২৮০ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে।

এর বাইরে রাষ্ট্রীয় টেলিফোন সংস্থা বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) কাছে ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৮০ কোটি টাকা। আবার রাজধানীর পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ—ঢাকা ওয়াসার বিরুদ্ধে প্রায় ১৭৭ কোটি টাকার ভ্যাট (মূসক) ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর বাইরে পেট্রোবাংলার কাছে এনবিআরের পাওনা রয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা, পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কাছে রয়েছে ২ হাজার ৩শ কোটি টাকা, ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট ফি বাবদ আছে সাড়ে ৫শ কোটি টাকার বেশি এবং বিটিআরসির কাছে ৫শ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠান সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করা গেলে ফাঁকি বন্ধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সজাগ ও সর্তক থাকতে হবে।’ তার মতে, ‘যে পদ্ধতিতে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে, সেটি আগে বন্ধ করতে হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন,  ‘কর ফাঁকি ধরলেই হবে না, আইনানুগ ব্যবস্থাও নিতে হবে। তাহলেই কেবল কর ফাঁকি দেওয়া বন্ধ হবে।’

এছাড়া এনবিআরের নিরীক্ষায় রয়েছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড, নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট লিমিটেড, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, বাটা সু কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড। হেলথকেয়ার লিমিটেড, রেনেটা লিমিটেড, ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেড, জেসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, এসিআই লিমিটেড, লিবরা ইনফিউশন লিমিটেড, ঢাকা ওয়াসা, বিটিভি (বাংলাদেশ টেলিভিশন), বাংলাদেশ ব্রিজ অথোরিটি, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি), বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই অথোরিটি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের আওতাধীন হরিপুর গ্যাস ফিল্ড, কৈলাসটিলা গ্যাস ফিল্ড, বিয়ানীবাজার গ্যাস ফিল্ড, রশিদপুর গ্যাস ফিল্ড, ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাস ফিল্ড, রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস, ইউনাইটেড এডিবল অয়েল লিমিটেড, দীপা ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড, ফারজানা অয়েল রিফাইনারিজ লিমিটেড, শবনম ভেজিটেবল লিমিটেড, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন,  ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ট্রাইস প্যাক লিমিটেড, মিউচুয়াল মিল্ক প্রোডাক্ট লিমিটেড, ন্যাশনাল টিউবস লিমিটেড, বাংলাদেশ ইনস্যুলেটর অ্যান্ড স্যানেটারি ওয়্যার ফ্যাক্টরি লিমিটেড, বেঙ্গল গ্লাস লিমিটেড, মাগুরা পেপার মিলস লিমিটেড, জিফোরএস সিকিউর সল্যুশন বাংলাদেশ লিমিটেড, দ্য বেঙ্গল প্যাকেজেস লিমিটেড।

 

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
একই উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী মা-ছেলে ও নাতি
একই উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী মা-ছেলে ও নাতি
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৬ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলাবৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৬ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলাবৃষ্টির আভাস
যশের ছবিটি ছেড়ে দিলেন কারিনা!
যশের ছবিটি ছেড়ে দিলেন কারিনা!
গাম্বিয়ার কৃষি খাতে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির বিষয়ে আলোচনা
গাম্বিয়ার কৃষি খাতে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির বিষয়ে আলোচনা
সর্বাধিক পঠিত
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে