X
রবিবার, ১৯ মে ২০২৪
৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ডায়াগনস্টিক সেন্টার: রোগ নির্ণয়কেন্দ্র যখন রোগের কারখানা!

উদিসা ইসলাম
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৭:৫৯আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১১:৩০

ডায়াগনস্টিক সেন্টার: রোগ নির্ণয়কেন্দ্র যখন রোগের কারখানা! মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডে সাড়ে ৬শ স্কয়ার ফুটের একটি বাড়ির নিচতলা। তাতে ছোট দশটি কামরা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে অ্যাডভান্স ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এখানেই ইসিজি, আলট্রাসনোসহ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে রোগীরা আসছেন, যেখানে-সেখানে থুথু ফেলছেন, অপেক্ষা করছেন টয়লেটের সামনে রাখা ছয়টি চেয়ারে। রোগীরা নাকে কাপড় চেপে বসে আছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একজন রোগী বমি করবেন সেই বেসিনও নেই। একজন পলিব্যাগে বমি করে ফেলে রাখলেন আনুমানিক সাত ফুট বাই আট ফুট ঘরের এক কোণাতেই। চিকিৎসকরা বলছেন, এ ধরনের জায়গায় রোগীর রোগ নির্ণয় করবে কী, আরও রোগাক্রান্ত হয়ে ফিরবে। খুবই দুঃখজনক হলো তাদের অনেকের কাছেই বৈধ কাগজও আছে।  এই প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমরা নিয়মিত দেখভালের মধ্যে রাখি। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা প্রায় অভিযান চালাই।’

ডায়াগনস্টিক সেন্টার: রোগ নির্ণয়কেন্দ্র যখন রোগের কারখানা! অ্যাডভান্স ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্যাথলজি বিভাগে দায়িত্বরত একজন স্টাফ সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের বৈধ কাগজপত্র আছে। পরিচ্ছন্নতার দিকটিও খেয়াল রাখা হয়। আজ কোনও কারণে রোগী বেশি হওয়ায় নোংরা হয়ে আছে।’ 

কেবল অ্যাডভান্স ডায়াগনস্টিক সেন্টার নয়, মোহাম্মদরপুরের বাবর রোড, হুমায়ুন রোডসহ শ্যামলী এলাকাজুড়ে একই ধরনের হাজার খানেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। হুমায়ুন রোডে টানা রাস্তার দুই পাশে ২৪টি বাড়ির ৯টিরই নিচতলায় ডায়াগনস্টিক-এর সাইনবোর্ড। আর সরকারি সব হাসপাতালের চিকিৎসকদের দশ বারোটি করে সাইন বোর্ড লাগানো। খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই বলছেন, সাইনবোর্ড সর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই। হাতুড়ে টেকনেশিয়ান দিয়েই চালানো হয় রোগ-নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা। আর মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে ঠকানো হচ্ছে নিরীহ মানুষকে।

মোহম্মদপুরের এসব এলাকায় অবস্থিত অন্তত বিশটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঘুরে দেখা গেছে, অপেক্ষাকৃত স্বল্পআয়ের মানুষদের ধরে এনে পরীক্ষার কথা কোনও মতে বলেই এখানেই এনে চিকিৎসা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কথা হয় এমনই একজনের চিকিৎসা-প্রার্থী রাসেলের সঙ্গে। তার বাড়ি কুষ্টিয়া। হাটতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ব্যথা পান হাতের তালুতে। সেটি স্থানীয় ক্লিনিকে সেলাই করে দিলে একদিনে হাত ফুলেফেঁপে ওঠে। সেখান থেকে পঙ্গুতে আসেন তিনি। পঙ্গু হাসপাতালের বারান্দায়ই দেখা হয় ভাইটাল ডায়াগনস্টিকের এক দালালের সঙ্গে। তিনি তাকে পঙ্গুতে চিকিৎসা না করে কম খরচে এক জায়গায় সব পাওয়া যাবে বলে নিয়ে আসেন হুমায়ুন রোডের এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিকিৎসা প্রসঙ্গে রাসেল  বলেন,  ‘অন্য হাসপাতালে আমাকে খালি পেটে রক্ত দিতে বলেছিল। আর  এখানে ভরা পেটেই রক্ত নিল!’

ডায়াগনস্টিক সেন্টার: রোগ নির্ণয়কেন্দ্র যখন রোগের কারখানা! অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগ জীবাণু সংক্রমণ বিষয়ে মনোয়ারা হাসপাতালের নিউরোমেডিসিনের চিকিৎসক গোবিন্দ বণিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যখন কারও রোগ হয়, তখন এমনিতেই তিনি ভঙ্গুর অবস্থায় থাকেন। ওই সময় জীবাণুর আক্রমণ প্রতিরোধের সক্ষমতা কম থাকে তার। ফলে, ওই যদি সময় অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে কেউ থাকেন, তাহলে তা ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে। মানুষের থুথু, মল, টেকনিশিয়ানদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র যদি যথাস্থানে না ফেলা হয়, ঢাকনাহীন জায়গায় রাখা হয়, সেটা সুস্থ মানুষকেও শঙ্কটাপন্ন করে তুলতে পারে।’

হুমায়ুন রোডের অধিকাংশ বাড়িরই নিচতলার একটি করে ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এখানে কাজ করেন মূলত বেসরকারি টেকনিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রীরাই। কারও কারও আবার কোনও সার্টিফিকেটই নেই। তাদেরই একজন এসেছেন বগুড়ার ঠেঙ্গামারা মহিলা সমিতি থেকে প্যাথলজির ওপর পড়ালেখা করে। তিনি বলেন, ‘এখানে সবই ঘটে। ভাড়া করে আনা হয় চিকিৎসক। যে চিকিৎসকদের নাম বাইরে লেখা বোর্ডে আছে, তাদের  কমিশন দেওয়া হয়। তারা প্রায় আসেন না বললেই চলে। আমরাই পুরো কাজ শেষ করে টেলিফোনে বিবরণ শুনিয়ে ওষুধের নাদম জেনে নিয়ে রোগীদের দিয়ে দেই।’

ডায়াগনস্টিক যন্ত্র নিউভিশন নামে একটি দুই কামরার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কোনও রোগী নেই, বারান্দায় একটি টেবিলনিয়ে বসে আছেন একজন। নাম জানতে চাইতেই তিনি দূরে গিয়ে দাড়ালেন। কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি নন তিনি। পরে তার পরিচয় গোপন রাখার কথা বলতেই তিনি বলেন, ‘কমিশনের লোভে সরকারি হাসপাতালগুলোর প্যাথলজিক্যাল বিভাগকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেওয়া হয় না। এখানে কত দামি-দামি আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে কিন্তু সেগুলো দেখবেন বেশিরভাগ সময় অকেজো। আর সরকারি হাসপাতালে ওসব দায়িত্বে যারা থাকেন, তারা রোগীকে নানা জায়গায় পাঠিয়ে দেন। আবার চিকিৎসকরাও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম উল্লেখ করে দেন। কম আয়ের রোগী হলে আমাদের এই রোডে যে অর্ধশত সেন্টার আছে, সেগুলোর কোনও একটিতে পাঠিয়ে দেন ডাক্তাররা। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মালিকরা মাসিক ভিত্তিতে টাকা দিয়ে আসেন ডাক্তারদের।’

ডায়াগনস্টিক সেন্টার: রোগ নির্ণয়কেন্দ্র যখন রোগের কারখানা! প্রায়ই র‌্যাবের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করা জরিমানা করার মতো কাজগুলো করা হয়। কিন্তু প্রধান সড়কে, রাজধানীতেই এ ধরনের ব্যবসা একটুও না কমার বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের মিডিয়া উইং-এর পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা প্রায়ই অভিযান চালাই। কিন্তু এটিই আমাদের প্রধান কাজ নয়। আমাদের জনবল সংকটও রয়েছে।’ কোন কোন ক্যাটাগরিতে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধতা আছে কিনা কিংবা যারা টেস্ট করছেন, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কেমন এবং পরীক্ষা করার পর সেই কাগজে চিকিৎসক স্বাক্ষর করেন কিনা, এসবই অভিযানকালে খতিয়ে দেখা হয়।’

এই প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমরা নিয়মিত দেখভালের মধ্যে রাখি। কিন্তু এসব ডায়গনস্টিক সেন্টারের মালিকরা প্রায় শর্ত ভঙ্গ করেন ও সেন্টাগুলোকে সেবা উপযোগী করে রাখেন না।  তবে এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা প্রায় অভিযান চালাই।’

/এমএনএইচ/আপ-এসএনএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘জার্মানির তৃতীয় বিভাগের ক্লাবের সঙ্গেও বাংলাদেশকে মেলানো যায় না’
‘জার্মানির তৃতীয় বিভাগের ক্লাবের সঙ্গেও বাংলাদেশকে মেলানো যায় না’
তোরণ ও ব্যানার টানিয়ে জরিমানা গুনলেন তিন প্রার্থী
তোরণ ও ব্যানার টানিয়ে জরিমানা গুনলেন তিন প্রার্থী
ভারতীয় পেঁয়াজে রফতানি মূল্য নির্ধারণ, বিপাকে আমদানিকারকরা
ভারতীয় পেঁয়াজে রফতানি মূল্য নির্ধারণ, বিপাকে আমদানিকারকরা
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ মে, ২০২৪)
সর্বাধিক পঠিত
মামুনুল হক ডিবিতে
মামুনুল হক ডিবিতে
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
আমেরিকা যাচ্ছেন ৩০ ব্যাংকের এমডি
আমেরিকা যাচ্ছেন ৩০ ব্যাংকের এমডি
নীরবে মামুনুল হক,  শাপলা চত্বরের ঘটনা বিশ্লেষণের সিদ্ধান্ত
নীরবে মামুনুল হক, শাপলা চত্বরের ঘটনা বিশ্লেষণের সিদ্ধান্ত
মোবাইল আনতে ডিবি কার্যালয়ে মামুনুল হক
মোবাইল আনতে ডিবি কার্যালয়ে মামুনুল হক