X
বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্বর্ণ আমদানিতে বাধা কোথায়?

গোলাম মওলা
২৭ মার্চ ২০১৮, ১১:৫৯আপডেট : ২৭ মার্চ ২০১৮, ২০:৪১

স্বর্ণবাজার

স্বর্ণ আমদানিতে কাগজে-কলমে কোনও বাধা নেই। নিয়ম মেনে যেকোনও দেশ থেকে যে কেউ, যে কোনও পরিমাণে স্বর্ণ আমদানি করতে পারেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের কোনও ব্যবসায়ী এক তোলা স্বর্ণও আমদানি করেননি। দেশে স্বর্ণের খনিও নেই কোনও।অথচ দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে ২০ হাজারের বেশি স্বর্ণের দোকান। এসব দোকানে নিয়মিত তৈরি হচ্ছে হরেক রকমের গয়না। এসব গয়নার দোকানে কাজও করছেন কারিগরসহ দেড় লাখের বেশি শ্রমিক।

শহর থেকে মফস্বল, সবখানে জুয়েলারি দোকানের ভীষণ কদর। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার স্বর্ণের গয়না কেনাবেচা হলেও এই পণ্যটি যেন কমছেও না।

আমদানি না করে প্রতি বছর এই বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ কীভাবে পাওয়া যায় জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্যাগেজ রুলসের আওতায় কিছু স্বর্ণ বাইরে থেকে আসে। বাকিটা দেশের ভেতরে থাকা পুরনো স্বর্ণ দিয়েই সামাল দিতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘স্বর্ণের চাহিদা থাকলেও আমদানি প্রক্রিয়া জটিল হওয়ার কারণে সরবরাহ কম। ফলে এ পণ্যটির দাম প্রায়ই বাড়াতে হয়।’

স্বর্ণ আমদানিতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ না দেখানোর পক্ষে বেশ কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরেন জুয়েলার্স সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য দেওয়ান আমিনুল ইসলাম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বর্ণ আমদানি করতে গেলে যতগুলো পথ পাড়ি দিতে হয়, তার সবগুলোই জটিল।’ তিনি বলেন, ‘স্বর্ণ আমদানি করতে চাইলে প্রথমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি নিতে হয়, সেটা অনেক জটিল কাজ। তারপর আমদানি-রফতানি নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের ইমপোর্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (আইআরসি) সংগ্রহ করতে হয়। সেটাও অনেক জটিল প্রক্রিয়া। তারপর যেতে হয় কোনও ব্যাংকে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি ছাড়া কোনও ব্যাংকই এলসি খোলে না। অর্থাৎ প্রতিবন্ধকতা এলসি খোলার ক্ষেত্রেও। কারণ, এলসি খোলার সময় যখন ব্যাংকে হিসাব (অ্যাকাউন্ট) খুলতে হয় তখনই উল্লেখ করতে হয় আমদানি করা স্বর্ণ আসবে কীভাবে বা কোন পথে। এক্ষেত্রে কোনও একটি ইন্সু্রেন্স প্রতিষ্ঠানে ইন্সুরেন্স করতে হয়। স্বর্ণ কোন বাহনে বা পরিবহনে আনা হবে, তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিতে হয়। এর নিরাপত্তা কে বা কীভাবে দেবে, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনতে কারা নিরাপত্তা দেবে, এসব করার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি পাওয়া যায় না। ফলে বাধ্য হয়ে বিকল্পভাবে ব্যবসায়ীরা স্বর্ণ সংগ্রহ করেন।’

তবে নাম প্রকাশ না করে জুয়েলার্স সমিতির এক নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অবৈধ পথে স্বর্ণ আনতে সময় লাগে কম। ঝুঁকিও কম। খরচও কম। এক সপ্তাহের মধ্যেই স্বর্ণ পৌঁছে যায়। অথচ বৈধপথে স্বর্ণ আমদানি করতে গেলে নানা অপ্রীতিকর প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। স্বর্ণ ব্যবসায় বিনিয়োগের উৎস জানাতে হয়। এ স্বর্ণ কোথায়, কীভাবে বিক্রি করা হবে, তার নিশ্চয়তা দিতে হয়। এছাড়া আমদানি করতে হলে টাকা বিনিয়োগ করে ১৫ থেকে ২০ দিন অপেক্ষা করতে হয়। এতে অনেক সময় নষ্ট হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম ওঠানামা করলে মুনাফা নিয়ে ঝুঁকি থাকে। এসব কারণে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বৈধ প্রক্রিয়ায় স্বর্ণ আমদানিতে উৎসাহ দেখান না।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের জুয়েলারি দোকানগুলোতে যেসব স্বর্ণ ব্যবহৃত হচ্ছে তার অধিকাংশই চোরাই পথে আসা। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলিপ কুমার আগারওয়াল নিজেই জানিয়েছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত কোনও ব্যবসায়ী এক তোলা স্বর্ণও আমদানি করেননি। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “বিগত ৪৮ বছর ধরে আমরা বৈধতা চাচ্ছি। ২০ বছর ধরে আমরা ‘স্বর্ণ নীতিমালা’ চাচ্ছি। কিন্তু কোনও ফল পাওয়া যাচ্ছে না।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের কারণে স্বর্ণ আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

 

স্বর্ণের বাজারে থেমে নেই অবৈধ ব্যবসা

 

বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, ট্যারিফ কমিশন ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক তদন্ত প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে, বৈধ উপায়ে কোনও সোনা আমদানি হয় না। দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশ থেকে একশ্রেণির চোরাকারবারির সহায়তায় সোনা এনে তা দেশের বাজারে বেচা হচ্ছে। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

যদিও আমদানি নীতিমালার ২৬-এর ২২ ধারায় সোনা, রুপা আমদানিকে উন্মুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৯৪৭’-এর শর্ত পূরণ করেও বিদেশ থেকে সোনা ও রুপা আমদানি করা যায়। এ ব্যবসার ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) নিবন্ধন নম্বর থাকলেই বৈধভাবে ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে মোট মূল্যের চার শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে দেশে স্বর্ণ আমদানি করার বিধান রয়েছে। শুধু স্বর্ণ নয়, অমসৃণ হীরাও রফতানির উদ্দেশ্যে আমদানির সুযোগ রয়েছে ব্যবসায়ীদের। এর বাইরে ব্যাগেজ রুলের আওতায় নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ আনতে পারেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ব্যবসায়ীরা আমদানির পথে না গিয়ে বরং চোরাকারবারিদের কাছ থেকে স্বর্ণ সংগ্রহ করেন।

গত বছর বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাক-বাজেট আলোচনায় সংগঠনটির সহ-সভাপতি এনামুল হক শামীম চোরাচালানের স্বর্ণের বিষয়টি স্বীকার করে জানান, ‘বর্তমান বাজারে স্বর্ণের বড় অংশের জোগান আসে কালোবাজারের মাধ্যমে। এছাড়াও সামান্য অংশ আসে বিদেশ থেকে ব্যক্তিগতভাবে আনার বৈধ অনুমতিপত্রের মাধ্যমে। মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যবসায়ী দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে স্বর্ণ কেনেন। বাকিরা কালোবাজার ও ভারত থেকে স্বর্ণ সংগ্রহ করেন।’

এদিকে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি থেকে সম্প্রতি একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর ফজলে কবিরের কাছে। ওই চিঠিতে স্বর্ণ আমদানির প্রক্রিয়াটিকে বৈষম্যমূলক এবং কালক্ষেপণকারী দাবি করা হয়েছে।

তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য হচ্ছে, স্বর্ণ আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু করার নেই। নিয়ম মেনে যে কেউ স্বর্ণ আমদানি করতে পারেন। তবে বিগত ১০ বছরে কোনও ব্যবসায়ী নিয়ম মেনে স্বর্ণ আমদানির চেষ্টা করেননি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমদানি নীতিতে যেভাবে বলা আছে, বাংলাদেশ ব্যাংকও সেভাবেই ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়ে থাকে।’ তিনি বলেন, ‘স্বর্ণ আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুই করতে পারে না।’ স্বর্ণ আমদানির অনুমতি দেওয়া না-দেওয়া সরকারের বিষয় বলেও মনে করেন তিনি।

আগামীকাল পড়ুন: যে কারণে চোরাই স্বর্ণ কিনতে চান ব্যবসায়ীরা

 

 

/এইচআই/টিএন/চেক-এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় বিজয়ী হলেন যারা
কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় বিজয়ী হলেন যারা
কদমতলীতে গলায় ফাঁস লেগে দশ বছরের শিশুর মৃত্যু
কদমতলীতে গলায় ফাঁস লেগে দশ বছরের শিশুর মৃত্যু
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসব শুরু আজ থেকে
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসব শুরু আজ থেকে
আজিজ মোহাম্মদসহ ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড চায় রাষ্ট্রপক্ষ, খালাসের দাবি আসামিপক্ষের
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাআজিজ মোহাম্মদসহ ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড চায় রাষ্ট্রপক্ষ, খালাসের দাবি আসামিপক্ষের
সর্বাধিক পঠিত
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
‘চুন্নু স্বৈরাচারের দোসর’, বললেন ব্যারিস্টার সুমন
‘চুন্নু স্বৈরাচারের দোসর’, বললেন ব্যারিস্টার সুমন
এক লাফে ডলারের দাম বাড়লো ৭ টাকা
এক লাফে ডলারের দাম বাড়লো ৭ টাকা
ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর ইস্যুতে ন্যাটোকে রাশিয়ার সতর্কতা
ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর ইস্যুতে ন্যাটোকে রাশিয়ার সতর্কতা
ইউক্রেনে পাঠালে ফরাসি সেনাদের নিশানা করার হুমকি রাশিয়ার
ইউক্রেনে পাঠালে ফরাসি সেনাদের নিশানা করার হুমকি রাশিয়ার