X
সোমবার, ১৭ জুন ২০২৪
৩ আষাঢ় ১৪৩১

ব্যাংকে টাকা রেখে মানুষ মুনাফা পাচ্ছে না: সিপিডি

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
২৩ মে ২০২৪, ১৭:৫৫আপডেট : ২৩ মে ২০২৪, ১৭:৫৫

দেশে গত দুই বছরে মূল্যস্ফীতির হার যেভাবে বেড়েছে, সেই তুলনায় ব্যাংকে রাখা আমানতের সুদহার বাড়েনি। পরিণামে ব্যাংকে টাকা রেখে মানুষ মুনাফা তো পাচ্ছেই না, উল্টো ক্ষতি হচ্ছে তাদের।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করা মূল প্রবন্ধে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২৩ মে) রাজধানী একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সামনে কী’ শীর্ষক এক সেমিনারে সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মূল প্রবন্ধে এ তথ্য জানান। সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন।

সাবেক পরিকল্পমন্ত্রী আব্দুল মান্নান, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক ব্যাংকার মোহাম্মদ নূরুল আমিন, সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাসহ অনেকে সেমিনারে অংশ নেন।

সিপিডি বলছে, ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর থেকে ব্যাংকে টাকা রেখে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে মানুষ। অর্থাৎ প্রায় চার বছরে ধরে ব্যাংকে আমানত রেখে মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ব্যাংকে আমানত রেখে সর্বশেষ মুনাফা পাওয়া গেছে ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। পরের মাস মার্চে আমানতের প্রকৃত সুদহার ছিল শূন্য।

সিপিডির হিসাব মতে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংক আমানতের প্রকৃত সুদহার ছিল শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। মার্চে তা শূন্যের কোঠায় নামার পর ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রকৃত সুদহার ঋণাত্মক। ২০২২ সালের আগস্ট ও ২০২৩ সালের মে মাসে তা সর্বোচ্চ মাইনাস ৫ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত নেমেছিল। এরপর মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে তা সব সময় ওঠানামা করেছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমানতের সুদহার ছিল মাইনাস ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।

সুদহার ৬-৯ করার পর ঋণের সুদহারের পাশাপাশি আমানতের সুদহারও কমে গিয়েছিল। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৮ আগস্ট মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে মেয়াদি আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন বলা হয়, আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হবে না। কিন্তু অনেক ব্যাংকই তা দিতে পারেনি। এরপর ঋণের সুদহারের সীমা তুলে নেওয়া হয় এবং তার প্রতিক্রিয়ায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আমানতের সুদহারের সীমাও তুলে নেওয়া হয়। এরপর ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহারও বাড়িয়েছে। এখন আবার অনেক ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করতে সুদহার বাড়িয়েছে। কিন্তু সিপিডি’র এই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে— প্রায় চার বছর ধরে মানুষ ব্যাংকে টাকা রেখে ক্ষতির মুখে পড়ছে।

অনাদায়ী ঋণ ৫ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা

সেমিনারে সিপিডি বলছে, ব্যাংকিং খাতে অনাদায়ী ঋণ ৫ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ ৪২ হাজার ৭১৫ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে পুনঃতফসিল ঋণসহ খারাপ ঋণ যোগ করা হলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। অপরদিকে অর্থ ঋণ আদালতে ৭২ হাজার ৫৪৩টি মামলার বিপরীতে অনাদায়ী ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৭ কোটি টাকার ঋণ যোগ করলে মোট অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ লাখ ৫৬ হাজার ২০৯ কোটি টাকা।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংক খাতে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির চরম অবনতি হয়েছে। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যাংক খাতে অলিগার্ক তৈরি হয়েছে। এ প্রবণতা আমানতকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করছে।

মূল প্রবন্ধে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ২০২২ সালের শেষে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে অর্থঋণ আদালতের মামলায় আটকে থাকা এক লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে খারাপ ঋণ আরও বেশি।

তিনি বলেন, দেশের আর্থিক খাত ব্যাংকনির্ভর। দেশের উন্নয়নে এ খাতের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। অথচ সেই ব্যাংক খাতে ভঙ্গুরতা দেখা দিয়েছে। সুশাসন ও জবাবদিহির হরণ ঘটেছে। ঋণ অনুমোদন, পুনঃতফসিল, অবলোপন সবই নিজেদের মতো করে করা হচ্ছে।

প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই অবস্থা থেকে যদি ব্যাংকিং খাতকে টেনে তুলতে হয়ে, তাহলে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, বিগত দিনে আমরা দেখেছি, লাভের ব্যক্তিকরণ এবং ক্ষতির রাষ্ট্রীয় করণ করা।

দুর্বল ও সবল ব্যাংকে একীভূত প্রসঙ্গে সিপিডি বলছে, সরকারি ব্যাংকগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার থেকে বহুবার অর্থ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে বার বার দেওয়া হচ্ছে। শুধু বেসরকারি ব্যাংক যেমন- পদ্মা ব্যাংককে টেনে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সেটা রক্ষা হয়নি। এরূপ অবস্থায় সরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়া এগিয়ে যদি নিতেই হয়, তাহলে পৃথিবীর স্বনামধন্য অ্যাসেসমেন্ট কোম্পানিকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়ে আসুন। যদিও বাংলাদেশের ব্যাংকিং ‘স্বাস্থ্য’ সেটা বিবেচনায় নিলে তারা আগ্রহী হবে কিনা, সেটা বড় প্রশ্ন। আর মার্জ করার বিষয়ে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটা যাচাই-বাছাই করা হয়েছে কিনা? সবার আগে দুর্বল ব্যাংকের স্বাস্থ্য অডিটের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা দরকার, সেটা আসলে কতখানি খারাপ। তারপরও ব্যাংকগুলো সিদ্ধান্ত নেবে যে, ভালো ব্যাংকগুলো ওই ব্যাংক কিনবে কিনা?

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন— সুদহার, ডলারের দর অনেক আগেই বাড়ানো দরকার ছিল। তা না করায় মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, ডলারের দর বাড়িয়ে কিংবা সুদহার বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি হবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সিদ্ধান্তের জন্য ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদকে ডাকে। সকালে সিদ্ধান্ত নেয় বিকালে পরিবর্তন করে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সমবায় সমিতিতে পরিণত হয়েছে।

ড. সালেহউদ্দিন বলেন,  বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বলেই ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে। আমরাও চালিয়েছি, এত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করিনি, এত সার্কুলার দেইনি। এখন কেউ খেলাপি হলে তার একটি প্রতিষ্ঠান ঋণ পাবে না, তবে অন্যগুলো পাবে— এটা কী, আমার বুঝে আসে না। আমরা রিজার্ভ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার খরচ করে ফেলে এখন মাথায় হাত। আমাদের পলিসিটা আগে ঠিক করতে হবে, কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তিনি বলেন, এখন ব্যবসার মতোই খেলাপি ঋণ মডেলে পরিণত হয়েছে। সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক চাপের কারণে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এত খারাপ অবস্থায় আগে কখনও যায়নি। এ অবস্থায় অবশ্যই কঠোর হাতে দমন করতে হবে। সুশাসন আনতে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে। তা না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যতই ক্যাশলেস সোসাইটি, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, কলিংপেগ দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি করতে চায়, সেটা কোনোভাবেই সম্ভব না।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে শক্তভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সকালে এক রকম নিয়ম করে, বিকালে আবার আরেকজনের কথা শুনে তা পরিবর্তন করে। এসব সিদ্ধান্ত আবার নেয় কখনও ব্যবসায়ী- রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বসে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সমবায় সমিতিতে পরিণত হয়েছে। আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন দেওয়া আছে, কিন্তু এখন তার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

/জিএম/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
রেমিট্যান্সের পালে স্বস্তির হাওয়া, রিজার্ভেও উন্নতি
এক আইএমইআই নম্বরে দেড় লাখ মোবাইল
বিদেশে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন বাড়লো বাংলাদেশিদের
সর্বশেষ খবর
সেমাই কিনতে যাওয়ার পথে পিকআপের ধাক্কায় প্রাণ গেলো দুজনের
সেমাই কিনতে যাওয়ার পথে পিকআপের ধাক্কায় প্রাণ গেলো দুজনের
ঘরে থাকা মসলায় বিফ চাপ
ঘরে থাকা মসলায় বিফ চাপ
২৪ ঘণ্টার আগেই পশুর বর্জ্য অপসারণে ব্যস্ত দক্ষিণ সিটির পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা
২৪ ঘণ্টার আগেই পশুর বর্জ্য অপসারণে ব্যস্ত দক্ষিণ সিটির পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা
জাপান যাওয়ার পথে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর বিমান ভেঙে পড়েছে
জাপান যাওয়ার পথে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর বিমান ভেঙে পড়েছে
সর্বাধিক পঠিত
পারমাণবিক কর্মসূচি বৃদ্ধি নিয়ে জি-৭ এর বিবৃতির জবাবে যা বললো ইরান
পারমাণবিক কর্মসূচি বৃদ্ধি নিয়ে জি-৭ এর বিবৃতির জবাবে যা বললো ইরান
গাজায় কৌশলগত বিরতি ঘোষণা ইসরায়েলের
গাজায় কৌশলগত বিরতি ঘোষণা ইসরায়েলের
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: শান্তি সম্মেলন শেষে চূড়ান্ত ঘোষণায় যা বললো সুইজারল্যান্ড
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: শান্তি সম্মেলন শেষে চূড়ান্ত ঘোষণায় যা বললো সুইজারল্যান্ড
ছাগলেই স্বস্তি!
ছাগলেই স্বস্তি!
নেপালকে হারিয়ে সুপার এইটে বাংলাদেশ
নেপালকে হারিয়ে সুপার এইটে বাংলাদেশ