X
রবিবার, ০৮ জুন ২০২৫
২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

এবারও চামড়ার দাম কমলো কেন

গোলাম মওলা
০৮ জুন ২০২৫, ১৬:৪৭আপডেট : ০৮ জুন ২০২৫, ১৬:৪৭

কোরবানির ঈদকে ঘিরে প্রতিবছর দেশের চামড়ার বাজারে বড় ধরনের আশা-ভরসা তৈরি হয়। কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও রফতানির মাধ্যমে অর্থনৈতিকচক্রে একযোগে সক্রিয় হয়ে ওঠেন কাঁচামাল সংগ্রাহক, আড়তদার, ট্যানারি মালিক এবং চামড়াজাত পণ্যের রফতানিকারকরা। অথচ বাস্তব চিত্র বলছে, কয়েক বছর ধরে এই চক্রে ভাঙন চলছে— এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সরকার নির্ধারিত মূল্যের তুলনায় অনেক কম দামে চামড়া বিক্রি হওয়ায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা। একইসঙ্গে রফতানি খাতেও অনিশ্চয়তা ও প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে।

সরকারি মূল্য বনাম বাস্তব বাজারদর

চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এবার রাজধানী ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬০-৬৫ টাকা, কিন্তু বাজারে বাস্তবতা সম্পূর্ণ আলাদা। বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই জানিয়েছেন, তারা চামড়া বিক্রি করেছেন ৫৫-৬০ টাকা বা তারও কম দামে। অনেকে কাঁচা চামড়ার ক্ষেত্রে এই দরের নিচে বিক্রিতেও বাধ্য হয়েছেন। ছোট শহর ও মফস্বল এলাকায় দাম ছিল আরও কম।

খিলক্ষেতের মৌসুমি ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বললেন, ‘প্রতিবারই ট্যানারি মালিকরা দাম দিতে গড়িমসি করেন। ফলে আমরা ভয় পাই, বেশি দামে কিনে পরে বিপদে পড়ি।’

উত্তরা এলাকার হেফাজ উল্লাহর অভিযোগ, ‘৭৫০ টাকায় গরুর চামড়া কিনে সর্বোচ্চ ৮২০ টাকায় বিক্রি করেছি। এই দামে ভ্যান ভাড়া, লেবার খরচ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ ওঠে না।’ এমন বাস্তবতায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এবার ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন। অনেকেই চামড়া সংগ্রহ থেকে বিরত থেকেছেন।

চামড়া বিক্রি না করে মাদ্রাসায় দান

কোরবানির পশুর চামড়ার দরপতনের কারণে অনেকেই বিক্রির বদলে মাদ্রাসায় দান করাকেই উত্তম মনে করছেন। মিরপুর এলাকার বাসিন্দা  মো. আজিজ বলেন, ‘৫০০-৬০০ টাকা দামে বিক্রি করে কারও উপকার হয় না, বরং মাদ্রাসায় দিলে তারা দ্বিগুণ দামে বিক্রি করে কাজে লাগাতে পারে।’

দক্ষিণ-পশ্চিম শেওড়াপাড়ার হাসানুল আমীন ও মেজর মনজুরসহ অনেকে তালতলার জামিয়াতুল হাসান আল ইসলামিয়া মাদ্রাসায় চামড়া দান করেছেন। শাপলা সরণির শেখ মো. আবুল কালাম বলেন, ‘বিক্রি করলে মধ্যস্থতাকারীর লাভ। কিন্তু মাদ্রাসায় দিলে সরাসরি উপকার হয়।’ চামড়ার দাম না থাকায় মানবিক ও ধর্মীয় চিন্তা থেকেই এই দানকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন অনেকে।

ট্যানারি মালিকরা যা বলছেন

ট্যানারি মালিকরা দাবি করছেন, সরকার যে মূল্য নির্ধারণ করেছে, তা মূলত লবণযুক্ত প্রস্তুত চামড়ার জন্য। কাঁচা চামড়ার ক্ষেত্রে বাজারভেদে দর কমে বা বাড়ে। তারা জানান, ভালো মানের চামড়া ১২০০-১৫০০ টাকা দামে কেনা হয়েছে। তবে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এমন দর তারা কল্পনাও করতে পারেননি।

কোরবানির ঈদের মৌসুমে এবার কাঁচা চামড়ার দাম মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)। সংগঠনটির সভাপতি শাহীন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভালো মানের ও লবণবিহীন গরুর কাঁচা চামড়া ৯০০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ইতিবাচক প্রবণতা।’ তিনি বলেন, ‘যেসব গরুর চামড়া আকারে তুলনামূলক ছোট বা মানে কিছুটা কম, সেগুলোও ন্যায্য মূল্যে বিক্রি হয়েছে।’

বিটিএ সভাপতি আরও জানান, ঈদের দিন ও পরদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের প্রাথমিক ধাপ শেষ হয়েছে। তবে এখনও লবণযুক্ত চামড়ার কেনাবেচা শুরু হয়নি। ‘আশা করছি, দুই-এক দিনের মধ্যে লবণযুক্ত চামড়ার লেনদেন শুরু হবে এবং সেটার দামও স্থিতিশীল থাকবে,’ বলেন তিনি।

ছাগলের চামড়া যেন মৃত বাজার

ছাগলের চামড়ার ক্ষেত্রে অবস্থা আরও করুণ। গতবারের মত এবারও ছাগলের চামড়ার চাহিদা নেই বললেই চলে। ঢাকার অনেক এলাকায় এসব চামড়া বিনামূল্যে দান করা হয়েছে, কোথাও বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৫-৩০ টাকায়। অনেক সময় সংগ্রহ ও সংরক্ষণের খরচ বেশি পড়ে যাওয়ায় ছাগলের চামড়া গ্রহণ করতেই আগ্রহী হননি অনেক আড়তদার।

ঢাকার বাইরে চামড়া কিনে লোকসানে ব্যবসায়ীরা

কোরবানির ঈদে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামেও কাঁচা চামড়া বিক্রি না হওয়ায় অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী বড় লোকসান করেছেন। ক্রেতা না পাওয়া চামড়ার বেশিরভাগই বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দান করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরীর আড়তে এ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ পিস চামড়া আসলেও দাম কম থাকায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আড়তদাররা জানিয়েছেন, গরু-মহিষের চামড়া ৩০০ থেকে ৬০০ টাকায় কেনা হয়েছে, যা নির্ধারিত দরের তুলনায় অনেক কম। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা প্রতি পিস চামড়ায় প্রায় ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

বাজারে ক্রেতার অভাব ও কম দামের কারণে অনেক চামড়া বিক্রি না হয়ে পড়ে থাকায় বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরা তা মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দান করছেন।

ট্যানারির আর্থিক সংকট ও আগের পাওনা: চক্রবৃদ্ধি সমস্যার সূত্রপাত

ট্যানারি মালিকরা পুরনো বকেয়া পরিশোধ না করায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা আগাম টাকা জোগাড় করতে পারেননি। ফলে চামড়া সংগ্রহে আগ্রহ হারিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে চামড়া সংগ্রহ করতে গিয়ে লোকসান গুনতে হয়েছে। বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ‘প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ ও লজিস্টিক সহায়তা না থাকলে সংকট বাড়তেই থাকবে।’

রফতানিতে ধাক্কা: যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের ভয়াবহ প্রভাব

২০২৫ সালের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। ফলে ইউরোপ-আমেরিকায় রফতানি আদেশ স্থগিত হয়েছে বা মূল্যছাড়ে বিক্রির চাপ তৈরি হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়েছিল।  প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের অথচ ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসেই এই রফতানি ৩২ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রফতানিতে এমন ধাক্কা আর্থিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে অনেক ট্যানারিকে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে কাঁচা চামড়া কেনায়।’

মূল্য নির্ধারণে ধোঁয়াশা: নীতিগত সংকট

এ বছর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও চামড়ার দর নির্ধারণে দেরি হয়েছে, যা বাজারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মৌসুমি খাতের জন্য শুধু দামের ঘোষণা যথেষ্ট নয়—দরদাম, রফতানিনীতি, ব্যাংক ঋণ ও প্রণোদনার স্পষ্ট কাঠামো দরকার।

বাংলাদেশ লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাজারচক্র বুঝে প্রতিবছর খাপ খাওয়ানো সিদ্ধান্ত নয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি রফতানি নীতি ও সহায়তা কাঠামো দরকার।’

অসংগঠিত বাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থা: টেকসই নিয়ে প্রশ্ন

কোরবানির পশুর চামড়া মূলত দেশের সবচেয়ে বড় কাঁচা চামড়ার উৎস। অথচ, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। ভাঙা সরবরাহ চেইন, মান নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, লবণের সংকট ও নিম্নমানের লবণ এসব মিলিয়ে চামড়ার বিশাল অংশ প্রতি বছর নষ্ট হয়ে যায়। ২০১৯ সালে মূল্যধসে প্রায় ২৪২ কোটি টাকার চামড়া বিনষ্ট হয়েছিল, যার প্রভাব এখনও রয়ে গেছে।

ভবিষ্যতের শঙ্কা

একসময় চামড়া শিল্প ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত। এখন তা রফতানিতে পিছিয়ে পড়ছে। প্রক্রিয়াজাত চামড়ার মান ও মূল্যবান পণ্য উৎপাদনে ভাটা পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘প্রতিবছর যদি কোরবানির ঈদ চামড়া শিল্পের জন্য লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে এটি আর সম্ভাবনার খাত থাকবে না।’

দরকার সমন্বিত নীতি ও টেকসই পরিকল্পনা

চামড়ার বাজারে সংকট নতুন নয়, তবে সমাধানও দৃশ্যমান নয়। সরকারি সহায়তা, নীতিনির্ধারণী স্থিতিশীলতা, এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় সুশৃঙ্খলতা ছাড়া এই খাত বারবার মুখ থুবড়ে পড়বে। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এখন প্রয়োজন স্বল্পসুদে ঋণ। সময় মতো মূল্য পরিশোধের নিশ্চয়তা। মান নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি রফতানিতে শুল্ক সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি কাঁচা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানীতিকেন্দ্রিক নীতি। অন্যথায়, ঈদের সময় যেটি হওয়ার কথা ছিল অর্থনীতির এক রঙিন অধ্যায়, তা বছরের সবচেয়ে হতাশাজনক ও ক্ষতির খাত হয়ে উঠবে।

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
হাতিরঝিলে বিনোদনপ্রেমী মানুষের ভিড়
চট্টগ্রামে সড়ক-ফুটপাতে পড়ে আছে এক লাখের মতো চামড়া, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ
খাসি-ভেড়ার চামড়া প্রতি পিস ৫ টাকা
সর্বশেষ খবর
বিরোধ মীমাংসার পরই হামলা, গাইবান্ধায় ছাত্রদল-কৃষক দলের নেতাসহ আহত ৭
বিরোধ মীমাংসার পরই হামলা, গাইবান্ধায় ছাত্রদল-কৃষক দলের নেতাসহ আহত ৭
ভারতে অনুপ্রবেশকারীদের জন্য জাল পরিচয়পত্র তৈরির অভিযোগে আটক ১
ভারতে অনুপ্রবেশকারীদের জন্য জাল পরিচয়পত্র তৈরির অভিযোগে আটক ১
রোগীর সেলাই-ড্রেসিং করা সেই ওয়ার্ডবয় গ্রেফতার
রোগীর সেলাই-ড্রেসিং করা সেই ওয়ার্ডবয় গ্রেফতার
স্ত্রীর জানাজায় কাঁদলেন কাদের সিদ্দিকী
স্ত্রীর জানাজায় কাঁদলেন কাদের সিদ্দিকী
সর্বাধিক পঠিত
এবার ৪৪ জন আমলাকে অপসারণের দাবিতে পোস্টার
এবার ৪৪ জন আমলাকে অপসারণের দাবিতে পোস্টার
অবশেষে জুলাইয়ে চালু হচ্ছে ভূমি মালিকানা সনদ
অবশেষে জুলাইয়ে চালু হচ্ছে ভূমি মালিকানা সনদ
লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করতে চান টিউলিপ সিদ্দিক
লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করতে চান টিউলিপ সিদ্দিক
গরুর রান ছোট-বড় করা নিয়ে বাগবিতণ্ডা, বড় ভাইকে ‘পিটিয়ে হত্যা’
গরুর রান ছোট-বড় করা নিয়ে বাগবিতণ্ডা, বড় ভাইকে ‘পিটিয়ে হত্যা’
কমিটি গঠনের দুই দিনের মধ্যে এনসিপির দুই নেতার পদত্যাগ
কমিটি গঠনের দুই দিনের মধ্যে এনসিপির দুই নেতার পদত্যাগ