বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। অনেকেই বলছেন, সাঙ্গু থেকেও শেষের দিকে এভাবে গ্যাসের বদলে বালু উঠে এসেছিল। এরপর অকালেই সাঙ্গুকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। কেউ আবার বলছেন, অনেক সময় গ্যাস শেষ হওয়ার আগেও বালু আসতে পারে। তবে পরিস্থিতি যাই হোক, পেট্রোবাংলার উচিত শেভরনের কাছে এই ঘটনার কারিগরি ব্যাখ্যা চাওয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হুট করে বিবিয়না বন্ধ হলে দেশ বড় বিপদে পড়বে। বিবিয়ানাতেই তাই আরও অনুসন্ধানে জোর দিয়েছেন তারা।
দেশে এখন দিনে গ্যাসের উৎপাদন ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। দেশীয় গ্যাস উৎপাদন কোম্পানিগুলোর প্রায় ৭০টি কূপ রয়েছে। এই কূপগুলো দিয়ে দিনে ৮৬৫ মিলিয়ন ঘনফুট তোলা হচ্ছে। অন্যদিকে বিবিয়ানাতে ২৬টি কূপ দিয়ে তোলা হচ্ছে ১২০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
অর্থাৎ প্রতিটি কূপ দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ৪৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উঠছে। তবে যে ৬টি কূপ বন্ধ হয়েছিল সেগুলো দিয়ে দিনে ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তোলা হচ্ছে (প্রতিটি দিয়ে ৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট)।
পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর বলেন, শেভরন ছোট গ্যাসের লেয়ারগুলো হিসাব করেই মজুত দেখিয়েছিল। রিজার্ভ বেশি দেখিয়েছে। যত রিজার্ভ বলা হচ্ছে সে পরিমাণ তারা প্রুভেন রিজার্ভ উত্তোলন করতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, আরেকটা বিষয় হলো, তারা আসলে কত উত্তোলন করেছে তার হিসাবও দেয় না। যে ছয়টি কূপ সম্প্রতি বন্ধ হয়েছিল, সেটার উৎপাদন হার খেয়াল করতে হবে। যদি হার কমে তবে তা চিন্তার বিষয়।
সরব নয় পেট্রোবাংলা
হোসেন মনসুর বলেন, বিবিয়ানা হুট করে বন্ধ হলে আমরা সত্যিই বিপদে পড়বো। আমাদের পূর্ণমাত্রার এলএনজি আমদানির অবস্থা নেই। সুতরাং বিকল্প এখনই ভাবতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বহুজাতিক তেল গ্যাস কোম্পানির এ ধরনের কর্মকাণ্ডে খুব একটা সরব হতে পারে না পেট্রোবাংলা। নানাভাবে পেট্রোবাংলার সঙ্গেও মতভেদে জড়ায় তারা।
এর আগে বিবিয়ানাতে শেভরনের অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন নিয়ে পেট্রোবাংলা সরকারকে জানিয়েছিল। তবে সেটার কোনও সুরাহা হতে দেখা যায়নি।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, এর আগে শেভরনের অতিরিক্ত গ্যাস তোলার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হলে পেট্রোবাংলা থেকে আর কূপ খনন করার অনুমোদন দিতে চাওয়া হয়নি। এরপর শেভরন তৃতীয়পক্ষ থেকে ভেটিং করিয়ে এনে বলেছে এখানে অতিরিক্ত গ্যাসের মজুত আছে।
পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উৎপাদন বণ্টন চুক্তি পিএসসিতে বলা হয়েছে, কোনও বিষয়ে যদি পেট্রোবাংলা এবং অপারেটরের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয় তাহলে সে বিষয়ে তৃতীয়পক্ষের মতামত গ্রহণ করতে হবে।
সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা পেট্রোবাংলার জন্য সুখকর হিসেবে দেখা হয় না। জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে ব্রিটিশ তেল কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জি এটি থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু করে।
শুরুতে এটি থেকে দিনে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হয়। পরে তা বেড়ে দিনে ১৪০ থেকে ১৬০ মিলিয়ন ঘনফুট বা তার বেশি মাত্রায় পৌঁছায়।
উৎপাদন মাত্রা ২০০৯ সালে গড়ে দিনে ৪৯ মিলিয়ন ও ২০১১ সালে ১৮ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে যায়। ২০১৩ সালের শেষের দিকে এটি থেকে উৎপাদন দিনে দুই থেকে তিন মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এলে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
সাঙ্গুতে যখন মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলন হচ্ছিল তখনও দেশের বিশেষজ্ঞরা বার বার বলেছিলেন, অতিরিক্ত গ্যাস তোলার ফলে এটি অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে। পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি বিভাগ তখন ওই কথায় কান না দিয়ে উল্টো যুক্তি দিয়ে কেয়ার্ন এনার্জির কাজকে সমর্থন করেছিল।
বন্ধ হতে পারে যেকোনও সময়
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, এ ধরনের আশঙ্কা তো আছেই। বিবিয়ানা যে পরিমাণ গ্যাস উৎপাদন করছে তাতে যেকোনও সময় যেকোনও কূপ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। নানা কারণেই বন্ধ হতে পারে। পানি ওঠানোর কারণে, বালি আসার কারণেও বন্ধ হতে পারে। শুধু একটা কূপ বন্ধের আশঙ্কা করছি না। একসঙ্গে কয়েকটি কূপও বন্ধ হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, শেভরনের উচিত বিবিয়ানার মজুত দিয়ে আর কতদিন চলবে তা পরিষ্কার করে সরকারকে জানানো। যাতে সরকার প্রস্তুত হতে পারে।
‘সাধারণত কোনও গ্যাস ক্ষেত্রের গ্যাস কমে গেলে বালি উঠতে শুরু করে। আবার উত্তোলনের হার কমে গেলে কম্প্রেসর দিয়ে গ্যাস ওঠাতে গেলেও বালি আসতে পারে।’
প্রসঙ্গত, সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, বিবিয়ানা থেকে আর বড়জোর তিন থেকে চার বছর গ্যাস পাওয়া যাবে।
বালি ওঠার বিষয়ে তিনি বলেন, নানা কারণেই কূপ থেকে বালি উঠতে পারে। শেষ হলেই যে বালি উঠবে তা নয়। আবার বন্ধ হলেই যে কেবল বালি উঠবে তা-ও নয়। মাঝেও বালি উঠতে পারে। এটা নির্ভর করে উৎপাদনের হার, মজুতের পরিমাণ ইত্যাদির ওপর। বালি আসলে স্যান্ড প্রোডাকশন বন্ধ রেখেই গ্যাস উত্তোলনের প্রযুক্তি আছে। এজন্য প্রথমেই কোন কূপ থেকে বালি উঠছে এবং কোন জোন থেকে বালি আসছে তা চিহ্নিত করতে হবে। এ কাজ সময়সাপেক্ষ। ওয়ার্কওভার করতে হবে।
এ সময় সরকার কী করতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শেভরনে যেভাবে বিবিয়ানা থেকে গ্যাস তোলা হচ্ছে আমাদের কোনও গ্যাসক্ষেত্রে এই প্রযুক্তিতে গ্যাস তোলা হচ্ছে না। আমাদের ওই প্রযুক্তি বা দক্ষ জনবল নেই।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ বদরুল ইমাম বলেন, বালি যে উঠছে সে বিষয়ে সরকারের উচিত পরিষ্কার কারিগরি ব্যাখ্যা চাওয়া ও এ বিষয়ে সর্তক করা। কড়াভাবে পেট্রোবাংলার ধরা উচিত। কারণ বালি এলে গ্যাসক্ষেত্রের ক্ষতি হয়। বাখরাবাদসহ বেশ কিছু ক্ষেত্র বালির কারণেই নষ্ট হয়েছিল।
‘সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রের শেষদিকে বালি এসেছিল এটা যেমন ঠিক, তেমনি শেভরেনর কারিগরি ব্যাখ্যাটাও শোনা দরকার।’
শঙ্কা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হুট করে বিবিয়ানা বন্ধ হতে পারে কিনা, তা বলা কঠিন। তাদের কারিগরি বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এমন একটি হাই প্রোডাকশন ক্ষেত্রে এমন কিছু হলে তো সারাদেশ বিপদে পড়ে যাবে। এই ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার মনিটরিং জরুরি।’