X
বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
৩১ বৈশাখ ১৪৩২

নিলক্ষার টেঁটা যুদ্ধের নেপথ্যে!

আসাদুজ্জামান রিপন, নরসিংদী
১৮ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:৩৩আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:৪২

নরসিংদীতে দু’পক্ষের সংঘর্ষে টেঁটা ছুড়ে হামলা করা হয়

নরসিংদীর রায়পুরার চরাঞ্চলের একটি ইউনিয়ন নিলক্ষা। জেলা সদর থেকে নিলক্ষা ইউনিয়নের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় চাকরি ও ব্যবসা বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এলাকার অনেক মানুষ। অনেকটা এগিয়ে রয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রেও। তবে শিক্ষা বা সচ্ছলতা কোনও কিছুই কমাতে পারেনি যুগ যুগ ধরে এই এলাকার লোকজনের টেঁটা যুদ্ধ করার প্রবণতা।

স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ, টেঁটা যুদ্ধে হতাহতের ঘটনায় মামলা হলেও বিচার না হওয়ায় এবং স্থানীয় দাঙ্গাবাজদের কারণে বছরের পর বছর ধরে অশান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে নিলক্ষা ইউনিয়ন জুড়ে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শুধু নিলক্ষা ইউনিয়নেই এই টেঁটা যুদ্ধে মারা গেছে অন্তত অর্ধশত মানুষ।

অভিযোগ রয়েছে, টেঁটা যুদ্ধে হতাহতের ঘটনায় মামলা হলেও কোনও বিচার হয়নি। আদালতের পরিবর্তে সমাজপতিরা স্থানীয়ভাবে অর্থদণ্ড করেই আপোষ মীমাংসা করেছেন এসব খুনের। সর্বশেষ গত সোমবার (১৪ নভেম্বর) নিলক্ষা ইউনিয়নের দুই সাবেক ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে মারা গেছেন চারজন।

নিলক্ষার টেঁটা যুদ্ধের নেপথ্যে!

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই হানাহানিসহ টেঁটা যুদ্ধের মতো নৃশংস ঘটনা ঘটে। অর্থ ও ক্ষমতার দাপটে কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না এই জনপদে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘর্ষে প্রাণহানি, পঙ্গুত্ববরণ ও অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে অনেককে। এমব ঘটনার জের ধরে চলমান মামলা ও বিরোধ নিয়ে নতুন করে সৃষ্টি হয় জটিলতার। আর এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন সমাজপতির মুখোশধারী একটি শ্রেণি। বিবাদমান দলের মধ্যে সমঝোতার নামে তারা চালাচ্ছে বাণিজ্য।

স্থানীয়রা জানান, নিলক্ষা ইউনিয়নের ৭টি গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই ৮/১০টি করে টেঁটা আছে। তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই টেঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রতিপক্ষের ওপর। নতুন করে যুক্ত হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। প্রতিপক্ষকে হারাতে ঝগড়ার জন্য অনেক সময় আশপাশের চরাঞ্চলের ইউনিয়নগুলো থেকেও ভাড়াটিয়া হিসেবে নিয়ে আসা হয় লোকজন ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র।

জানা গেছে, কিছুদিন আগে হওয়া নিলক্ষা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হক সরকার। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন অপর প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম। এলাকার দাঙ্গাবাজ হিসেবে পরিচিত ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর লোকজন বিভক্ত হয়ে প্রচারণা চালান দুই প্রার্থীর পক্ষে।

নিলক্ষার টেঁটা যুদ্ধের নেপথ্যে!

তাজুল ইসলাম নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে নতুন মুখ হলেও আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন ও প্রভাব বিস্তারের কারণে জিতে যান নির্বাচনে। পরাজিত হন একাধিকবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান আব্দুল হক সরকার। নির্বাচনের প্রচারণাকালীনই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে। নির্বাচন শেষে ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা।  চলে পক্ষে বিপক্ষে সংঘর্ষ, লুটপাট, হত্যা, মামলা-পাল্টা হামলা। অনিচ্ছা সত্বেও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেককে জড়িয়ে পড়তে হয় এই টেঁটা যুদ্ধে। দাঙ্গাবাজদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এলাকার যারা এই যুদ্ধে শামিল হতে চাননি তাদের ওপরও চলে অত্যচার।

এ ব্যাপারে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে নিলক্ষা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান তাজুল ইসলামের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। তার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত বীরগাঁও গ্রামের ঠিকাদার ব্যবসায়ী রাজিব আহমেদ বলেন, ‘নিলক্ষা ইউনিয়নে ৮-১০ জন লোক আছে যাদের মূলত কোনও কাজ নেই।  তারাই মোটা অংকের টাকার লোভে ঝগড়া সৃষ্টিতে ইন্ধন যোগায়। ঝগড়া সৃষ্টি হলে তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মামলা চালানোর নামে চাঁদাবাজি শুরু করে। আর এতে তাদের পেট-পকেট সবই চলে। কেউ তাদের কথায় চাঁদা না দিলে তাদের ওপর অত্যচার করে। এসব কারণেই এখানকার সংঘর্ষ যুগযুগ ধরে জিইয়ে থাকছে। আর একেক সময় একেক ইস্যুতে হয় এ সংঘর্ষ। এখন যেমন চলছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে।’

নিলক্ষার টেঁটা যুদ্ধের নেপথ্যে!

বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হক সরকারের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। তার ঘনিষ্ঠভাজন হিসেবে পরিচিত সামাজিক সংগঠন নবজাগরণের সভাপতি আমিরাবাদ গ্রামের আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘এখানকার এক শ্রেণির গ্রাম্য অশিক্ষিত মাতব্বর ও জনপ্রতিনিধিরাই এসব সংঘর্ষের জন্য অনেকটা দায়ী। তারা নিজেদের স্বার্থে ও প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঝগড়া লাগিয়ে রাখেন। মূলত স্থানীয় মাতাব্বর ও জনপ্রতিনিধিদের হাতেই রয়েছে এখানকার টেঁটা যুদ্ধের চাবিকাঠি। চরাঞ্চলের টেঁটা যুদ্ধ সামাজিকভাবে প্রতিরোধ ছাড়া শুধু পুলিশ দ্বারা বন্ধ করা সম্ভব নয়।’

নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসিবুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মূলত সচেতনতা ও অনেকটা শিক্ষার অভাবেই এই এলাকার সাধারণ মানুষ প্রভাবশালীদের বলয় থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। প্রভাবশালীরা বংশ পরম্মপরায় এমনভাবে তাদের ব্রেইনওয়াশ করে রাখে যাতে করে সাধারণ মানুষ তাদের কথার বাইরে না যায়। এসব প্রভাবশালী মূল হোতারা তাদের স্বার্থে আড়ালে থেকে সুতা টানে। আর সাধারণ মানুষগুলো না বুঝে পুতুল নাচের মতো সংঘর্ষে জড়ায়। তারা সংঘর্ষে জড়ানোটাকে নিজেদের অস্তিত্ব আর ঐতিহ্য মনে করে। আমরা সাধারণ মানুষকে মোটিভেটেড করার চেষ্টা করছি।’

গ্রাম্য সংঘর্ষ নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধেও বাণিজ্যের অভিযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশ বাণিজ্যের স্বার্থে সংঘর্ষের মামলা জিইয়ে রাখে এই অভিযোগ ঠিক না। বর্তমান সময়টাতে পুলিশ এসব বিষয়ে ছাড় দিচ্ছে না। তবে অতীতের একটা সময় হয়তো চরাঞ্চলের কিছু দালাল মামলাবাজের সঙ্গে কতিপয় পুলিশের সখ্যতা ছিল। সারাদেশের চরাঞ্চলেই কমবেশি এমনটা থাকে। তবে এখন এখানে সেরকম অবস্থা আর নেই।’

/এফএস/এসটি/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইশরাককে মেয়র পদে শপথ করানোর দাবিতে নগরভবনের সামনে বিক্ষোভ
ইশরাককে মেয়র পদে শপথ করানোর দাবিতে নগরভবনের সামনে বিক্ষোভ
চট্টগ্রামে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস
চট্টগ্রামে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস
ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য হত্যার ঘটনায় আটক ৩, থামায় মামলা
ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য হত্যার ঘটনায় আটক ৩, থামায় মামলা
ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে সারা দেশে ছাত্রদলের কর্মসূচি 
ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে সারা দেশে ছাত্রদলের কর্মসূচি 
সর্বাধিক পঠিত
বিমানবন্দরে তিন উপদেষ্টা, জেরার মুখে দায়িত্বরতরা
সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগবিমানবন্দরে তিন উপদেষ্টা, জেরার মুখে দায়িত্বরতরা
হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল ইতিহাসে এটাই প্রথম: প্রধান বিচারপতি
হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল ইতিহাসে এটাই প্রথম: প্রধান বিচারপতি
বাড়লো স্বর্ণের দাম, বুধবার থেকে কার্যকর
বাড়লো স্বর্ণের দাম, বুধবার থেকে কার্যকর
রাতে চিয়া বীজ খেলে এই ৬ উপকার পাবেন
রাতে চিয়া বীজ খেলে এই ৬ উপকার পাবেন
সোনালী ব্যাংকের নিজস্ব পেমেন্ট সুইচ চালু
সোনালী ব্যাংকের নিজস্ব পেমেন্ট সুইচ চালু