X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

নাসিরপুরের ‘অপারেশন হিটব্যাক’ মামলার এজাহারে যা আছে

সাইফুল ইসলাম, মৌলভীবাজার
১৬ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:০৭আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:০৯

নাসিরপুরে জঙ্গি আস্তানা (ফাইল ছবি) মৌলভীবাজার পৌর এলাকার নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানায় পরিচালিত ‘অপারেশন হিটব্যাকে’র ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারের একটি কপি বাংলা ট্রিবিউনের হাতে এসেছে। ওই জঙ্গি আস্তানায় আত্মঘাতী বিস্ফোরণে দুই শিশুসহ একই পরিবারের সাত জন নিহত হয়। এ ঘটনায় গত ১ এপ্রিল মৌলভীবাজার মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শহীদুল ইসলাম মামলা দায়ের করেন।

মামলার এজহারে বলা হয়েছে, মৌলভীবাজার পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের বড়হাট এলাকার লন্ডন প্রবাসী জনৈক সাইফুল ইসলামের মালিকানাধীন বাড়িতে কয়েকজন জঙ্গির অবস্থান সম্পর্কে গোপন খবর পায় পুলিশ। এ খবর পেয়ে গত ২৮ মার্চ দিবাগত রাত আনুমানিক ৩টায় মৌলভীবাজার জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহ্জালালের নেতৃত্বে মৌলভীবাজার জেলাসহ সিলেট রেঞ্জের বিভিন্ন ইউনিট ও এপিবিএন অফিসার ও ফোর্সসহ বাড়িটি ঘিরে ফেলা হয়।

নাসিরপুরে জঙ্গি আস্তানা (ফাইল ছবি) নাসিরপুরের আস্তানার প্রসঙ্গ টেনে এজাহারে বলা হয়, ভোর ৫টা ২৫ মিনিটের সময় বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, একই থানার খলিলপুর ইউনিয়নের নাসিরপুর গ্রামে একই ব্যক্তির মালিকাধীন বাড়ির একতলা টিনশেড বিল্ডিংয়ে আরও জঙ্গি অবস্থান করছে। ওই খবরে ভিত্তিতে ভোর ৬টায় ওই বাড়িও ঘিরে ফেলা হয়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে বাড়িতে অবস্থানকারী জঙ্গিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে পরপর কয়েকটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে ও কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা এসময় আত্মরক্ষায় গুলি ছুঁড়তে বাধ্য হয়।

এজাহারে এসআই শহীদুল লিখেছেন, এ ঘটনা পুলিশ সুপার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে সেখানে আরও প্রায় একশ পুলিশ অফিসার ও ফোর্স পাঠানো হয় এবং বাড়িটির ঘেরাও জোরদার করা হয়। পরে সাম্প্রতিক জঙ্গি আস্তানাগুলোর অভিজ্ঞতা বিবেচনায় ওই বাড়িতে অভিযান চালাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সহযোগিতা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ২৯ মার্চ বিকাল ৪টায় সিটিটিসি’র প্রধান ডিআইজি মো. মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে ডিসি (এসএজি) প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, ডিসি (টিসি) মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খাঁন, ডিসি (টিসি) এ এইচ এম আব্দুর রকিবসহ সোয়াট ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন।

অপারেশন হিটব্যাকের ঘটনাপ্রবাহ প্রসঙ্গে এজাহারে বলা হয়, ২৯ মার্চ বিকালে সোয়াট টিম জঙ্গি আস্তানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাইকের মাধ্যমে বাড়ির ভেতরের জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। জঙ্গিরা আহ্বানে সাড়া না দিয়ে সোয়াট টিমের অবস্থান লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলি ছুঁড়তে থাকে। সোয়াট সদস্যরাও আত্মরক্ষায় পাল্টা গুলি চালায়। ওই বাড়িতে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও গোলাবারুদ থাকতে পারে সন্দেহে এবং রাত হয়ে যাওয়ায় সন্ধ্যা ৭টায় সোয়াটের অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয় এবং পরদিন ৩০ মার্চ সকাল ৮টায় ফের অভিযান শুরু করা হয়।

অভিযানে আত্মঘাতী হামলার ঘটনা উল্লেখ করে এজাহারে এসআই শহীদুল লিখেছেন, ‘অভিযানের এক পর্যায়ে জঙ্গিরা বাড়ির ভেতরে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায়। পরে বিকালে দীর্ঘ সময় ধরে বাড়ির ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে সোয়াট টিমের সঙ্গে আমি জঙ্গি অবস্থানকারী ঘরে প্রবেশ করি। এসময় ঘরের ভেতরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, ঘরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নারী, পুরুষ ও শিশুসহ সাত জনের ছিন্নভিন্ন মরদেহ ও বিপুল পরিমাণ আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) দেখতে পাই। প্রাথমিকভাবে ধারণা করি, আত্মঘাতী বোমার আঘাতে জঙ্গি ও শিশুদের মৃত্যু হয়েছে। পরে এডিসি (ডিএমপি) মো. রহমত উল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে প্রবেশ করে বেশ কয়েকটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করেন। এরপর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. আব্দুস সালামের নেতৃত্বে গোয়েন্দা বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করে মৃতদেহের রক্তের সোয়াব, আঙুলের ছাপ ও ছবি এবং অন্যান্য বস্তগত আলামত সংগ্রহ করেন।’

এজাহারে এসআই শহীদুল লিখেন, ‘সিআইডি’র ক্রাইম সিন দল ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন আলামত এসআই আব্দুল মালিকের কাছে হস্তান্তর করলে সেগুলো ৩০ মার্চ রাত ৮টা ৫ মিনিটে জব্দ করা হয়। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মিন্টু চৌধুরীর (বর্তমান জুড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা) উপস্থিতিতে আমি ও এসআই আব্দুল মালিক নারী, পুরুষ ও শিশুসহ মোট সাত জনের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহের সুরতহাল প্রস্তুত করে ময়নাতদন্তের জন্য মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠাই।’

এজাহারে উল্লেখ আলামতের মধ্যে রয়েছে— ভেঙে যাওয়া ম্যাগজিন সংযুক্ত একটি পিস্তল (গায়ে খোদাই করে লেখা MADE USA 9M), মোট ১২৫টি বিস্ফোরিত বোমার ধাতব বল ও স্প্লিন্টার, ১০টি গ্যাস গানের খোসা, ২৯৫টি বুলেটের খোসা, ২৫ টুকরা জানালার থাই গ্লাসের ভাঙ্গা টুকরা, একটি স্টিলের পিনযুক্ত গোলাকার লেদারের অংশ, কটন বাডের মাধ্যমে সংগ্রহ করা সাত জনের সোয়াব, প্রাপ্তবয়স্ক তিন নারী-পুরুষের আঙুলের ছাপ।

এজাহারে বলা হয়েছে, প্রাথমিক অনুসন্ধানে নিহত জঙ্গি ও শিশুদের পরিচয় পাওয়া যায়নি এবং কেউ তাদের শনাক্ত করেনি। তবে অপরাধের ধরণ পর্যালোচনা করে তাদের নিষিদ্ধঘোষিত জেএমবি বা নব্য জেএমবির নেতাকর্মী ও সমর্থক বলে ধারণা করা হয়।

নিহত জঙ্গি ও সহযোগী অজ্ঞাতনামা জঙ্গিরা দেশের অখণ্ডতা, সংহতি, সার্বভৌমত্ব ও জননিরাপত্তা বিপন্ন ও জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক তৈরির উদ্দেশ্যে নাসিরনগরের আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় এজাহারে। এতে আরও বলা হয়, জঙ্গি ও তাদের সহযোগীরা বিস্ফোরক দ্রব্য ও আগ্নেয়াস্ত্র মজুত ও ব্যবহার করে ঘটনাস্থলে আত্মঘাতী হয়ে ও শিশুদের হত্যা করার মাধ্যমে সন্ত্রাসবিরোধী আইন/ ২০০৯ (সংশোধনী-২০১৩)-এর ৬(২)৭/৮/৯/১০/১২/১৩ ধারার অপরাধ করেছে। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে একই আইনের একই ধারায় নিয়মিত মামলা রুজু করে প্রয়োজনীয় তদন্তের ব্যবস্থার আবেদন করা হয় এজাহারে।

এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অকিল উদ্দিন ১ এপ্রিল ওই মামলা (মামলা নং ১) গ্রহণ করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার প্রধান তদন্তকারী কর্মকর্তা মৌলভীবাজার সিআইডি’র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুস ছালেক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মৌলভীবাজার দুইটি জঙ্গি আস্তানার বাড়ির মালিক একই। মামলার অধিকতর তদন্তের স্বার্থে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে দেরি হচ্ছে। এ ঘটনার সঙ্গে আর কারও জঙ্গি কানেকশন আছে কিনা অথবা সিলেটের আতিয়া মহলে জঙ্গিদের সাথে তাদের কোনও মিল আছে না— তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ তদন্তে স্বার্থে সব তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, ২৮ মার্চ দিবাগত রাত থেকে বড়হাট ও নাসিরপুরের দুইটি জঙ্গি আস্তানা ঘিরে রাখে পুলিশ ও র‌্যাব। ওই দুই আস্তানার আশপাশের দুই কিলোমিটার জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। এর মধ্যে নাসিরপুরে সোয়াট টিমের প্রধান মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে ‘অপারেশন হিটব্যাক’ পরিচালনা করা হয়। অপারেশন চলাকালে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণে শিশুসহ সাত জন নিহত হয়।

এদিকে, নাসিরপুরে অপারেশন হিটব্যাক চলাকালে মৌলভীবাজার পৌরসভার বড়হাট জঙ্গি আস্তানা ঘিরে রাখে পুলিশ ও র‌্যাব। পরে বড়হাটের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নামে সোয়াট টিম। অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’। এতে নিহত হয় নারীসহ তিন জঙ্গি।

আরও পড়ুন:
‘১২ জনের মতো জঙ্গি রয়েছে মৌলভীবাজারের দুই আস্তানায়’

মৌলভীবাজারে পুলিশ পাহারায় থাকা দুই ‘জঙ্গি বাড়ি’ হস্তান্তর

 

/টিআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চীনের দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক ধসে নিহত ৩৬
চীনের দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক ধসে নিহত ৩৬
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের
রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের
কেনিয়ায় বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৮১
কেনিয়ায় বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৮১
সর্বাধিক পঠিত
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!