X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

ধান চাষে বিঘাপ্রতি কৃষকের লোকসান ৬ হাজার টাকা!

এনায়েত করিম বিজয়, টাঙ্গাইল
১৭ মে ২০১৯, ১৩:১১আপডেট : ১৭ মে ২০১৯, ১৭:০৪

ধানের বাম্পার ফলন হলেও এবার লোকসান গুনছেন চাষিরা এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে ইরি-বোরো আবাদে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টাকা করে ঘাটতি হচ্ছে বলে দাবি করেছেন টাঙ্গাইলের কৃষকরা। এতে তারা ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। শ্রমিক সংকট, শ্রমিকের মজুরি বেশি এবং ধানের দাম কম থাকায় টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকের পাকা ইরি-বোরো ধান এখনও জমিতেই পড়ে রয়েছে। সব মিলিয়ে কৃষকরা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

কম দাম ও শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটতে না পারার হতাশা থেকে জেলার কালিহাতী উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়নের বানকিনা এলাকার আব্দুল মালেক ও বাসাইল উপজেলার কাশিল গ্রামের নজরুল ইসলাম খান সম্প্রতি তাদের নিজের পাকা ধানক্ষেতে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ জানান। জেলার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় কৃষকরা ধানের কম দাম নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে মানববন্ধন, রাস্তায় ধান ছড়িয়ে প্রতিবাদসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ইরি-বোরো চাষে এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমি প্রস্তুত করতে অন্তত তিনজন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। ওই সময় শ্রমিকের মজুরি থাকে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা করে। শ্রমিকের খাবারসহ দুই হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়। ট্রাক্টর বাবদ খরচ হয় প্রায় ৮শ’ থেকে এক হাজার টাকা। বীজ ও বীজতলা প্রস্তুত করতে শ্রমিকের মূল্যসহ এক হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়। ধানের চারা রোপণ করতে তিনজন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এই তিনজন শ্রমিকের খাবারসহ দুই হাজার থেকে ২২শ' টাকা খরচ হয়। এরপর ধানক্ষেত থেকে ঘাস পরিষ্কার (নিরানি) করতে অন্তত দুইজন শ্রমিক লাগে। এই দুইজন শ্রমিকের খাবারসহ ১৫শ’ টাকার মতো খরচ হয়ে থাকে। ধান কাটতে আবার অন্তত চারজন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। ধান কাটা শ্রমিকের মজুরি এই সময়ে প্রতিজন ৮শ’ থেকে ৯শ’ টাকা পর্যন্ত থাকে। এই চারজন শ্রমিকের খাবারসহ চার হাজার টাকার ওপরে খরচ হয় দিনে। অপরদিকে সার বাবদ ১৫শ' থেকে ১৮শ' টাকা খরচ হয়। সব মিলিয়ে বীজতলা প্রস্তুতসহ কৃষকের সোনালি ধান গোলায় তুলতে অন্তত ১৪ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। আর এই ১৪ জন শ্রমিকের খাবারসহ সব মিলিয়ে কৃষকের খরচ হচ্ছে অন্তত সাড়ে ১৩ হাজার টাকার মতো।

এদিকে ওই এক বিঘা (৩৩ শতাংশ ) জমিতে ধান হচ্ছে ১০ থেকে ১৩ মণ। ধানের বর্তমান মূল্য ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা করে। ৫৫০ টাকা হিসেবে ১৩ মণ ধানের মূল্য সাত হাজার ১৫০ টাকা। ১৩ হাজার টাকা খরচ হলে এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে কৃষকের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার টাকা করে লোকসান হচ্ছে।

ধান ফলিয়ে এবার লোকসান গুনছেন চাষিরা

বাসাইল উপজেলার কলিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ বলেন, ‘আমি প্রায় ৫ বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছি। এক বিঘা জমিতে ট্রাক্টর, শ্রমিক ও সারের খরচ বাবদ প্রায় ১৩ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এক বিঘা জমিতে ১০ থেকে ১৩ মণ পর্যন্ত ধান হয়। এবার ধানের দাম কম। তাই আমার প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় ৬ হাজার টাকা করে লোকসান হবে।’

ধানক্ষেতে আগুন দেওয়া বাসাইলের কৃষক নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘ধান কাটা শ্রমিকের মজুরি প্রায় এক হাজার টাকা। তারপরও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে ৫শ’ টাকা করে। এছাড়াও ধানক্ষেতে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে শীষ চিটা হয়ে শুকিয়ে গেছে। ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়া প্রায় ৫৬ শতাংশের ধান কেটেছি। এই ৫৬ শতাংশ জমিতে মাত্র চার মণ ধান হয়েছে। ৫৬ শতাংশ জমিতে আমার প্রায় ২৫ হাজার টাকার লোকসান হয়েছে। তাই দিশেহারা হয়ে ২০ শতাংশ পাকা ধানক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দেই। পরে স্থানীয়রা এসে আগুন নিভিয়ে ফেলে। আমি এবার ১২ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছি। এরমধ্যে আট বিঘা জমির ধান ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে চিটা হয়েছে। এবার আমার বোরো আবাদে অনেক টাকা লোকসান হবে।’ ধানের বাম্পার ফলন হলেও এবার লোকসান গুনছেন চাষিরা

কৃষক শ্রীবাস মণ্ডল বলেন, ‘গত বছর যমুনা সার ধানক্ষেতে ব্যবহার করতাম। তখন ফলন ভালো হতো। এখন যমুনা সার বাজারে পাওয়া যায় না। এই সারের দাম বর্তমান সারের চেয়ে অনেক কম ছিল। এবার চায়না, সৌদি, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়ার সার বাজারে এসেছে। এসব সার ধানক্ষেতে ব্যবহার করার কারণে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।’

ধানক্ষেতে আগুন দেওয়া কালিহাতির কৃষক আব্দুল মালেক বলেন, ‘ধান কাটতে শ্রমিককে দিতে হচ্ছে প্রায় এক হাজার টাকা। তারপরও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। ধান কেটে বাড়িতে আনতে এক মণ ধানের পেছনে প্রায় এক হাজার টাকা করে খরচ হচ্ছে। ধান বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে ৫শ’ টাকা করে। প্রতিমণে ঘাটতি পড়ছে ৫শ’ টাকা করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষেতে ধান পাকলেও তা ঘরে তুলতে পারছিলাম না। তাই দিশেহারা হয়ে এক দাগের ৫৬ শতাংশ জমির ধানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম। পরে এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসে ধান কেটে দিয়েছে।’ ধানক্ষেত

একাধিক কৃষক জানান, বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ায় শ্রমিকের মজুরিও বেড়ে গেছে। তারা শ্রমিকের বিকল্প হিসেবে ধান কাটা ও মাড়াই যন্ত্র প্রতিটি এলাকায় দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। সরকার প্রতিবছর কৃষকদের কাছ থেকে ধান নেওয়ার জন্য বললেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্থানীয় দালালের মাধ্যমে ধান গোডাউনে তুলছেন। এর ফলে কৃষকরা সরকারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা সরকারকে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ ও কৃষকদের প্রতি সুদৃষ্টি দেওয়ার অনুরোধ জানান।

একাধিক সার ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, গত বছর যমুনা সার বাজারে ছিল। তখন কৃষকের ধানের ফলন ভালো হতো। কিন্তু এবার বাজারে কয়েকটি দেশের সার আসায় ফলন কম হচ্ছে। এই সারের দামও অনেক বেশি।

টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘এখন শ্রমিকের মজুরি বেশি। আর বাজারে ধান মণপ্রতি ৫শ’ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এই সময়ে ধানের বাজার কিছুটা কম থাকলেও কৃষক যদি ধান সংরক্ষণ করে রাখেন তবে ক’দিন পরেই অধিক মূল্য পাবেন।’ এবার জেলার  ১২টি উপজেলায় ১ লাখ ৭১ হাজার ৭০২ হেক্টর জমিতে ধান আবাদ হয়েছে বলেও তিনি জানান।

আরও পড়ুন- 

পাকা ধানে আগুন দিয়ে আরেক কৃষকের প্রতিবাদ


ক্ষেতে আগুন দেওয়া সেই কৃষকের ধান কেটে দিলেন শিক্ষার্থীরা

/এফএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সবজির কেজি এখনও ৬০ টাকার বেশি, ২০০ ছাড়িয়েছে ব্রয়লার
সবজির কেজি এখনও ৬০ টাকার বেশি, ২০০ ছাড়িয়েছে ব্রয়লার
পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে বাস দুর্ঘটনায় নিহত অন্তত ২০
পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে বাস দুর্ঘটনায় নিহত অন্তত ২০
মুক্তির পর থেকেই মামুনুল হককে ঘিরে অনুসারীদের ভিড়
মুক্তির পর থেকেই মামুনুল হককে ঘিরে অনুসারীদের ভিড়
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
সর্বাধিক পঠিত
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
ব্যর্থতার অভিযোগে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে আইনি নোটিশ
ব্যর্থতার অভিযোগে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে আইনি নোটিশ