X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১
একান্ত সাক্ষাৎকারে শরণার্থী কমিশনার মাহবুব তালুকদার

রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনে সরকারের চেষ্টা অব্যাহত আছে

আবদুল আজিজ, কক্সবাজার
২৫ আগস্ট ২০২০, ১১:০০আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২০, ১১:৩৪

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহবুব আলম তালুকদার।

মিয়ানমারের রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আগমনের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। এই দীর্ঘ তিন বছর ধরে বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ সরকার নানা সুযোগ সুবিধা দিয়ে আসছে। মানবিক আশ্রয়ে থাকা এসব রোহিঙ্গা যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে স্বদেশে ফিরতে পারে সেজন্য আন্তর্জাতিকভাবে কূটনৈতিক তৎপরতাসহ নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। দীর্ঘ সময় ধরে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার পাশাপাশি খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় নিরলসভাবে কাজ করছে সরকার। এসব বিষয় নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহবুব আলম তালুকদার।

মাহবুব আলম তালুকদার বলেছেন, ‘সরকার মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সাল রোহিঙ্গা আগমনের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। এই তিন বছর ধরে রোহিঙ্গাদের কীভাবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়, সে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে আসছে সরকার। যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা যায় সে ব্যাপারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে দাবি জানিয়ে এসেছেন এবং আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তার সরকার এখনও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য সব ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এখনও আমরা জরুরি অবস্থার মধ্যে আছি। স্বাভাবিক পরিস্থিতি এখনও শুরু হয়নি। করোনা মোকাবিলায় আমরা সকলের সহযোগিতায় অনেকটা সফলতা অর্জন করেছি। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা জনবহুল এলাকায় এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৬ জনে সীমিত। এছাড়া করোনার নমুনা সংগ্রহ ও পিসিআর রিপোর্টে দেখা গেছে নমুনা ও পজিটিভের অনুপাত এখন ৩ দশমিক ১। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে করোনার প্রকোপ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখনও অনেক কম। এরপরও ক্যাম্পগুলোতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে এ বছর গণহত্যার কারণে এদেশে পালিয়ে আসার দিনটি স্মরণে রোহিঙ্গাদের কোনও ধরনের সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সব ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যাতে কোনও রোহিঙ্গা জমায়েত হতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন ভবন

করোনাকালীন সময়েও সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমার ও আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে উল্লেখ করে মাহবুব আলম তালুকদার আরও বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় পুরো পৃথিবীর মানুষ স্তব্ধ। এ কারণে বিশ্বনেতারা নিজ নিজ দেশ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তবে এরমধ্যেও রোহিঙ্গাদের বিষয়টি মনোযোগ হারিয়েছে এ কথা বলা যাবে না। তারা রোহিঙ্গা ইস্যুটি ভুলে গেছেন তা নয়। সময় হলেই একটি রেজাল্ট আমরা অবশ্যই পাবো।’

মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সরকার কোনোভাবে জোর করে কোনও রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত দিতে রাজি নয়। এটি নির্ভর করবে রোহিঙ্গা এবং মিয়ানমারের সদিচ্ছার ওপর। রোহিঙ্গারা যদি মনে করেন মিয়ানমারে এখনই নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তখন সরকার নিরাপদভাবে তাদের প্রত্যাবাসন করবে। এছাড়া প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক আলোচনার বিষয় জড়িয়ে রয়েছে।’

মাহবুব আলম তালুকদার আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমনের পর থেকে বর্তমান সরকার দীর্ঘ তিন বছর ধরে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নিয়ে আসছে। যেমন একজন মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবকিছুর সুবিধা নিয়ে আসছে। স্যানিটেশন, খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে রোহিঙ্গাদের জন্য সবকিছু করে যাচ্ছে।’

রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে সহযোগিতা আগের মতো এখনও অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শুধু আন্তর্জাতিক মহল নয়, দেশি-বিদেশি শতাধিক এনজিও রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে এখন কাজ করে যাচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কোনও ধরনের সংকট নেই। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে  আগের মতোই স্বাভাবিকভাবে যাবতীয় কার্যক্রম চলছে।’

মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, এপিবিএন, আনসারসহ অনেক এজেন্সি কাজ করছে। এতে করে পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্পের বাইরে যেতে না পারে, রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টি হয়ে যাতে সহিংসতায় জড়িত হয়ে না পড়ে সেসব দিক দেখভাল করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।’

তার দাবি, ‘এক কথায় খুব শান্তি শৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গারা।’

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে এনজিওদের কোনও ধরনের ভূমিকা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এনজিওদের কাজ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের সাপোর্টিং এজেন্সির ভূমিকায় থাকা। এখানে বেশির ভাগ এনজিও ইউএন অর্গানাইজেশনের পার্টনার এজেন্সি। সুতরাং এনজিওদের আলাদাভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। এনজিওদের কাজ হচ্ছে সরকারের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করা।’

এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যা ও নানা নির্যাতনের অভিযোগ এনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলার রায় রোহিঙ্গাদের মনোবল আরও বৃদ্ধি করেছে। যার ফলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে যাওয়ার ব্যাপারে আগে যে ভীতি কাজ করতো সেটি অনেকাংশে কমে আসছে।’

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো একত্রে করার কোনও চিন্তাভাবনা নেই উল্লেখ করে মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো এখন যে অবস্থায় রয়েছে আপাতত সেই অবস্থায় থাকবে। কারণ, আমরা তাদের অস্থায়ীভাবে থাকার জায়গা দিয়েছি। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্প, দাতাসংস্থার বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ক্যাম্পগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে ১৯০০ বেডের আইসোলেশন সেন্টার প্রস্তুত রয়েছে। কাজেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো আপাতত যে অবস্থায় রয়েছে সে অবস্থায় থাকায় নিরাপদ।’

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো বিচার বিশ্লেষণ করা কঠিন উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যেভাবে সুবিধা পাচ্ছে, ঠিক ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীরা সমান সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছে। যেমন করোনাকালীন সময়ে কক্সবাজারে যে দুইটি পিসিআর মেশিন বসানো হয়েছে এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রোগ নির্ণয়ের যে সুফল পাচ্ছেন তারা সব কিছু সম্ভব হয়েছে রোহিঙ্গাদের কারণে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (ডব্লিউএফপি) মাধ্যমে এই পিসিআর মেশিন দুটো স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। এটি কিন্তু, কক্সবাজারবাসীর জন্য বিশাল প্রাপ্তি। এছাড়া ইউএন অর্গানাইজেশনের কাছে আমাদের সব সময় দাবি রয়েছে রোহিঙ্গারা যেসব সুবিধা পাবে, ঠিক স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। এলপিজি সুবিধা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবাসহ নানা সুযোগ সুবিধা বর্তমানে স্থানীয়রাও পাচ্ছেন।’

উল্লেখ্য, গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সে দেশের সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী মগদের রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণসহ নানা বর্বর নির্যাতন করে বিতাড়িত করে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অস্ত্রের মুখে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ১১ লাখ ১৮ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় ১০ হাজার একর বনভূমির ওপর অস্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন। দীর্ঘ তিন বছর ধরে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন না হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার এসব রোহিঙ্গাকে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা দিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার পাশাপাশি কাজ করছে দেশীয় বিভিন্ন এনজিও। তবে যত দ্রুত সম্ভব এসব রোহিঙ্গাকে যে কোনও উপায়ে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা জরুরি হয়ে পড়েছে এমনটাই ভাবছে বাংলাদেশ সরকার।

/টিএন/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
সর্বাধিক পঠিত
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ