অনাবৃষ্টির আকাশ থেকে ঝরছে খরতাপ। খরায় পুড়ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। দুর্যোগপ্রবণ এ অঞ্চলের মানুষ মধ্যচৈত্রে বারবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছে। চৈত্রের আগুন হাওয়া থেকে বৃষ্টির প্রতীক্ষায় প্রকৃতি। কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই। আর এই বৃষ্টিহীনতায় খরার বিরূপ প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে তরমুজের উপর। সুন্দরবন সংলগ্ন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় উৎপাদিত রসালো ফল তরমুজের সুনাম জেলা উপজেলার বাইরে রয়েছে। উপজেলার ধূমঘাট গ্রাম ও কৈখালী ইউনিয়নের উৎপাদিত তরমুজের স্বাদ সবার অজানা নয়। বাজারে ক্রেতাদের মুখে শোনা যায়, ধূমঘাট ও কৈখালীর তরমুজের গুণকীর্তনের কথা। সুস্বাদু রসালো ফল তরমুজ এবার খরায় স্বাদ ও সাইজে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। খরার কারণে তরমুজ চাষিরা এবার উৎপাদন খরচ উঠবে কিনা তা নিয়ে চিন্তায় আছেন।
উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আলী হাসান জানান, উপজেলায় চলতি মৌসুমে প্রায় এক হাজার ২০০ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তরমুজ চাষ হয়েছে উপজেলার কৈখালী ইউপিতে। এছাড়া ঈশ্বরীপুর ইউপির ধূমঘাট, কাশিমাড়ী, মুন্সীগঞ্জে তরমুজ চাষ হয়ে থাকে। কৈখালী ইউপির বোশখালী, পশ্চিম কৈখালীতে বেশি তরমুজ চাষ হয়েছে এবার।
তরমুজ চাষি কৈখালী ইউপির আলমগীর হোসেন বলেন, ‘তিনি নিজে এক হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। কিন্তু এ বছর প্রচণ্ড খরার কারণে তরমুজের সাইজ ছোট হয়ে যাচ্ছে এবং তরমুজ বাঁকা হয়ে যাচ্ছে নিচের দিকে।’ তরমুজ চাষি হাফিজুর রহমান বলেন, ‘খরার কারণে তরমুজে ভাইরাস লেগেছে। এর ফলে তরমুজের ভেতরে গাড় লাল রঙ হচ্ছে না এবং মিষ্টি কম হচ্ছে।’
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোদাচ্ছের বিল্লাহ বলেন, ‘উপজেলায় গতবার তরমুজ চাষ হয়েছিল মাত্র ৫০ হেক্টর এবং উৎপাদন ছিল ৩০ মে. টন। গতবার চাষিরা ভালো ফলন ও দাম পাওয়ায় এবার তিনগুণ জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। বর্তমানে বাজারে তরমুজ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে।’
উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা জিয়াউল হক জিয়া বলেন, ‘অন্যান্য বছর শ্যামনগরে বৃষ্টির কারণে তরমুজের ওজন ছিল ১০ থেকে ১২ কেজি। এবার বৃষ্টির অভাবে তরমুজের ওজন হয়েছে ৪ থেকে ৫ কেজি। বৃষ্টি না হওয়ায় এবার তরমুজ বড় হওয়ার সম্ভাবনা নেই, শুকিয়ে যাচ্ছে তরমুজ ক্ষেত। প্রকৃতিনির্ভর বৃষ্টির উপর ভরসা করে উপজেলার শ্যামনগর ইউপি, কৈখালী, কাশিমাড়ী, মুন্সিগঞ্জসহ অন্যান্য এলাকায় চাষিরা শত শত বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। কিন্তু শ্যামনগরে ভূগর্ভস্থ পানি না পাওয়ায় চাষিরা নিজস্ব পুকুর বা জলাশয়ের পানির উপর নির্ভর করে তরমুজসহ অন্যান্য ফসল চাষ করে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে সেটিও শেষ হওয়ায় এখন চাষিদের অপেক্ষা এক পশলা বৃষ্টি।’ তিনি বিভিন্ন এলাকায় ফসল চাষের সুবিধার্থে মিষ্টি পানি সংরক্ষণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পুকুর খননের দাবি জানান।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ এসএম এনামুল ইসলাম বলেন, ‘পানি সংকটের কারণে শ্যামনগরে তরমুজের সাইজ ছোট হচ্ছে, বাঁকা হচ্ছে। আবার কোথাও পোকার আক্রমণ দেখা যাচ্ছে।’ তিনি সরেজমিন কৈখালী ইউনিয়নের কয়েকটি তরমুজ চাষির ক্ষেত পরিদর্শন করেছেন। তরমুজ ফসলের ক্ষেতে পানি সংকটের অভাব মেটাতে সন্ধ্যার পর পানি স্প্রে করতে চাষিদের পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান। এছাড়া পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে রাসায়নিক কীটনাশক স্প্রে এবং মাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মাকড়নাশক থিওভিট সঠিক মাত্রায় স্প্রে করার পরামর্শ দিয়েছেন চাষিদের।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘বৃষ্টির পানিতে ভিটামিন, বিশেষ করে, নাইট্রোজেন থাকে। বৃষ্টি না হওয়ার কারণে এবার তরমুজের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ জানা যায়, এই উপজেলায় উচ্চ ফলন জাত ভারতের ভিফটপ, ড্রাগন, পাকিজা, বাংলালিংকসহ অন্যান্য জাতের তরমুজ চাষ হয়ে থাকে।
শ্যামনগর তরমুজ চাষিসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদনকারীরা জানান, ক্ষেতে একটু বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে উৎপাদনের মাত্রা বেড়ে যেতো। সঙ্গে তরমুজের স্বাদও বেড়ে যেতো। এসব কারণে তরমুজ চাষিদের অপেক্ষা বৃষ্টির।
উপজেলা কৃষি অফিসার এসএম এনামুল ইসলাম ও চাষিরা জানান, উপজেলার বিভিন্ন ইউপির খালগুলোতে মিষ্টি পানি সংরক্ষণ করা গেলে তা খরা মোকাবিলা করে ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।