জমির মূল্য পরিশোধের পর নিরুপায় ক্রেতাকে বৈধ-অবৈধ দু’খাতে টাকা দিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করতে হয়। সরকারি ফি ব্যাংকে জমা দিয়ে দলিল সম্পাদনকালে দিতে হয় ‘অফিস খরচ’। আর কথিত ওই অফিস খরচই হলো সাবরেজিস্ট্রারের নির্ধারণ করা ঘুষ। সরকারি ফি পরিশোধের পর ওই অফিস খরচ দিয়েই এখন সাধারণ মানুষজনকে দলিলপত্র রেজিস্ট্রি করতে হচ্ছে। গাজীপুরের শ্রীপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে প্রায় পৌণে তিন মাস ধরে এই ঘুষ লেনদেন চলছে।
জানা গেছে, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘুষের হার বাড়ানো হচ্ছে ওই অফিসে। সাবরেজিস্ট্রার আবু তালেব সরকার গত প্রায় পৌনে তিন মাসে দু’বার তার ঘুষ গ্রহণের হার বাড়িয়েছেন। এতে ওই অফিসের দলিল লেখক ও নকলনবিশরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে প্রথমবার করা তালিকাই বহাল রেখে ঘুষ নেওয়া হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর শ্রীপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে যোগদান করেন আবু তালেব সরকার। এর আগে তিনি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে সাবরেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলা সদর এলাকায়।
দলিল লেখকরা জানান, আবু তালেব সরকার এখানে যোগদানের পর থেকে বিভিন্ন দলিলে ঘুষ নির্ধারণ করে একটি তালিকা করেন। ওই তালিকা ধরেই ঘুষ নিতেন তিনি। গত ২৫ জানুয়ারি ঘুরের হার বাড়িয়ে নতুন তালিকা করেন তিনি। ওই তালিকায় দলিলের নকল সরবরাহেই ৩০০ টাকা বাড়ানো হয়।
কয়েকজন নকলনবিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নকল সরবরাহে ফি মাত্র ১৩০ টাকা। প্রতি নকলের আগে সরকারি ফি বাদে ৫০০ টাকা ঘুষ নিতেন সাবরেজিস্ট্রার। ফলে স্ট্যাম্প ও লেখাসহ তারা এতদিন ক্রেতা-বিক্রেতাদের কাছে ১ হাজার টাকায় নকল সরবরাহ করতেন। সাবরেজিস্ট্রার ৩০০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়ায় তারা বেকায়দায় পড়ে গেছেন। বাড়তি টাকা চাওয়ায় দলিলের দাতা ও গ্রহীতাদের সঙ্গে তাদের বচসা হচ্ছে। ফলে ২৬ জানুয়ারি থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দুদিন তারা দলিলের নকল সরবরাহ করেননি।
শ্রীপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম জানান, তার একটি দলিলের নকলের জন্য দলিল লেখক আবদুল হামিদকে ১ হাজার টাকা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সাবরেজিস্ট্রার নকলে ৩০০ টাকা বাড়িয়েছেন বলে দলিল লেখক আবদুল হামিদ অতিরিক্ত ওই টাকা দাবি করেন। যোগাযোগ করা হলে দলিল লেখক আবদুল হামিদ বলেন, ‘ভাই দলিলের নকল সরবরাহে সাবরেজিস্ট্রার আরও ৩০০ টাকা ঘুষের হার বাড়িয়েছেন।’
দলিল লেখকরা আরও জানান, ঘুষের হার বাড়িয়ে নতুন তালিকা করায় শ্রীপুর পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর দলিল লেখক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মন্ডলের নেতৃত্বে গত ২৫ জানুয়ারি লেখক ও নকলনবিশরা প্রতিবাদ জানান। প্রতিবাদকালে সাবরেজিস্ট্রার আবু তালেব সরকার নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিসহ জীবন যাপনে ব্যয় বাড়ার কারণে ঘুষের হার বাড়িয়েছেন বলে যুক্তি দেখান। তাদের সঙ্গে সাবরেজিস্ট্রার দাবি করেন,‘এই টাকা আমি একা খাই না। জেলা রেজিস্ট্রারসহ উর্ধ্বতন অন্তত দশজনকে টাকা দিতে হয়।’
প্রতিবাদের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে দলিল লেখক ও সাধারণ কাউন্সিলর শাহজাহান মন্ডল বলেন, আমরা ‘অফিস খরচ’ এর নতুন তালিকা বাতিলের দাবি জানিয়েছিলাম।’
পরে গত ৩১ জানুয়ারি ‘অফিস খরচ’এর নতুন তালিকা বাতিল করেন সাবরেজিস্ট্রার। পুরনো তালিকা ধরেই ‘অফিস খরচ’ নেওয়া হবে বলে ওই দিন সাবরেজিস্ট্রার তার সহকারী আবদুল আজিজের মাধ্যমে দলিল লেখক ও নকলনবিশদের জানিয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আবদুল আজিজ বলেন, ‘অফিস খরচের নতুন তালিকা বাতিল করা হয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে দলিল সম্পাদিত হয়েছে ১ হাজার ৪৭১টি। ১ জানুয়ারি থেকে গত ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দলিল সম্পাদন হয়েছে আরও ১ হাজার ৪২৮টি। ডিসেম্বর মাসে দলিলের নকল সরবরাহ করা হয় ১ হাজার ৩৮০টি। ১ জানুয়ারি থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত নকল সরবরাহ হয় ৮৭১টি। ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত নকল সরবরাহে ৫০০ টাকা হারে ঘুষ নিয়েছেন সাবরেজিস্ট্রার। ওই হিসেবে ১ ডিসেম্বর থেকে ২৭ জানুয়ারি নকল সরবরাহে ১০ লাখ ১২ হাজার ৯৫০ টাকা ঘুষ নিয়েছেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নকলনবিশ জানান, বিভিন্ন কারণে গত প্রায় দেড় বছর ধরে জমি বেচা-বিক্রি অনেক কমে গেছে। এরপরও প্রতিদিন গড়ে ৭২টি দলিল সম্পাদন হয়। আর প্রতি দলিলে ৫০০ টাকা ঘুষ নেন সাবরেজিস্ট্রার। গেজেট নোটিফিকেশনভুক্ত জমি হলে প্রতি বিঘায় ২ লাখ টাকা ঘুষ নেন তিনি।
কয়েকজন দলিল লেখক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নো অবজেকশন সার্টিফিকেট ফি মাত্র ১৬০ টাকা। কিন্তু এজন্য প্রতিটি নির্দায় পত্রে সাবরেজিস্ট্রারের নির্ধারিত ঘুষ ১ হাজার ২০০ টাকা। প্রতিদিন গড়ে ৫০টি নির্দায়পত্র সরবরাহ হয়। ওই হিসেবে প্রতিদিন নির্দায়পত্র সরবরাহ করে তিনি ৬০ হাজার টাকা ঘুষ নেন।
ওই দুজন দলিল লেখক আরও জানান, রেজিস্ট্রি সম্পাদনকালে নামজারির মূল কপি না থাকলে ৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত ঘুষ আদায় করেন আবু তালেব সরকার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অফিসের একজন সহকারী জানান, কমিশনের (অফিসের বাইরে গিয়ে দলিল সম্পাদন) সরকারি ফি ৩০০ টাকা (উপজেলার মধ্যে)। কিন্তু সাবরেজিস্ট্রার নেন ৩ হাজার টাকা। ঢাকা, অন্য কোনও জেলা কিংবা বিভাগের বাইরে কমিশনের মাধ্যমে দলিল হলে সরকারি ফি’র ১০গুণ বেশি টাকা নেন সাবরেজিস্ট্রার।
ভুক্তভোগী অনেক দলিল লেখক জানান, দলিল সম্পাদনকালে দলিলে ভুল-ত্রুটি ধরে তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। ভুল-ত্রুটি ধরার পর তার সহকারী আবদুল আজিজের হাতে অতিরিক্ত টাকা না দিলে সম্পাদনে অপারগতা জানান সাবরেজিস্ট্রার। তারা আরও জানান, মর্টগেজ দলিলের সরকারি ফি প্রতি লাখে মাত্র ৫০পয়সা। কিন্তু প্রতি লাখে ২০০ টাকা ঘুষ নেন সাবরেজিস্ট্রার।
জ্যেষ্ঠ এক দলিল লেখক অভিযোগ করেন, ‘২০০৬ সাল থেকে সরকারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গেজেট নোটিফিকেশনভুক্ত জমির নামজারি, জমাভাগসহ বেচাকেনা বন্ধ রয়েছে। কিন্তু প্রতি বিঘায় দুলাখ টাকা ঘুষ নিয়ে ওইসব জমির দলিলও সম্পাদন করছেন আবু তালেব সরকার।’ তিনি আরও জানান, প্রায় প্রতিদিনই একটি-দুটি গেজেট নোটিফিকেশনভুক্ত দলিল রেজিস্ট্রি হচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে নজির দেখিয়ে বলেন, ‘গত ১১ জানুয়ারি পটকা মৌজার একটি দলিল (নম্বর ৪৮৩) রেজিস্ট্রি হয়েছে। দলিলে থাকা এসএ ২৫৪ গেজেট নোটিফিকেশনভুক্ত দাগ।
ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাব রেজিস্ট্রার আবু তালেব সরকার বলেন, ‘ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ একেবারেই মিথ্যা। কেউ আমার সামনে এসে বলুক দেখি। অনেকে অনেক কথাই বলে থাকে। আমি এক পয়সাও ঘুষ নিই না। যারা আপনার কাছে বলেছে, তারা মিথ্যা অভিযোগ করেছে।’
এ প্রসঙ্গে গাজীপুর জেলা রেজিস্ট্রার জিয়াউল হক বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে কেউ লিখিত অভিযোগ করলে পরে দেখা যাবে।’
/এপিএইচ/এইচকে/
