সংস্কার এবং খননের অভাবে গত চার দশকে ভরাট হয়ে গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের তিনটি খাল। বছরের পর বছর এসব খাল ময়লা-আবর্জনায় ভরাট, দখল-দূষণ হলেও রক্ষার উদ্যোগ নেয়নি জেলা পরিষদ কিংবা পৌরসভা। বর্তমানে খালগুলো মৃতপ্রায়। দখল-দূষণ নিয়ে জেলা পরিষদ ও পৌরসভা একে-অন্যের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। তবে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, দায় এড়ানোর সংস্কৃতি থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে। খালগুলো দখল-দূষণমুক্ত করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নগরবাসী জানায়, শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা টাউন খাল ঘিরে গড়ে উঠেছিল ছোট-বড় হাটবাজার। খালে চলতো ডিঙি নৌকা। কিন্তু চার দশকের ব্যবধানে এখন এসব ইতিহাস। বন্যা, পাহাড়ি ঢল ও জলাবদ্ধতা থেকে শহররক্ষার জন্য টাউন খাল গুরুত্বপূর্ণ। এই খাল তিতাস নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে শহরের পাশ দিয়ে সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পৌর এলাকার গোকর্ন ঘাটে গিয়ে আবার তিতাস নদীতে পড়েছে। এক দশক আগে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে খালকে সংকোচিত করার অভিযোগ তোলেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতারা।
পাশাপাশি শহরের মেড্ডা এলাকার সাবেক ২ নম্বর ফাঁড়ির খালের দুই পাশ পাকা করে ড্রেনেজ করা হয়েছে। এটি এখন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। একই অবস্থা মেড্ডা শ্মশান খালের। এটি দখল-দূষণে মরা খালে পরিণত হয়েছে। এসব খালের এ অবস্থার জন্য নাগরিক ফোরামসহ নদী নিরাপত্তা সংগঠনের নেতারা পৌরসভা এবং জেলা পরিষদকে দায়ী করছেন।
পৌরসভার মেয়র নায়ার কবীর বলেন, খালগুলো জেলা পরিষদের। তারা সংস্কার করতে পারতো। তবে পৌরসভার ভেতর দিয়ে খালগুলো প্রবাহিত হওয়ায় পৌরসভার দায়িত্ব আছে। সে জন্য প্রায়ই পৌরসভার নিজস্ব অর্থায়নে খালগুলোর ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়। বরাদ্দের জন্য আমাদের এখতিয়ার না থাকায় খালগুলো সংস্কার কিংবা খনন করতে পারি না। তাই বরাদ্দ চাওয়া হয়নি। তবে খালগুলো সংস্কার জরুরি।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল আলম বলেন, খালগুলো আমাদের আওতাধীন। অতীতে বিএনপি সরকারের সময় ব্লক করে বাউন্ডারি দিয়ে খালগুলো সংকুচিত করা হয়েছে। বর্তমানে খালগুলো সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করলে দুই পাশের বাড়িঘর, বিভিন্ন স্থাপনা খালে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই নতুন করে খালগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নানা জটিলতার কথা চিন্তা করে সংস্কার করা থেকে জেলা পরিষদ সরে এসেছে। এ জন্য এত বছরেও সংস্কার কিংবা খননের জন্য মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ চাওয়া হয়নি। বরাদ্দ চাওয়া হলে হয়তো পাওয়া যেতো। জটিলতার কথা চিন্তা করে আমরা বরাদ্দ চাইনি। তবে ভবিষ্যতে খালগুলো সংস্কার এবং খননের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
জেলা নাগরিক ফোরামের সহ-সভাপতি নিহার রঞ্জন সরকার বলেন, শহরের টাউন খাল এক দশক আগে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে সংকোচিত করা হয়েছে। সেসময় এ নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল। সংস্কারের নামে দুই পাশ ভরাট করায় খালটি এখন শহরবাসীর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খালগুলো খনন এবং সংস্কার জরুরি।
এ ব্যাপারে নদী নিরাপত্তা বিষয়ক সামাজিক সংগঠন নগরের নোঙর জেলা শাখার সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, সংস্কারের নামে টাউন খালকে হত্যা করা হয়েছে। তিতাস নদীর সঙ্গে খালটির সংযোগস্থলে নাব্যতা উঁচু হওয়ায় বর্ষাকালে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি থাকে না। খালের নাব্যতা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। এ জন্য খালটিকে পুনরায় খনন করতে হবে। এ ছাড়া মেড্ডা এলাকার সাবেক ২ নম্বর পুলিশ ফাঁড়ির খালটি ড্রেনে পরিণত হয়েছে। একইভাবে মেড্ডা শ্মশানঘাট এলাকার খালটি দখল-দূষণে নিমজ্জিত। খালগুলো জেলা পরিষদের আওতাধীন হলেও পৌরসভা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে সংস্কারের নামে খালগুলোকে হত্যা করা হয়েছে। পৌরসভার পক্ষ থেকে খালের দুই পাশে দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে খালগুলোর মুখে স্লুইসগেট বসানো হয়েছে। এমন পরিকল্পনা করে খালগুলোকে হত্যা করা হয়। অথচ প্রতিটি খাল দিয়ে একসময় নৌকা চলতো।
শামীম আহমেদ আরও বলেন, আমরা খালগুলো আমাদের কর্মী দিয়ে পরিষ্কার করছি। যদিও এ কাজ নোঙরের নয়। এটি জেলা পরিষদ ও পৌরসভার কাজ। আমরা দ্রুত এই খালগুলো উদ্ধার করতে চাই। অন্যথায় কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো।
খালগুলোর বেহাল দশার বিষয়ে জানতে চাইলে পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কাউছার আহমেদ বলেন, শহরের তিনটি খাল জেলা পরিষদের আওতাধীন। আমরা মেড্ডা পুলিশ ফাঁড়ির খালের দুই পাশ পাকা করে ড্রেন করেছি। মেড্ডা শ্মশানঘাট খালটি পৌরসভার পক্ষ থেকে ড্রেনেজ করে দিয়েছি। টাউন খালটিও দুই পাশে ব্লক দিয়ে সংস্কার করেছি। একবছর পরপর খালগুলো থেকে কচুরিপানাসহ বর্জ্য অপসারণের চেষ্টা করি।
জেলা পরিষদের আওতাধীন হওয়ার পরও আপনারা কেন এসব খাল সংস্কার করেন? সেক্ষেত্রে জেলা পরিষদের অনুমতি ছিল কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে কাউছার আহমেদ বলেন, যেহেতু পৌরবাসী খালগুলোতে বর্জ্য ফেলে, সে জন্য পৌরসভার পক্ষ থেকে পরিষ্কার করা হয়। পৌরসভার এত কম অর্থে খালগুলো দখল-দুষণমুক্ত করা সম্ভব নয়। মন্ত্রণালয়ে অর্থ বরাদ্দের জন্য আবেদন করা হবে। বরাদ্দ পেলে সংস্কার হবে।
খালগুলোর দুই পাশে অবৈধ দখলদারের বিষয়ে তিনি বলেন, খালগুলো দখলমুক্ত করা জরুরি। পৌরসভার একার পক্ষে উচ্ছেদ অভিযান চালানো সম্ভব নয়। যেহেতু খালগুলোর মালিকানা জেলা পরিষদের। সে জন্য জেলা পরিষদ ও পৌরসভা যৌথ উদ্যোগে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর চিন্তা-ভাবনা আছে। এ ব্যাপারে জেলা পরিষদকে আগেও কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি।
জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী মো. আবদুল হামিদ বলেন, খালগুলো দখল-দূষণমুক্ত করার ব্যাপারে একটি তালিকা করা হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের তালিকা করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আমাদের সার্ভেয়াররা এগুলো করছেন। তালিকা তৈরির কাজ শেষ হলে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে।
তিনি বলেন, তিন বছর আগে শহরের টাউন খালকে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে পরিষ্কার করা হয়েছিল। পৌরসভার বর্জ্যের কারণে খালটি আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। পৌরসভা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা একাধিকবার কথা বলেছি। সেই সঙ্গে মাইকিং করে খালে বর্জ্য না ফেলার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু পৌরবাসী কারও কথা শোনে না। পৌরসভা কর্তৃপক্ষও কার্যকর ভূমিকা রাখে না।
তিনি আরও বলেন, জেলা পরিষদের আওতাধীন খালের ওপর অনেক জায়গায় বাঁশের সাঁকো দেওয়া হয়েছে। আমরা তাদের চিঠি দিয়েছি, সাঁকো সরিয়ে নেওয়ার জন্য। সাঁকোর নিচের বাঁশে কচুরিপানা আটকে যায়। শহরের সবগুলো খাল সংস্কারের জন্য বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হবে। শহরের প্রধান খালটি দখল-দুষণমুক্ত করার পর পর্যায়ক্রমে সবগুলো খাল দখলমুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।