X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চাষি পান ৪ টাকা, বাজারে লবণের কেজি ৩৫

আবদুল আজিজ, কক্সবাজার
১৫ মার্চ ২০২২, ২০:০২আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২২, ১৮:২১

মাঠে লবণ উৎপাদন না হতেই শুরু হয়েছে দরপতন। সিন্ডিকেটের কারণে এক সপ্তাহের ব্যবধানে মাঠপর্যায়ে মণপ্রতি লবণের দাম কমেছে প্রায় ১৫০ টাকা। বর্তমানে লবণের মণ বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। অথচ কয়েক দিন আগেও লবণের মণ ছিল সর্বোচ্চ ৩২০ টাকা। হিসাবে প্রতিকেজি লবণের দাম পড়ে চার টাকা ২৫ পয়সা।

এই ধারা অব্যাহত থাকলে লবণ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। সংকটে পড়বেন চাষিরা। এ অবস্থায় দেশের লবণ খাতকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তারা। এ নিয়ে মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) সংবাদ সম্মেলন করেছেন কক্সবাজার লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের নেতারা।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শহীদুল্লাহ বলেন, চলতি মৌসুমে প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূলে থাকায় উৎপাদিত লবণ দেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়। কিছু অসাধু মিল মালিক বিদেশি লবণ আমদানিতে ব্যর্থ হয়ে সিন্ডিকেট করে চাষিদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করছেন। তারা চাষিদের লবণ চাষে অনুৎসাহিত করে বিদেশি লবণের ওপর দেশকে নির্ভরশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। এই মুহূর্তে তাদের ষড়যন্ত্র বন্ধ করা না গেলে দেশের লবণ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।

লবণ চাষিরা জানিয়েছেন, একজন চাষি তিন কানি (এক কানি সমান ৩৯ দশমিক ছয় শতাংশ) জমিতে লবণ চাষ করতে সক্ষম। সেই অনুপাতে গত বছর লবণ মাঠের মূল্য প্রতি কানিতে ১৮ হাজার টাকা হিসাবে তিন কানিতে ৫৪ হাজার টাকা খরচ হয়। সেচ দেওয়ার জন্য মেশিনের জ্বালানি খরচ পড়েছে কানিপ্রতি দুই হাজার ৫০০ টাকা করে তিন কানিতে সাত হাজার ৫০০ টাকা। পলিথিন বাবদ প্রতি কেজি ৭০ টাকা হিসাবে প্রতি কানিতে চার হাজার ৫৫০ টাকা করে তিন কানিতে ১৩ হাজার ৬৫০ টাকা। খাওয়া-দাওয়া ও শ্রমিকদের বেতন বাবদ ২০ হাজার টাকা করে এক মৌসুমে (পাঁচ মাসে) এক লাখ টাকা খরচ হয়। সব মিলে তিন কানি জমিতে লবণের উৎপাদন খরচ পড়ে এক লাখ ৭৫ হাজার ১৫০ টাকা।

প্রতি কানিতে সর্বোচ্চ ২৫০ মণ হিসাবে তিন কানিতে লবণ উৎপাদন হয় ৭৫০ মণ। এ হিসাবে প্রতি মণে উৎপাদন খরচ পড়ে ২৩৪ টাকা। মণপ্রতি শ্রমিক খরচ ও ইউপি ট্যাক্স ৩৩ টাকা, তার সঙ্গে মণপ্রতি ঢাকার গাড়ি ভাড়া ৫০ টাকা যোগ হলে উৎপাদন মূল্য দাঁড়ায় ৩১৭ টাকা। কিন্তু লবণের মণ ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা হলে মণপ্রতি চাষিদের উৎপাদন ঘাটতি ১৩৭ থেকে ১৪৭ টাকা। হিসাবে তিন কানিতে ৭৫০ মণ লবণের ঘাটতি অর্থাৎ চাষির ক্ষতি এক লাখ দুই হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ ১২ হাজার টাকা। এই ক্ষতি পোষাতে না পেরে যেকোনও সময় মাঠ ছেড়ে চলে যেতে পারেন চাষিরা।

চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের নেতারা জানিয়েছেন, লবণ চাষিরা যখন চলতি মৌসুমে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিতে আস্থা এবং বিশ্বাস রেখে পরিশ্রম করে প্রচুর পরিমাণ লবণ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন, ঠিক সে সময় কিছু অসাধু মিল মালিক সিন্ডিকেট করে লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছেন। মিল মালিক চক্রটি চাইছেন, উৎপাদন খরচ মেটাতে ব্যর্থ হয়ে চাষিরা অনুৎসাহিত হয়ে লবণের মাঠ ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। তখন লবণ উৎপাদন বন্ধ করে বিদেশি লবণের ওপর দেশ আমদানি নির্ভর হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার ও বাঁশখালীর কিছু অংশ নিয়ে প্রায় ৫৭ হাজার ২৭০ একর জমিতে ৫৫ হাজার লোক লবণ চাষে জড়িত। এছাড়া লবণ ব্যবসা ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করেন আরও কয়েক হাজার মানুষ। ফলে লবণ শিল্প ধ্বংস হলে বেকার হবেন হাজারো শ্রমিক।

চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের নেতারা আরও জানিয়েছেন, দেশে প্রচুর লবণ মজুত আছে। তবু অসাধু মিল মালিক সিন্ডিকেট লবণের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে চলতি মৌসুমে লবণ সংকটের ভুল তথ্য উত্থাপন করে সরকারের বিভিন্ন মহলকে চাপ সৃষ্টি করেন। তাদের চাপে ২০২১ সালের নভেম্বরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে ভোক্তা, লবণ চাষি ও ব্যবসায়ীদের মতামত গ্রহণ করে বিসিকের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সর্বসম্মতিক্রমে ‘লবণ আমদানির প্রয়োজন নেই’ বলে সিদ্ধান্ত হয়। তখন অসাধু ব্যবসায়ীদের লবণ আমদানির ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল। 

কিন্তু অসাধু কিছু মিল মালিক সিন্ডিকেট লবণ সংকটের বিষয় উপস্থাপন করে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আবারও চাপ সৃষ্টি করেন। পরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে গত ২৭ জানুয়ারি পুনরায় জুম মিটিং হয়। ওই সভায় চাষি প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি এবং লবণের সঙ্গে সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অংশ নিয়ে ‘লবণের সংকট না হওয়ার নিশ্চয়তা’ দিলে আমদানির ষড়যন্ত্র আবারও নস্যাৎ হয়ে যায়।

এরপরও অসাধু সিন্ডিকেটটি লবণ আমদানির জন্য সরকারের বিভিন্ন মহলে চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রাখে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার শহরের হিলডাউন সার্কিট হাউজে পুনরায় ‘লবণ আমদানির প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা’ যাচাইয়ে সবার সঙ্গে মতবিনিময় করেন। ওই সভায় উপস্থিত সবাই দেশে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রচুর পরিমাণ লবণ উৎপাদন এবং এ বছর ঘাটতির কোনও সম্ভাবনা নেই মর্মে নিশ্চয়তা দেন। সেই সঙ্গে লবণ ব্যবসায়ী ও প্রতিনিধিরা বলেছেন, আবহাওয়া ও পরিবেশ অনুকূলে থাকলে দেশে উৎপাদিত লবণ চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে মিল মালিক সিন্ডিকেটের লবণ আমদানির ষড়যন্ত্র তৃতীয়বারের মতো নস্যাৎ হয়ে যায়। 

লবণ মিল মালিক সিন্ডিকেটটি দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টার পরও লবণ আমদানিতে বারবার ব্যর্থ হয়ে এবার সিন্ডিকেট করে লবণের ক্রয়মূল্য উৎপাদন মূল্যের চেয়ে কমিয়ে দেয়। কম মূল্যে বাজার নির্ধারণ করে চাষিদের ওই দামে লবণ বিক্রি করতে বাধ্য করে তারা। এতে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে না পেরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। 

প্রসঙ্গত, লবণের মূল্য সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কমিয়ে রাখলেও মিল মালিকদের পরিশোধিত লবণের কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা বাজার মূল্য রাখা হয়েছে। দেশি চাষিদের কাছ থেকে সবসময় কমমূল্যে কিনলেও পরিশোধিত লবণের মূল্য কখনও কমানো হয় না। 

চাষিরা বলছেন, প্রতিকেজি লবণের মূল্য সর্বনিম্ন ১০ টাকা হলে ন্যায্যমূল্য পাওয়ার সম্ভাবনা আছে মর্মে প্রস্তাব উত্থাপন করে জেলা প্রশাসন। কিন্তু সিন্ডিকেটের চাপের কারণে সেই প্রস্তাব কার্যকর হয়নি। প্রধানমন্ত্রী, শিল্প মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লবণ চাষিরা জানান, লবণ নীতি অনুসরণ করে ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করে এই শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। অসাধু সিন্ডিকেটের দেশবিরোধী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে ৫৫ হাজার লবণ চাষিকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের নেতরা। 

সংবাদ সম্মেলনে লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে মিজানুর রহমান চৌধুরী খোকন মিয়া, কলিম উল্লাহ কলি, সোয়াইবুল ইসলাম সবুজ ও ইউসুফ বদরীসহ চাষিরা বক্তব্য রাখেন। তারা বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যবসায়ীরা যে দামে লবণ কিনে বাজারজাত করেছেন, এখন অর্ধেক দামে কিনলেও বাজারে লবণের দাম আগের মতোই আছে। এসিআই, মোল্লা সল্ট, ফ্রেশ ও সিটি; এই চার কোম্পানির সিন্ডিকেটের কারণে লবণ শিল্প ধ্বংস হওয়ার পথে। তাদের হাত থেকে লবণ শিল্পকে রক্ষা করতে হবে।

/এএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
তামাক কর বাস্তবায়নে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ তরুণের অকালমৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বাগানতীব্র গরমে ঝরছে আমের গুটি, উৎপাদন নিয়ে চাষিদের শঙ্কা
সর্বশেষ খবর
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!