X
শুক্রবার, ২৪ মার্চ ২০২৩
১০ চৈত্র ১৪২৯

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে ‘বাস্তুহারা’ আড়াইশ বাংলাদেশি পরিবার

আবদুর রহমান, টেকনাফ
২৯ নভেম্বর ২০২২, ২৩:০০আপডেট : ২৯ নভেম্বর ২০২২, ২৩:০০

মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে ২০১৭ সালে কক্সবাজারের উখিয়ায় গড়ে উঠেছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী বসতি কুতুপালং-বালুখালী মেগা ক্যাম্প। এর পাশেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের উপকূলীয় জলবায়ু উদ্বাস্তুদের বসতি। বাস্তুহারা হয়ে শাহপরীর দ্বীপ থেকে এখানে এসে বসতি গড়েছেন এসব বাংলাদেশি। কুতুপালং এলাকায় সনাতন ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গা ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত এক নম্বর ক্যাম্প সংলগ্ন হাজম সড়কে এমন ৪০টি পরিবার থাকছে। এটি এখন টেকনাফ উপকূলীয় শাহপরীর দ্বীপ পাড়া নামে পরিচিত। কারণ শাহপরীর দ্বীপে নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে এখানে এসে বসবাস শুরু করেন তারা।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহপরীর দ্বীপ পাড়ায় ওসব পরিবারের পাশাপাশি সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে আসা কয়েকটি পরিবারও রয়েছে। এখানের ছয় পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে বাংলা ট্রিবিউন প্রতিনিধির। এর মধ্যে পাঁচ পরিবারই ২০১৯ সালে জলোচ্ছ্বাস আর নদীভাঙনে উদ্বাস্তু হয়ে এখানে এসেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিন উপকূলে প্রতি বছর নদীভাঙন দেখা দেয়

এর মধ্যে এক পরিবারের কর্তা সৈয়দ উল্লাহ (৫৫)। বঙ্গোপসাগর ও নাফ নদের মোহনায় শাহপরীর দ্বীপের জালিয়া পাড়ায় ছিল তার বাড়ি। তিনি বলেন, ‌‘দীর্ঘদিন ধরে সাগর ও নদী তীরবর্তী জমি ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। একবার ভাঙলে কয়েকটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। তখন তারা এখানে চলে আসে। আবার ভাঙলে আরও কয়েকটি পরিবার বাস্তুহারা হয়। পরে তারাও নিরুপায় হয়ে এখানে এসে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে এখানে শাহপরীর দ্বীপ থেকে আসা অর্ধশতাধিক পরিবার রয়েছে।’

জালিয়া পাড়ার থেকে আসা আরেকটি পরিবারের কর্তা আব্দুল হোসেন (৩১) বলেন, ‘দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া, মাঝের পাড়া, ডাঙার পাড়া, পশ্চিম পাড়া ও উত্তর পাড়া থেকে আসা পরিবারও রয়েছে এখানে।’

স্থানীয় সূত্র জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিন উপকূলে প্রতি বছর নদীভাঙন দেখা দেয়। এতে উপকূলীয় বহু পরিবার বাস্তুহারা হয়। 

দ্বীপ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে পরিবারগুলো

শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিনসহ টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির শিকার আড়াই শতাধিক পরিবারকে চিহ্নিত করার কথা জানিয়েছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. এরফানুল হক চৌধুরী।

শাহপরীর দ্বীপ উপকূলে ভাঙনের হুমকিতে আশ্রয়ণ কেন্দ্র

তিনি বলেন, ‘জলবায়ুর প্রভাবে নদীভাঙনে উদ্বাস্তু মানুষের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য দ্রুত কাজ শুরু করবো আমরা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বারবার দুর্যোগে আক্রান্ত হওয়ায় দ্বীপগুলোর বেশকিছু বাসিন্দা অন্যত্র আশ্রয় নেওয়ার খবর পেয়েছি আমরা।’

তবে প্রতিদিন কোনও না কোনোভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্ভোগ সামলাতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শাহপরীর দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার) আবদুস সালাম। তিনি বলেন, ‘নদী ও সমুদ্রের বাঁধ ভাঙার কারণে বারবার ভিটেমাটি হারিয়ে একসময় দ্বীপ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে পরিবারগুলো।’

একই পরিষদের সাবেক সদস্য নুরুল আমিন বলেন, ‘গত তিন-চার বছরে শুধু আমার এলাকা থেকে ৫০-৬০ পরিবার সব হারিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে তারা। তাদের একটি বড় অংশ কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা শিবিরের কাছে আছে বলে জানতে পেরেছি।’

চলতি মাসে মিশরের শারম আল শাইখে জলবায়ু সম্মেলনে এক আলোচনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের দুই কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।’

রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বসবাস

২০১৭ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহে দলবেঁধে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা। তাদের জন্য কুতুপালং ও বালুখালীতে ক্যাম্প তৈরি করা হয়। ওই বছর থেকেই কুতুপালং ক্যাম্পের পাশে শাহপরীর দ্বীপ পাড়ায় প্রথম বসতি স্থাপন শুরু করে বাংলাদেশের জলবায়ু উদ্বাস্তুরা। এর মধ্যে একজন দ্বীপের মাঝের পাড়ার পদ্মা বানু। বয়স না জানাতে পারলেও ২০১৫ সালে সমুদ্রের ভাঙনে সব হারিয়ে দ্বীপ ছাড়ার কথা মনে আছে তার।

জলবায়ু উদ্বাস্তু আব্দুল হোসেন

পদ্মা বানু বলেন, ‘দরিয়ায় ভিটেবাড়ি হারানোর পর কুতুপালংয়ের পাহাড়ের পাশে কম দামে জমি কিনেছিলাম। সেখানে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা এসে থাকতে শুরু করে। আমরা যখন কোথাও থাকতে পারছিলাম না, তখন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা হাজম সড়কে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেন।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উখিয়া উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপের যেসব বাসিন্দা উদ্বাস্তু হয়ে কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা শিবিরের পাশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের আমরা সবসময়ই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করি।’

যা বলছেন বিশ্লেষকরা

অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর বলেন, ‘যেহেতু রোহিঙ্গারা একটা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে আছে, তাদের ব্যাপারে স্থানীয়দের মধ্যে একটা বৈরী মনোভাব তৈরি হয়েছে। যে কারণে শাহপরীর দ্বীপ থেকে যারা এসে আশ্রয় নিয়েছে তারাই স্থানীয়দের সহানুভূতিটা একটু বেশি পাবে বলে আশা করছি।’

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সাবেক এই কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের জন্য কক্সবাজারে যে মানবিক সহায়তার প্রক্রিয়া চালু রয়েছে তার আওতায় জলবায়ু উদ্বাস্তুদেরও নিয়ে আসা যায় কিনা তা স্থানীয় প্রশাসন এবং শরণার্থী সক্রিয় দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলোর বিবেচনা করা উচিত। নতুবা পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বাস্তুহারা বাংলাদেশিদের মধ্যে বৈরী মনোভাব তৈরি হতে পারে।’

‘যদিও রোহিঙ্গা ও শাহপরীর দ্বীপ থেকে আসা পরিবারগুলো বাস্তুহারা হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা, তবু উভয়ে যেহেতু সংকটের মুখে বাস্তুহারা হয়েছে; কিছুটা পারস্পরিক সহমর্মিতা তাদের থাকার কথা’ বলে উল্লেখ করেন আসিফ মুনীর।

শাহপরীর দ্বীপের নাফ নদের পাশের বাসিন্দা আব্দুল হোসেন ও তার স্ত্রী

কষ্টে আছেন জলবায়ু উদ্বাস্তুরা 

পদ্মা বানু বলেন, ‘ছয়-সাত বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। এখন দুই সন্তান মাছ ধরে সংসার চালায়। মাছ পেলে খাবার জোটে, না পেলে না খেয়ে থাকি।’

আরেক জলবায়ু উদ্বাস্তু আব্দুল হোসেন বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে জাল-বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করে আসছি। যে কারণে আমি দ্বীপে শান্তিতে ছিলাম। সকালে আধা ঘণ্টা সাগরে মাছ ধরলে চার-পাঁচশ টাকা আয় হতো। কিন্তু এখানে তেমন আয় হয় না। অনেক কষ্টে সংসার চালাতে হয়।’

বর্তমানে নাফ নদঘেঁষা বেড়িবাঁধে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন চল্লিশোর্ধ্ব আবুল কালাম। নদের তীর থেকে প্রায় পাঁচশ মিটার দূরে থাকা একটি নৌকা দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘একসময় ওখানে আমার বাড়ি ছিল। নদের ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে এখানে এসেছি। পরিবার নিয়ে কতদিন দ্বীপে টিকে থাকতে পারবো জানি না। প্রতিদিন একপ্রকার যুদ্ধ করে এখানে টিকে আছি।’

/এএম/
সর্বশেষ খবর
চীনের কথা অবশ্যই আমাদের শুনতে হবে: স্পেনের প্রধানমন্ত্রী
চীনের কথা অবশ্যই আমাদের শুনতে হবে: স্পেনের প্রধানমন্ত্রী
স্বপ্ন পূরণে আরও এক ধাপ এগিয়ে কিংসলে
স্বপ্ন পূরণে আরও এক ধাপ এগিয়ে কিংসলে
শামীম ওসমানের সুস্থতা কামনা করে মসজিদে মসজিদে দোয়া
শামীম ওসমানের সুস্থতা কামনা করে মসজিদে মসজিদে দোয়া
ফেসবুকে প্রেম, দেখা করতে গিয়ে খুইয়েছেন সর্বস্ব
ফেসবুকে প্রেম, দেখা করতে গিয়ে খুইয়েছেন সর্বস্ব
সর্বাধিক পঠিত
৬৫ বছরের পুরনো স্কুলের নাম পরিবর্তন
৬৫ বছরের পুরনো স্কুলের নাম পরিবর্তন
‘স্যার’ বলা নিয়ে রংপুরের ডিসির সঙ্গে কী হয়েছিল শিক্ষকের?
‘স্যার’ বলা নিয়ে রংপুরের ডিসির সঙ্গে কী হয়েছিল শিক্ষকের?
খেজুর কেনার আগে মনে রাখবেন যে ৪ বিষয়
খেজুর কেনার আগে মনে রাখবেন যে ৪ বিষয়
এশিয়া কাপ পাকিস্তানেই, ভারতের জন্য আলাদা ভেন্যু!
এশিয়া কাপ পাকিস্তানেই, ভারতের জন্য আলাদা ভেন্যু!
পুলিশ পরিদর্শক হত্যা: ইন্টারপোলের রেড নোটিশে রবিউল
পুলিশ পরিদর্শক হত্যা: ইন্টারপোলের রেড নোটিশে রবিউল