X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

অযত্ন-অবহেলায় দুই শহীদের কবর, ৫২ বছরেও মেলেনি স্বীকৃতি

সোনাগাজী (ফেনী) প্রতিনিধি
৩১ মার্চ ২০২৩, ০৮:০০আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৩, ০৮:০০

স্বাধীনতার ৫২ বছরেও মেলেনি দুই শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। স্বীকৃতি পেতে ১৫ বছর ধরে সংশ্লিষ্ট সব দফতরে লিখিত আবেদন করেছেন তাদের স্বজনেরা। প্রমাণাদি পর্যালোচনা করে আাবেদনের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার কথা জানালেও কাজ হয়নি।

এদিকে অবহেলা ও অযত্নে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে তাদের কবর। স্থানীয়রা বলছেন, এভাবে অরক্ষিত থাকলে কোনও এক সময় হারিয়ে যাবে দুই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার শেষ স্মৃতিটুকু।

দুই সহোদর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন সোনাগাজী উপজেলার চরদরবেশ ইউনিয়নের চরশাহাভিকারি গ্রামের তিন নম্বর ওয়ার্ডের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সামছুল হক ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবু নাসের।

অভাবে শহীদ সামছুল হকের অশীতিপর বৃদ্ধ স্ত্রী ও সন্তানেরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বেঁচে নেই শহীদ আবু নাসেরের পরিজন।

স্বজনেরা জানান, শহীদ সামছুল হক চট্টগ্রাম বন্দরে ও শহীদ আবু নাসের আনসার বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। পাক হানাদারি বাহিনী চট্টগ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করলে সামছুল হক এলাকায় ফিরে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে ভাই আবু নাসেরকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আহসান মাস্টার ও নাসির কমান্ডারের সঙ্গে ভারতে চলে যান। প্রশিক্ষণ শেষে সোনাগাজীর সোনাপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে অবস্থান করে যুদ্ধে অংশ নেন তারা।

মহান মুক্তিযুদ্ধে সোনাগাজীর শহীদদের নামফলক

সামছুল হকের স্ত্রী নূরজাহান বলেন, ‘ছোট ছেলের জন্ম ও শ্বশুরের অসুস্থতার খবর পেয়ে সোনাপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থেকে আমার স্বামী সামছুল হক ও দেবর আবু নাসের ২১ আগস্ট রাতে বাড়িতে আসেন। খবর পেয়ে সকালে স্থানীয় হাবিব সরকার, শাহজাহান, আবুল হাসেম আমাদের বাড়িতে আসলে স্বামী ও দেবর পাশের বাড়ির বসতঘরের ধানের গোলায় আত্মগোপন করেন। খোঁজাখুঁজির পর তাদের না পেয়ে তারা চলে যান। দুপুরে তারা আবার এসে আমার স্বামী ও দেবরকে ধরে নিয়ে যায়।’

নূরজাহান আরও বলেন, ‘নিয়ে যাওয়ার সময় রাজাকার হাবিব সরকারের পা ধরে তাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য কান্নাকাটি করলে আমাকেও মারধর করা হয়। স্বামী ও দেবরকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য ভুলতে পারিনি। এখনও স্বামী ও দেবরের আত্মচিৎকার কানে ভাসে। রাজাকাররা দুই জনকে নবী উল্যাহ বেড়িবাঁধের পাশে গুলি করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। রাতে আমার শ্বশুর আব্দুল খালেক ও বাবা সৈয়দুর রহমান নদী থেকে দুই জনের লাশ তুলে এলাকায় নিয়ে আসেন। খবর পয়ে রাজাকাররা লাশ দাফন করতে বাধা দেয়। এলাকার কেউ ভয়ে লাশ দাফন করতে আসেনি। গভীর রাতে গোপনে দুই জনকে নদীর পাড়ে দাফন করা হয়।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাক্ষর করা দুইটি চিঠি দেখিয়ে নূরজাহান বলেন, ‘আমার স্বামী ও দেবর দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করায় দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রতি সহানুভুতি জানিয়ে ডাকযোগে চিঠি পাঠান। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণ তহবিল থেকে আমি, আমার শাশুড়ি ও জায়ের জন্য ছয় হাজার টাকা পাঠান। এরপর আর কেউ খবর নেয়নি।’

তিন বছর আগে সমকাল পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর ফেনীর জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুজ্জামান দেড় লাখ টাকা অনুদান দিয়ে কবর সংরক্ষণের আশ্বাস দেন বলে জানান নূরজাহান।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলসহ বিভিন্ন দফতরে গত ১৫ বছর ধরে বেশ কয়েকটি আবেদন করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি।

সোনাগাজী উপজেলা চত্ত্বরে স্থাপিত স্তম্ভে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যার শিকারদের নামের তালিকায় সামছুল হক ও আবু নাসেরের নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে।

প্রতিবেদককে বাবা ও চাচার কবর দেখাতে নিয়ে যান শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সামছুল হকের ছেলে কামাল উদ্দিন। প্রথম দেখাতে কেউ বুঝতে পারবে না খালপাড়ের কয়েকটি গাছের নিচে ঝোপের আড়ালে চিরশায়িত রয়েছেন বাঙালির শ্রেষ্ঠ দুই সন্তান। অযত্নে-অবহেলায় নিশ্চিহ্নের পথে তাদের কবর।

কামাল উদ্দিন বলেন, ‘যে রাষ্ট্রের জন্য বাবা-চাচা জীবন বিসর্জন দিয়েছেন সেই রাষ্ট্র খবর নেয়নি। দেয়নি স্বীকৃতি, উদ্যোগ নেয়নি কবর সংরক্ষণের।’

বাবা ও চাচার কবর দেখিয়ে দিচ্ছেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সামছুল হকের ছেলে কামাল উদ্দিন

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘যারা আমার বাবা-চাচাকে হত্যা করেছে সেই রাজাকারদের পরিবার অর্থসম্পদে ভরপুর আর আমরা করছি মানবেতর জীবনযাপন।’

সামছুল হক ও আবু নাসেরের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার আকুতি জানান নূরজাহান ও কামাল।

সোনাগাজী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সৈয়দ নাসির উদ্দিন বলেন, ‘সামছুল হক ও আবু নাসের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তারা আমাদের সঙ্গে ভারতে ট্রেনিং নিয়েছেন। দেশে আমার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। আমার অনুমতি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গেলে রাজাকাররা তাদের ধরে নিয়ে হত্যা করে। তাদের স্বীকৃতির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা থমকে রয়েছে।’

সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কামরুল হাসান বলেন, ‘কিছুদিন আগে সোনাগাজীতে যোগদান করেছি। তাই তাদের বিষয়ে আমার কাছে তেমন তথ্য নেই। প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা যেন অবহেলিত না থাকে সে বিষয়ে আমরা সজাগ রয়েছি। দুই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা যেন স্বীকৃতি পান তার জন্য সব ধরনের উদ্যেগ নেওয়া হবে। তাদের কবর সংরক্ষণ করা হবে।’

/আরআর/
সম্পর্কিত
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সফলতায় কিছুটা দায়মুক্ত হয়েছি: মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী
৭ দফা আবেদন করেও প্রশাসনের সহায়তা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
সর্বশেষ খবর
সুন্দরবনে ২২ বছরে ৩২ বার আগুন, তদন্ত হলেও সমাধান নেই
সুন্দরবনে ২২ বছরে ৩২ বার আগুন, তদন্ত হলেও সমাধান নেই
বাজেটে প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা ৫ হাজার করাসহ ১১ দাবি
বাজেটে প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা ৫ হাজার করাসহ ১১ দাবি
দ্বিতীয় সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ, আটক ২ সহস্রাধিক
দ্বিতীয় সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ, আটক ২ সহস্রাধিক
মিল্টন সমাদ্দারের আরও ৭ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ
মিল্টন সমাদ্দারের আরও ৭ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ
সর্বাধিক পঠিত
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি