X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিশের বদলে পুঁটিও মেলে না

আরিফ হোসাইন কনক, নারায়ণগঞ্জ
১১ অক্টোবর ২০২২, ০০:০১আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২২, ০০:০১

একসময় নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে জেলেরা জাল ফেললেই রুই-কাতল ও বোয়ালসহ ছোট-বড় নানা জাতের মাছ পেতেন। এমনকি ইলিশও পেতেন। এ দিয়ে চলতো শীতলক্ষ্যা পাড়ের জেলেদের জীবন-জীবিকা। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে শীতলক্ষ্যার পাড়ে গড়ে উঠেছে হাজারো শিল্প-কারখানা। এসব কল-কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীতে। ধীরে ধীরে নদীর পানি দূষিত হয়ে কালো রঙ ধারণ করেছে। সেইসঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে মাছ ও জীববৈচিত্র্য। এখন পুঁটি মাছের দেখাও মেলে না।

এদিকে, বছরের পর বছর নদীতে মাছ না পাওয়ায় হুমকিতে পড়েছে জেলেদের জীবন-জীবিকা। এ অবস্থায় অনেকে পেশা বদল করেছেন, কেউ কেউ সময়ে-অসময়ে এখনও জাল ফেলেন। তবে মাছ মেলে না। তাদের সন্তানরা এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। দিনমজুরি ও শ্রমিকের কাজ করে চলে কারও কারও সংসার। এভাবে কমে গেছে জেলের সংখ্যা।

নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে একরামপুর এলাকার জেলেপল্লিতে ১১৯টি জেলে পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে ১০-১২ জন জেলে পেশায় জড়িত। বাকিরা পেশা পরিবর্তন করে পোশাকশ্রমিক, মাছ ব্যবসা ও দিনমজুরিসহ ছোটখাটো চাকরি করে সংসার চালান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ও তীরবর্তী স্থানে গড়ে উঠেছে হাজারো শিল্প-কারখানা। এসব কারখানার দূষিত পানি শীতলক্ষ্যায় পড়ছে। এর মধ্যে ১০৯টি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং কল-কারখানার বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) নেই। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে ইটিপি প্ল্যান নির্মাণাধীন।

স্থানীয় বাসিন্দা ও জেলেরা বলছেন, কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে নদীর পানি দূষিত হয়ে গেছে। পানির রঙ বিবর্ণ হয়ে কালো আকার ধারণ করেছে। পানির দুর্গন্ধে নাক চেপে নদী পার হন দুই পারের বাসিন্দারা। এসব কারণে মাছ মিলছে না। তবে বর্ষাকালে পানি কিছুটা পরিষ্কার হলে ছোট ছোট কিছু মাছ পাওয়া যায়। এ দিয়ে সংসার চলে না জেলেদের।

কল-কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীতে

জেলেপাড়ার মনির হোসেন নদীর পাড়ে জাল শুকাতে দিয়েছেন। সেখানে জালের ছিঁড়ে যাওয়া অংশে জোড়া দিচ্ছিলেন। কাজের ফাঁকে কথা হয় মনির হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পূর্ব-পুরুষের এই পেশা এখন বিলীন হওয়ার পথে। বাবা-দাদার হাত ধরে এই পেশায় এসেছি। দেশ স্বাধীনের পর থেকে জেলে পেশায় জড়িত। কয়েক বছর আগেও শীতলক্ষ্যায় অনেক মাছ পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন মাছ পাওয়া যায় না। তাই এখন পুকুর-খাল থেকে মাছ ধরি। সে মাছ বিক্রি করে সংসার চলে না। তাই শীতলক্ষ্যার ইস্পাহানি ঘাটে নৌকা দিয়ে যাত্রী পারাপার করে সংসারের খরচ জোগান দিচ্ছি।’ 

জেলেপাড়ার আরেক বাসিন্দা জুগেস চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘একসময় শীতলক্ষ্যা থেকে মাছ ধরে দিনে তিন-চার হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হতো। জাল ফেললেই নানা রকমের মাছ পেতাম। ইলিশও পেতাম। এখন পুঁটি মাছও মেলে না। বর্ষা মৌসুমে ঘারুয়া মাছ ও চাপিলার মতো ছোট মাছ পাওয়া যায়। তাও খুবই কম। এ দিয়ে সংসার চলে না। এজন্য এখন মেঘনা নদীতে মাছ ধরি। তবে ট্রলারের জ্বালানিসহ আনুষঙ্গিক খরচ দিয়ে দিন শেষে তেমন একটা আয় হয় না।’

জেলেপাড়ার সভাপতি মহাদেব বর্মণ এখনও বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে ধরে আছেন। কষ্টের মাঝেও পেশা ছাড়তে পারেননি। ষাটোর্ধ্ব এই জেলে এখন ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না। তবু মাছ পাওয়ার আশায় এখনও নদীতে জাল ফেলে যান। বেলা শেষে খালি হাতে বাসায় ফেরেন।

তিনি বলেন, ‘৭০-এর দশকে শীতলক্ষ্যার পানি অনেক পরিষ্কার ছিল, তখন বড় বড় রুই-কাতল, চিতল ও বোয়ালসহ ছোট-বড় সব ধরনের মাছ পেতাম। এমনকি ইলিশ পর্যন্ত ধরেছি। ওই সময় বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যেতাম, তখন এলাকার সবাই জেলে ছিলেন। সে সময়ে জাল ফেললে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ উঠতো। এখন কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে পানি নষ্ট হয়ে গেছে। পানি থেকে পচা গন্ধ বের হচ্ছে। এ কারণে মাছ নেই। তবে বর্ষা মৌসুমে জাল ফেললে ছোটখাটো মাছ পাওয়া যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘শীতলক্ষ্যায় মাছ না পাওয়ায় এখানকার জেলেরা মেঘনা ও ধলেশ্বরী নদীতে মাছ ধরতে যায়। প্রতি নৌকায় পাঁচ-ছয় জনের একটি দল মাছ ধরে তা বাজারে বিক্রি করে। খরচ মিটিয়ে জনপ্রতি ৫০০ টাকা পর্যন্ত উপার্জন হয়। তবে এ টাকা দিয়ে সংসার চলে না। ফলে পরিবারের অন্য সদস্যদের আয়ের ওপর নির্ভর করতে হয় জেলেদের। এজন্য শতাধিক জেলে পরিবারের মধ্যে এখন ১০-১২ জন জেলে এই পেশায় জড়িত। বাকিরা অন্য পেশায় চলে গেছে। আমাদের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে।’

জেলেপাড়ার মনির হোসেন নদীর পাড়ে জাল শুকাতে দিয়েছেন, জালের ছিঁড়ে যাওয়া অংশে জোড়া দিচ্ছিলেন

মহাদেব বর্মণের মেজো ছেলে মিঠু বর্মণ একটি সিমেন্ট তৈরির কারখানায় কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘চার ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই জেলে পেশায় জড়িত। বাকি তিন ভাই অন্য পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এখন জেলে পেশার অবস্থা করুণ। তাই অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন।’

জেলেপাড়ার বাসিন্দা রতন বর্মণ এখন পোশাককর্মী। তিনি বলেন, ‘নদীর পানি দূষণের ফলে মাছ বিলীন হয়ে গেছে। এরপরও কিছুদিন পেশায় টিকে থাকতে চেয়েছি। কিন্তু সংসারের অভাব-অনটন দেখে বাধ্য হয়ে পেশা বদল করেছি। একই সঙ্গে নিজের সন্তানদের এই পেশায় আসতে দিইনি।’

বন্দর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মোস্তফা মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রায় ৫০ বছর আগে শীতলক্ষ্যার পানি পরিষ্কার ছিল, তখন ইলিশ মাছও পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন কল-কারখানা ও ডাইং প্রতিষ্ঠান ইটিপি প্ল্যান গ্রহণ না করায় নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। দূষণ রোধের কথা ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। জেলেরা আমাদের সম্পদ, তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। যদিও বন্দরে জেলেদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে এখনও কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তবে আগামীতে পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আয়নাল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে শীতলক্ষ্যায় ইলিশ মাছ পাওয়া যেতো। এখন বছরে পাঁচ-ছয় মাস (বর্ষা মৌসুমে) নদীর পানি একটু পরিষ্কার থাকে, বাকি সময় পানি দূষিত থাকে। ওই সময় মাছ ও জীববৈচিত্র্য থাকে শূন্যের কোঠায়। এসব কারণে নদীর আশপাশের এলাকার ৫০ শতাংশ জেলে কমেছে। পেশা পরিবর্তন করেছেন অনেকে। এখন বন্দর উপজেলায় ২০০, সোনারগাঁয়ে এক হাজার ৮০০, আড়াইহাজারে এক হাজার ১০০ সহ জেলায় সাড়ে তিন হাজার জেলে রয়েছেন। এর মধ্যে কার্ডধারী জেলের সংখ্যা আড়াই হাজার।’ 

জেলেপাড়ার আরেক বাসিন্দা জুগেস চন্দ্র বর্মণ বলেছেন, এখন মেঘনা নদীতে মাছ ধরি

জেলেদের টিকিয়ে রাখতে কোনও সহায়তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মেঘনা নদীর আশেপাশের এলাকার জেলেদের ইলিশ প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। তবে শীতলক্ষ্যা নদীর আশপাশের জেলেরা এই সুবিধা এখনও পাচ্ছেন না। জেলেদের টিকিয়ে রাখতে হলে পানি দূষণমুক্ত করার কোনও বিকল্প নেই। পানি দূষণের সমস্যা সমাধান করতে হলে সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন, কারও একার পক্ষে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড, পরিবেশ অধিদফতর, নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষসহ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’

নদীর পানি দূষণের বিষয়ে জেলা পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল-মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নদীর পানি দূষণরোধে আমরা ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। সম্প্রতি সিটি করপোরেশন এলাকার চারটি ডাইং কারখানার গ্যাস-বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করেছি। বছরের পর বছর যেসব ডাইং কারখানা দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না, ইটিপি স্থাপন করেনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এছাড়া যারা পরিবেশ দূষণ করছে তাদের বিরুদ্ধে গত এক বছরে আমরা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ১৮টি মামলা করেছি। তবে প্রত্যেকটি কারখানায় ইটিপি প্ল্যান করেও নদী দূষণমুক্ত করা সম্ভব না। কারণ নারায়ণগঞ্জ শহরে প্রায় এক কোটি লোকের বসবাস, তাদের পয়োবর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। এই পয়োবর্জ্য পরিশোধন করে নদীতে ফেলতে হবে। নয়তো এই নদী দূষণমুক্ত হবে না।’

নদী দূষণরোধে কোনও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের জন্য অবশ্যই পরিকল্পনা রয়েছে। শর্টটার্ম, মিডটার্ম ও লংটার্মভিত্তিক পরিকল্পনার অনুমোদন পেলে সে অনুযায়ী কাজ করবো আমরা।’ 

/এএম/
সম্পর্কিত
তিস্তাসহ ৫৪টি নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দাবিতে বাসদের তিন দিনের রোডমার্চ
কাপ্তাই হ্রদে তিন মাস মাছ শিকার বন্ধ
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে নৌকাডুবিতে নিহত ৪
সর্বশেষ খবর
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা