গাজীপুরের শ্রীপুরের বরমী বাজারের শীতলক্ষ্যা নদীর ঘাটে গত ৩০ বছর ধরে বসছে সবজির হাট। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে চাষিরা তাদের ক্ষেতের সবজি নিয়ে আসেন এই হাটে। ব্যবসায়ীরা হাট থেকে সবজি কিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে বিক্রি করেন। প্রতি হাটে ১০ লাখ টাকার কেনাবেচা হয়।
শ্রীপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে হাটের অবস্থান। গত বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, এই হাটে শুধু সবজি কেনাবেচা হচ্ছে। অন্য কোনও পণ্য নেই। ছোট-বড় ব্যাগ ও খাঁচিতে করে চাষিরা সবজি এনে হাটে বিক্রি করছেন। ফড়িয়া চাষিদের কাছ থেকে সবজি কিনে তাঁবু খাটিয়ে বসা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। সেগুলো বস্তায় ভরে বিভিন্ন বাজারে পাঠাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
চাষি, ফড়িয়া ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এটি বরমী বাজার খেয়াঘাটের ৩০ বছরের ঐতিহ্যবাহী সবজি হাট। সপ্তাহের বুধবার হাটের দিন। সবজির মৌসুম বিশেষ করে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই হাটে প্রচুর স্থানীয় সবজি বেচাকেনা হয়। কাপাসিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা এবং ময়মনসিংহের গফরগাঁও, পাগলা, টাঙ্গাবোসহ বিভিন্ন স্থান থেকে সবজি আসে। কয়েকশ চাষি এসব সবজি বিক্রি করেন। কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত আছেন দুই শতাধিক শ্রমিক ও ফড়িয়া।
চাষিরা জানিয়েছেন, বর্তমানে সবজির দাম কম। যেসব চাষির জমিতে দেরিতে ফলন এসেছে তাদের উৎপাদন খরচ উঠাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যারা শুরুর দিকে ফলন পেয়েছেন তারা লাভবান হয়েছেন।
চাষি, আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রতি হাটে অন্তত ৪২ হাজার কেজি সবজি বেচাকেনা হয়। বুধবার ভোর ৫টা থেকে হাটে সবজি আসতে থাকে। ছয়টি ট্রলারে এসব পণ্য আসে। প্রতি ট্রলারে কমপক্ষে ১০০ খাঁচি পণ্যভর্তি থাকে। প্রতি খাঁচিতে ৭০-৮০ কেজি থাকে। সকাল ৮টা থেকে পাইকারিতে বেচাকেনা শুরু হয়। চলে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। এর মধ্যেই সব ধরনের সবজি বিক্রি হয়ে যায়। সেইসঙ্গে হাটও ফাঁকা হয়ে যায়। চার ঘণ্টায় ১০ লাখ টাকার সবজি বিক্রি হয়। ব্যবসায়ীরা পাইকারিতে কিনে নিয়ে যান।
চাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান, গত কয়েকটি হাটে টমেটো এবং আলু এসেছে সবচেয়ে বেশি। গত বুধবার ৮০ কেজির টমেটোর খাঁচি বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৬০০ টাকায়, কেজিতে দাম পড়েছে ২০ টাকা। ৭০ কেজির আলুর খাঁচি বিক্রি হয় এক হাজার ৪০০ টাকায়, প্রতি কেজির দাম পড়েছে ২০ টাকা। পাশাপাশি বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম, কাঁচাকলা, কুমড়া ও কাঁচা মরিচ বিক্রি হয়েছে। ৭৫ কেজির শিমের খাঁচি বিক্রি হয়েছে এক হাজার ১২৫ টাকায়। কেজিতে দাম পড়েছে ১৫ টাকা। একইভাবে বাঁধাকপি, ফুলকপির পিস ১০ টাকা কাঁচাকলার হালি ১০ টাকা, কুমড়ার পিস ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হয়। এ ছাড়া কয়েকদিন আগে বরমী ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় স্ট্রবেরি ও ব্রোকলির ফলন এসেছে। এখন সেসব ফলন হাটে আসছে।
সবজি বিক্রি করতে আসা জব্বার মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাটে দেড়শ শ্রমিক মালামাল উঠানোর কাজ করেন। সপ্তাহে একদিন (বুধবার) সবজি বিক্রি করি। মাসে লাখ টাকার সবজি বিক্রি করতে পারি।’
গফরগাঁও উপজেলার কৃষক চাঁদ মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০ বছর ধরে কৃষিকাজ করছি। বরমী হাটে ১৫ বছর ধরে সবজি নিয়ে আসছি। একেক হাটে একেক ধরনের সবজি আনি। আনার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে যায়। অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার বিক্রি ভালো। তবে এখন বাজারে বেশি সবজি থাকায় দাম কম পাচ্ছি।’
গফরগাঁও উপজেলার টাঙ্গাবো এলাকার কৃষক কামাল হোসেন ও ইব্রাহীম জানান, ২০ বছর ধরে কৃষিকাজ করেন তারা। এবার উৎপাদন ভালো। কিন্তু দাম এখন কম। টমেটো বিক্রি করেন তিন মাস। অন্যান্য সময় চিচিঙ্গা, ধুন্দল আর ঝিঙা বিক্রি করেন। এলাকার আট জন কৃষক মিলে একটি ট্রলার ভাড়া করে নিজেদের ক্ষেতে উৎপাদিত সবজিগুলো হাটে নিয়ে আসেন। নৌপথ হওয়ায় খরচ তুলনামূলক কম লাগে।
হাটের শ্রমিক আবু সাঈদ বলেন, ‘ভোর ৫টা থেকে সবজি আসা শুরু হয়। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিক্রি চলে। কোনোদিন এক হাজার, কোনোদিন দেড় হাজার টাকা পাই। তা দিয়ে সংসার চলে।’
হাটের পাইকারি ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন মৃধা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখানে ৩০ বছর ধরে সবজির হাট বসে। আমার বাবা আগে এখানে ব্যবসা করতেন। বাবার হাত ধরে এখন আমি ব্যবসা করছি।’
আরেক ব্যবসায়ী আব্দুল কাদির বলেন, ‘সপ্তাহের প্রতিদিন বেচাকেনা হলেও বুধবার বেশি হয়। ওই দিন সব মিলিয়ে ১০ লাখ টাকার সবজি বিক্রি হয়। এখানে যেসব সবজি আসে সবগুলো বিষমুক্ত।’
বরমী বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নূরুল আমীন বলেন, ‘এটি ঐতিহ্যবাহী হাট। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে চাষিরা ক্ষেতের সবজি নিয়ে এখানে আসেন। ভোর ৫টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বেচাকেনা হয়।’