X
সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
১৬ আষাঢ় ১৪৩২

ব্রকলি চাষে ঝুঁকছেন যশোরের কৃষকরা

তৌহিদ জামান, যশোর
০৪ জানুয়ারি ২০২০, ১২:৪২আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০২০, ১৩:০৬

ব্রুকলি ক্ষেতের পরিচর্যা করছেন চাষি

সবজির গ্রাম যশোর সদরের পোলতাডাঙ্গা। এখানকার এক কৃষক হলেন মো. আমিন উদ্দিন (৪০)। তিনি গতবছর পরীক্ষামূলকভাবে ব্রকলি উৎপাদন করে। ফুলকপির মতো দেখতে গাড় সবুজ রঙের এই সবজিতে  রয়েছে বহু পুষ্টিগুণ। এবারের শীতেও আমিনউদ্দিন ব্রকলি চাষ করেছেন। তার দেখাদেখি আরও অনেকেই এবার ব্রকলি চাষ করেছেন।

আমিন উদ্দিন জানান, ‘তিনি বছরে তিন থেকে চারবার ভারতের পশ্চিম বাংলার গিয়ে বিভিন্ন এলাকার সবজি মার্কেটে ঘোরাফেরা করেন। সেখানে যে কয়দিন থাকেন সে কয়দিন নতুন নতুন সবজির স্বাদ নেন। তার মুখে যদি ভালো লাগে এবং পুষ্টিগুণ সম্পর্কে তিনি যদি ইতিবাচক রেজাল্ট পান, তাহলে ওই বীজ সংগ্রহ করে দেশে নিয়ে আসেন। পরে নিজ জমিতে পরীক্ষামূলক উৎপাদন করেন। ফলাফল ভালো হলে তিনি বড় পরিসরে চাষাবাদ শুরু করেন।

তিনি জানান, একবার কলকাতায় সাম্মান (ধূসর রঙের এক প্রকার ফল, এটি তরমুজ ও ফুটির মতো) নামে একটি ফল খেয়ে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। ফলটি পাকলে ভেতরটা পাকা পেঁপের মতো হয়। খেতেও খুব সুস্বাদু। দেশে আসার সময় বীজ নিয়ে এসেছেন। পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন করেছেন। ফলাফলও ভালো, আগামীতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করবেন বলে জানান। পরের বার কাকড়ি নামে এক ধরনের শসা দেখে বীজ আনেন, চাষও করেছেন। এই শসার বৈশিষ্ট্য হলো এটা আড়াই হাতের মতো লম্বা হয়। স্থানীয় লোকজন বিস্মিত হলেও কেউ সেগুলো কিনতে রাজি হয় না। তেমনিভাবে তিনি স্কোয়াশ ও ক্যাপসিক্যাম চাষ করেছেন। তবে, ক্যাপসিক্যামের ফলাফল ভালও হয়নি। ফলগুলো কুকড়ে গেছে এবং গ্রোথও ঠিক মতো হয়নি। কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন কিন্তু তারা যে পরামর্শ দিয়েছেন তা তার পছন্দ হয়নি বলে জানান।

তিনি আরও বলেন, এ বছর লেটুসপতার চাষ করেছিলাম। কিন্তু যশোরে লেটুসপাতার চাহিদা তেমন নেই। ১০ কাঠা জমিতে প্রায় ৭০ মণ উৎপাদন লেটুসপাতা উৎপাদন হয়েছিন। অনেক কষ্টে ২০ মণ বিক্রি  করতে পেরেছি। বাকিগুলো ফেলে দিয়েছি। কারণ শীতের সবজি চাষের সময় এসে গেছে। এখন ওই জমিতেই ব্রকলি চাষ করেছি। প্রথম দিকে ব্রকলি ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। ব্রকলি আর কয়েক দিন পর উঠবে। এগুলো বিক্রি হলে ফের চাষ করবো। এবার আড়াই বিঘা জমিতে ব্রুকলি চাষ করার ইচ্ছা আছে।’

আমিনউদ্দিন জানান, বাংলাদেশে ১০ গ্রাম ব্রকলির বীজের দাম চারশ’ টাকা। কিন্তু একই পরিমান বীজ ভারত থেকে নয়শ’ টাকায় কিনেছেন। বীজ দুটোই জাপানের সাকাতা কোম্পানির। দেশি বীজ থেকে ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ব্রকলি পাওয়া গেলেও ভারতীয় বীজ এক কেজি ২০০ গ্রাম থেকে প্রায় দুই কেজি ওজনের ব্রকলি পাওয়া যায়। তাছাড়া ওই বীজের ব্রকলির রঙ গাঢ় ও উজ্জ্বল হয়। পরিকল্পতিভাবে ব্রুকলি চাষ করা হচ্ছে

তিনি জানান, ব্রকলি চাষে পরিমিত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করলেই চলে। তবে এখনে যেসব সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়, তার গুণগতমান খুব একটা ভালো না। কীটনাশক ব্যবহারেও ভালো ফলাফল পাওয়া যায় না। কর্মকর্তারা মাঠে খুব একটা আসেন না। বেশির ভাগ সময়ই তারা ওষুধ কোম্পানির লোকজের সঙ্গে এসে ওই কোম্পানির উপকরণ ব্যবহারে পরামর্শ দেন।

তার দাবি, আমরা নতুন নতুন জাতের সবজি চাষ করছি, কিন্তু প্রচারণার অভাবে সেগুলো ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছি না। তাই উৎপাদিত সবজির বাজারে দামও ভালো পাচ্ছি না। সরকার যদি এই দিকে একটু নজর দিতো, তাহলে কৃষক তার ন্যায্য দাম পেতো, মানুষেরও পুষ্টি ঘাটতি মিটতো।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোর সদরের কর্মকর্তা খালিদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘যশোর সদরে প্রায় দুইশ’ বিঘা জমিতে ব্রুকলির চাষ হচ্ছে। ব্রকলি চাষ ইদানিং বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। মানুষও দাম দিয়ে তা কিনছে। এ কারণে কৃষকও লাভের মুখ দেখছে। কৃষিতথ্য সার্ভিসের মাধ্যমে এই সব সবজির পুষ্টিগুণ সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণা চালানো সম্ভব।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট যশোর আঞ্চলিক কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘শীতকালে ক্যাপসিকাম, বেগুন, টমোটো, মরিচ ইত্যাদি সবজিতে পাতার নিচে মাকড়, জেসিড ও হোয়াইট ফ্লাই বেশি আক্রমণ করে। যশোর, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া জেলায় মাকড়ের আক্রমণ একটু বেশি। আমাদের কৃষকরা সময় মতো সঠিক ওষুধটি নির্দিষ্ট মাত্রায় দিতে পারেন না বলে পোকা-মাকড় ধ্বংস হয় না। এ কারণে খরচও বেশি পড়ে।

তিনি আরও বলেন, ‘মাকড় প্রধানত গাছের পাতার নিচে থাকে, সেক্ষেত্রে মাকড়নাশক ওষুধ স্প্রে করতে হয় পাতার নিচে। অর্থাৎ গাছের গোড়ায় স্প্রের মুখ রেখে ওষুধ স্প্রে করলে মাকড়ের গায়ে লাগবে। কিন্তু দেখা যায়, অধিকাংশ কৃষক পাতার উপরের দিকে স্প্রে করে চলে যায়। ওষুধ স্প্রে করার জন্য কত লিটার পানিতে কত মিলিমিটার ওষুধ দিতে হবে তা কৃষকদের বলে দেওয়া হয়। কিন্তু তারা বোতলের ছিপিতে ওষুধ মাপেন, যা কখনোই সঠিক পদ্ধতি নয়। এছাড়া এই সব ওষুধ স্প্রে করার উপযুক্ত সময় হচ্ছে বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে। কেননা ওই সময় তাপমাত্রা কম থাকে, পোকা-মাকড়গুলোও তাদের আশ্রয়স্থলে এসে হাজির হয়। কিন্তু দেখা যায়, অধিকাংশ কৃষক খুব সকালে ওষুধ স্প্রে করেন। সে কারণে ওষুধে কাজ হচ্ছে না বলে তারা মনে করেন।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, যশোর জেলার প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে ‘ক্রসিফেরি’ জাতের ব্রকলি চাষ করছেন কৃষকরা। এটি এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এখনও তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। ব্রকলির প্রচুর পুষ্টি ও ওষুধিগুণ রয়েছে। এগুলো জানতে পারলে ভোক্তাদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমি বর্তমানে ব্রকলি নিয়ে রিসার্চ করছি। এই রিসার্সের উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্রকলির ইউনিট প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি করা। জৈব ও অজৈব উপকরণের সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমানো। এছাড়াও নতুন বাজার সৃষ্টির পাশাপাশি নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ণ নিশ্চিত করা।’ তার গবেষণালব্ধ ফল আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানভীর আহমেদ বলেন, ‘ব্রকলির বেশ কিছু পুষ্টিগুণ রয়েছে। কাঁচা কিংবা রান্না-যেভাবেই খাওয়া হোক না কেন, মানবদেহের বেশকিছু রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে এই সবজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন: কোলেস্টেরল কমাতে, ক্যানসার প্রতিরোধে, অ্যালার্জি ও ইনফ্লামেসন কমায়। এছাড়াও এ সবজিতে ভিটামিন-সি, লুটিন ও  বিটাক্যারোটিনসহ অনেক শক্তিশালী এন্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘ব্রকলিতে থাকা ভিটামিন এ, বিটা ক্যারোটিন, ভিটামনি বি কমপ্লেক্স ও ভিটামিন সি সবগুলো উপাদানই চোখ ভালো রাখে। যারা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান তারা বেশি করে এই সবজি খেতে পারেন। এছাড়া বয়সজনিত পরিবর্তন, ত্বক সুস্থ ও সুন্দর রাখতে সর্বোপরি শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্রকলি দারুণ ভূমিকা রয়েছে।

 

 

 

/জেবি/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাবেক এমপি সাবিনা আক্তার তুহিন রিমান্ডে
সাবেক এমপি সাবিনা আক্তার তুহিন রিমান্ডে
টিকটক কেনার মতো ধনবান লোক খুঁজে পেয়েছেন ট্রাম্প
টিকটক কেনার মতো ধনবান লোক খুঁজে পেয়েছেন ট্রাম্প
আবু সাঈদ হত্যা: ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল
আবু সাঈদ হত্যা: ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল
শাহে আলম মুরাদ আবারও রিমান্ডে 
শাহে আলম মুরাদ আবারও রিমান্ডে 
সর্বাধিক পঠিত
ঘরে ঢুকে নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা, যুবককে পিটিয়ে হত্যা এলাকাবাসীর
ঘরে ঢুকে নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা, যুবককে পিটিয়ে হত্যা এলাকাবাসীর
এনবিআরের শীর্ষ ৬ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক
এনবিআরের শীর্ষ ৬ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক
ব্যাগে গুলির ম্যাগাজিন পাওয়ার বিষয়ে যা জানালেন উপদেষ্টা আসিফ
ব্যাগে গুলির ম্যাগাজিন পাওয়ার বিষয়ে যা জানালেন উপদেষ্টা আসিফ
এনবিআরের সব চাকরি ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণা
এনবিআরের সব চাকরি ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণা
এইচএসসি পরীক্ষা দিতে গিয়ে নিখোঁজ ছাত্রী সাভারে উদ্ধার
এইচএসসি পরীক্ষা দিতে গিয়ে নিখোঁজ ছাত্রী সাভারে উদ্ধার