যশোরের শার্শা উপজেলা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা পল্লী এলাকা। জীবিকার তাগিদে এক সময় এখানকার অধিকাংশ গরিব পরিবারের নারীরা ভালো কাজের আশায় দালালের মাধ্যমে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। এতে অনেকে প্রতারিত হতেন। কিন্তু এখন সে চিত্র আর নেই বললেই চলে। সংসারের অভাব ঘোচাতে পুরুষের পাশাপাশি কাজ করছেন নারীরাও। ছাগল চাষ করে সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন অনেক নারী-পুরুষ। লেখাপড়া করাচ্ছেন ছেলে-মেয়েদের।
বর্তমানে উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে ৫০০টির মতো খামারে ৪৫০ জন নারী-পুরুষ বাণিজ্যিকভাবে ছাগল চাষ করছেন। বেনাপোলের শাখারীপোতা গ্রামের ইব্রাহীমের স্ত্রী নূরনাহার ছাগল পালন করে সফল হয়েছেন। তিনি বলেন, মাত্র ৫ বছর আগের কথা। স্বামী যা আয় করতেন তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলতো না। পরের জমিতে টিনের চাল তুলে কোনোমতে দিন পার হয়েছে। বন্ধ ছিল দুই ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া। প্রতিদিন রান্নার চাল থেকে অল্প-অল্প জমিয়ে পরে সেই চাল বিক্রি করে একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল কিনি। সেই ছাগল থেকে আজ আমার খামারে ৫০টি ছাগল হয়েছে। এ থেকে লাভের টাকায় জমি কিনেছি। ছেলে-মেয়েকে স্কুলে দিয়েছি। এখন খেয়ে পরে আমরা বেশ ভালো আছি। কোরবানির ঈদে ছাগলের চাহিদা বেশি থাকায় ছাগল চাষে লাভ বেশি।
তিনি আরও যোগ করেন, উপজেলার প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে আমাকে খামার গড়তে একবার ৫ হাজার টাকা ও এক মণ খাবার দিয়েছিল। আর কোনও খোঁজ-খবর নেয়নি। ছাগলের ডায়রিয়া বা অন্য কোনও রোগ হলে স্থানীয় চিকিৎসককে দেখাই। এতে খরচ বেশি হয়ে যায়। সরকারিভাবে চিকিৎসাসেবা পেলে ভালো হতো। তার দেখাদেখি প্রতিবেশী অনেক নারীই ছাগল চাষ করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন।
তাদের একজন মিনতি বিশ্বাস। তিনি বলেন, অসুস্থ স্বামী ঠিকমতো কাজ করতে না পারায় অন্যের কাছ থেকে সাহায্য ও ধার-দেনা করে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। ৬ বছর আগে ২টি ছাগল কিনে পালতে শুরু করি। এখন আমার খামারে ৩৫টি ছাগল রয়েছে। ছাগল পালনে যে লাভ হয় তাতে সংসারের অভাব অনেকটাই ঘুচে গেছে। এখন আর কারও কাছে হাত পাততে হয় না।
বাণিজ্যিকভাবে ছাগল পালন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন শার্শা উপজেলার ইকবাল হাসান টুটুল। দেশে ছাগলের মাংসের যেমন চাহিদা রয়েছে, তেমনি দামও সন্তোষজনক হওয়ায় ছাগলের খামার গড়ে তিনি সাফল্য পেয়েছেন। শখ থেকে শুরু করা ছাগল পালন এখন টুটুলকে সফল এক খামারি করে তুলেছে। আট বছর আগে চারটি ছাগল চাষ শুরু করেন বেকার টুটুল। এখন তার খামারে ছাগলের সংখ্যা ৩০০। যার দাম প্রায় ১৫ লাখ টাকা। তার খামারে দেশি ছাগলের পাশাপাশি বিদেশি প্রজাতির ছাগলও রয়েছে। টুটুলের সফলতা দেখে অনেকেই ছাগলের খামার করতে তার কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন।
শার্শা উপজেলা নির্বাহী অফিসার পুলক কুমার মণ্ডল বলেন, সরকারিভাবে উপজেলার অনেক দরিদ্র পরিবারকে ছাগল দেওয়া হয়েছে। সেই ছাগল পালন করে অনেকে আজ স্বাবলম্বী। অনেকে সংসার পরিচালনার পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর সুযোগ পাচ্ছে। দরিদ্র মানুষের মাঝে ছাগল দেওয়া উপজেলা প্রশাসনের একটি চলমান প্রক্রিয়া।
জানা যায়, বেনাপোল সীমান্ত পথে প্রায় ৭ বছর ধরে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ। ফলে বেড়েছে গরুর দাম। গরুর তুলনায় দাম কম হওয়ায় ছাগল কোরবানির সংখ্যা বেশি। এছাড়া গরুর চেয়ে ছাগল পালনে খরচও অনেক কম। ছাগলের রোগও কম। বাড়ির আশপাশের ঘাস-পাতা খাওয়ালেই চলে। তাই ছাগল চাষ লাভজনক।
শার্শা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মাসুমা আক্তার জানান, উপজেলায় ছাগলের ছোট-বড় ৫০০টি খামার রয়েছে। এছাড়া আরও ১৫০ বাড়ির নারীরা ছাগল পালন করছেন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী সব মিলিয়ে এ উপজেলায় ৬৫ হাজার ৫০০ ছাগল রয়েছে। যারা ছাগল পালন করছেন তাদের অধিকাংশই নারী।
তিনি বলেন, সঠিকভাবে ছাগল পালনের জন্য আমরা তাদের বিভিন্ন কর্মশালায় প্রশিক্ষণ ও মাঝে মধ্যে ছাগলের চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকি। উপজেলার দুই নারীকে ছাগলের দুটি খামার তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। অফিসে আমি ছাড়া আর মাত্র দুই জন কর্মী রয়েছেন। ছাগলের খামারের পাশাপাশি এই উপজেলায় ছোট বড় প্রায় ১৪০০ গরুর খামার রয়েছে। জনবল সংকট ও পর্যাপ্ত ওষুধ না থাকায় যথাযথ সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।