খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুরিয়া গ্রামের শেখর মন্ডলের ছেলে এবং গুটুদিয়া অক্কুর চন্দ্র গোলদার বান্ধব (এসিজিবি) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নিরব মন্ডলকে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে গ্রেফতার পাঁচ কিশোর। শুক্রবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত তারা পর্যায়ক্রমে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জাবানবন্দি দেয়। পরে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় আসামিদের শনিবার তাদেরকে কিশোর সংশোধানাগারে পাঠানো হবে।
ওই পাঁচ কিশোর হলো- মৃত সৈয়দ মোল্লার ছেলে ও গুটুদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র সোহেল মোল্লা (১৫), জিলেরডাঙ্গা গ্রামের পংকজ মন্ডলের ছেলে পিতু মন্ডল (১৪), গুটুদিয়া গ্রামের প্রকাশ রায়ের ছেলে দশম শ্রেণির ছাত্র হিরক রায় (১৫), তেলিখালী গ্রামের অনিমেশ রায়ের ছেলে ১০ শ্রেণির ছাত্র পিয়াল রায় (১৫) ও গুটুদিয়া গ্রামের ক্ষিতিশ মন্ডলের ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র দ্বীপ মন্ডল (১৩)।
জানা গেছে, ভারতের টেলিভিশন সিরিয়াল ক্রাইম প্যাট্রল দেখে দেড় মাস আগে স্কুলছাত্র নিরবকে অপহরণের কৌশল রপ্ত করে এই পাঁচ কিশোর। এর পর তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে। হিরক সরস্বতী পূজার আগে ও পরে নিরবকে অপহরণের টার্গেট নেয়। কিন্তু প্রথম ধাপে সে সফল হতে পারেনি। এরপর দায়িত্ব নেয় পিয়াল, কিন্তু সেও ব্যর্থ হয়।
পুলিশ জানায়, গত বৃহস্পতিবার মিথ্যা কথা বলে নিরব মন্ডলকে স্কুলে ডেকে নেয় আসামিরা। আগেই ওই স্থানে স্কুলছাত্র পিতু বাড়ি থেকে নাইলনের রশি, তালা ও চাবি নিয়ে অবস্থান করছিল। নিরবকে স্কুলের পাশের ওই পরিত্যক্ত ভবনে নেয়। এরপর কথা আছে বলেই জাপটে ধরে তার গলায় রশি পেঁচিয়ে ঘরের আড়ার সঙ্গে ঝুলিয়ে ধরে। মারা যাওয়ার আগে নিরব সমস্ত শরীর নাড়া দিলে ভয় পেয়ে যায় আসামিরা। পিতু গলার দড়ি খুলে দেয়। আর পিয়াল নিরবকে ধরে রাখে। নিরবের মৃত্যুর পর বাবা শেখর মন্ডলকে ফোন দেয় পিতু। এ সময় পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সোহেল।
তারা নিরবের বাবার কাছে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এরপর ভুক্তভোগীর বাবা ও আসামিদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে আসামি সোহেল ব্যবহৃত ফোনের ইনকামিং কল বন্ধ করে রাখে। তারা লাশ নামিয়ে ওই ঘরের কোণায় পুরোনো কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। আর ওই ভবনের পেছনের রাস্তা তালা দিয়ে রেখে চলে যায়। তাদের ধারণা ছিল শুক্র, শনি ও রবিবার (মাঘী পূর্ণিমা) স্কুল ছুটি। এই তিন দিনের মধ্যে তারা সব আলামত নষ্ট করে ফেলবে। যাতে স্কুলে এমন ঘটনা ঘটেছে কেউ টের পাবে না। কিন্তু তা হয়ে উঠেনি।
ঘটনার দিন রাত ১১টার দিকে তারা আবারও নিরবের বাবার ব্যবহৃত ফোনে কল করে মুক্তিপণ দাবি করে। আর ওই ফোন কলের সূত্র ধরেই পুলিশের জালে আটকা পড়ে অভিযুক্তরা। পুলিশ তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্যে প্রথমে সোহেলকে আটক করে। পরে অপর অভিযুক্তদের একে একে গ্রেফতার করে। সর্বশেষ শুক্রবার রাতে আদালতেও ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা দেয় অপরাধীরা।
ডুমুরিয়া থানার ওসি শেখ কনি মিয়া বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডে নিজেদের দায় স্বীকার করেছে আসামিরা। পরে আদালতে স্বীকারোক্তি দেওয়ার কথা তাদের জানালে তারা দিতে রাজি হয়। বিকেল ৪টার দিকে তাদের আদালতে নেওয়া হয়। পরে ক্রমান্বয়ে তারা আদালতে জবানবন্দি দিতে থাকে। নীরব মণ্ডল খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া পূর্বপাড়া এলাকার পান-সুপারি ব্যবসায়ী শেখর মণ্ডলের ছেলে।
জানা গেছে, এই কিশোর চক্রটি লেখাপড়ায় তেমন মনোযোগী ছিল না। এরা কিছুটা সিনেমা স্টাইলে ঘোরাফেরা করতো। বিশেষ করে ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ক্রাইম প্যাট্রলে আসক্ত ছিল। আর সেটি দেখেই মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
গুটুদিয়া এসিজিবি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শংকর প্রসাদ মন্ডল বলেন, নিরব মন্ডল নিহতের ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সে নিয়মিত স্কুলে আসতো। তবে ওই ছেলেগুলো ভালো ছিল না। ওদের চলাফেরা ও পড়ালেখার লক্ষণ সন্তোষজনক ছিল না। স্কুল ছুটির পর সাড়ে ৪টার দিকে নিরবের বাবার কাছ থেকে খবর পাওয়ার পর থানার ওসিকে জানাই। পুলিশ রাত ১টার দিকে ১০ম শ্রেণির পিয়ালের স্বীকারোক্তি মোতাবেক স্কুলের পেছনে একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে ময়লা-আবর্জনায় ঢাকা নিরবের লাশ উদ্ধার করে।
