X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুপেয় পানির অভাবে দিশেহারা পাইকগাছার মানুষ

মহিউদ্দিন রিফাত, পাইকগাছা থেকে ফিরে
২২ মার্চ ২০২৩, ১৯:১৪আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৩, ১৯:১৫

সুপেয় পানির সংকটে দিশেহারা খুলনার পাইকগাছা উপজেলার সাধারণ মানুষ। টিউবওয়েল, পুকুর থেকে শুরু করে সব জায়গার পানি লবণাক্ত ও আর্সেনিকযুক্ত। মিঠা পানির উৎস নেই বললেই চলে। সুপেয় পানির অভাবে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাতে হয় এ অঞ্চলের মানুষদের।

সরেজমিনে দেখা যায়, লোকজন পাইকগাছা লোনাপানি গবেষণা কেন্দ্রের মিঠাপুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করে ভ্যানগাড়িতে তুলছেন। কলসি, হাঁড়ি, পাতিল ও প্লাস্টিকের বড় সাইজের বোতল নিয়ে আসছেন সবাই। নারীরা লাইন ধরে পুকুর থেকে পানি নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার ড্রামভর্তি করে এ পানি নিয়ে যাচ্ছেন বিক্রি করতে।

পানি সংগ্রহকারীদের মধ্যে চম্পা রানি শীল, অমিতা শীল, সুমি রায়সহ কয়েকজন গৃহিণী ছিলেন। তারা জানালেন, নিত্য গৃহস্থালি কাজ ও খাওয়ার পানির জন্য এ পুকুরটাই তাদের ভরসা। তাদের বাড়িতে থাকা টিউবওয়েলে লোনা পানি উঠে, আছে আর্সেনিকও। পুকুরগুলোতেও লোনা পানি। কোনও উপায় না থাকায় পাশের শীলপাড়া থেকে প্রতিদিন এখানে পানি নিতে আসেন তারা। সুপেয় পানির অভাবে দিশেহারা পাইকগাছার মানুষ

পানি নিতে আসা পার্বতী রানি শীল জানান, প্রতিদিন আসা-যাওয়ায় ১০ কিলোমিটার হেঁটে তিনি পানি নিয়ে যান। রিকশায় যাতায়াতে ৪০ টাকা খরচ হয়। পুকুর থেকে প্রতিদিন ১০/১২ লিটার পানি নিয়ে তাদের গৃহস্থালি কাজ-কর্ম সারতে হয়। পার্বতী রানি বলেন, শুধু তিনি নন, ১০/১২ কিলোমিটার দূরের গড়ইখালি, গদাইপুর ইউনিয়ন থেকেও মানুষ এখানে পানি নিতে আসেন। আবার অনেকে পুকুরের এই পানি মানুষের বাড়ি বাড়ি নিয়ে বিক্রিও করেন।

আশরাফুল আলম (৩০) নামে একজন বলেন, আমি এখান থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের মদিনা মসজিদ এলাকায় থাকি। প্রতিদিন খাবার পানি নেওয়ার জন্য এখানে আসি। রান্না এবং খাবারের জন্য এই পুকুরের পানিই ভরসা।

তিনি প্রতিদিন ভ্যান নিয়ে এসে নিজের ও পরিবারের জন্য পানি নিয়ে যান। কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোনও সুপেয় পানির টিউবওয়েল নেই। পুরো তল্লাটে মিঠাপানির পুকুর এই একটাই। পান এবং রান্নার জন্য এ পুকুরটাই তাদের একমাত্র ভরসা। সুপেয় পানির অভাবে দিশেহারা পাইকগাছার মানুষ

স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে খুলনার পাইকগাছা-কয়রার নদ-নদীর সংযোগ। ফলে সাগরের নোনাপানি সরাসরি উপজেলার নদ-নদী ও ফসলের মাঠে চলে আসে। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে নোনা পানির মাত্রা বেড়ে যায়। পুকুরগুলোতেও থাকে নোনাপানি। টিউবওয়েলের পানিতেও আর্সেনিক ও আয়রনের উপস্থিতি থাকে বেশি। এদিকে পরিশোধন ছাড়া পুকুরের পানি খাওয়াও নিরাপদ নয় বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।

পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক নীতিশ গোলকার বলেন, এ অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট প্রকট। উপায় না পেয়ে মানুষ পুকুরের পানি পান করে। খোলা অবস্থায় থাকার কারণে এর মধ্যে অনেক ধরনের জীবাণু থাকে। পরিশোধনহীন এ পানি খেয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটের পীড়াসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতালে এ ধরনের রোগীর সংখ্যাই বেশি।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পাইকগাছা লোনাপানি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কেন্দ্রপ্রধান ড. মো লতিফুল ইসলাম বলেন, নদীমাতৃক বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম সুপেয় পানির আধার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুপেয় পানির আধার এখন ধুঁকছে। লবণাক্ততার প্রভাব পড়েছে পুরো উপকূলজুড়ে। সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে উপকূলের সব বয়সের মানুষ। লবণাক্ততা ফসল উৎপাদনেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পানির প্রবাহজনিত ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় সমুদ্রের নোনাপানি স্থলভাগের দিকে চলে আসে। ফলে জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের পানি বাড়ার কারণে নোনাপানি স্থলভাগে প্রবেশ করে। ধারণা করা হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে লবণাক্ততাও বাড়বে। কম বৃষ্টির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার প্রভাব আরও বেশি প্রভাব ফেলছে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলায়ও লবণাক্ততার সংকট প্রকট। সুপেয় পানির অভাবে দিশেহারা পাইকগাছার মানুষ

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যমতে, শুধু খুলনাঞ্চলে নয়, দেশের ৪১ জেলার ১৯২ উপজেলায় দেখা দিয়েছে তীব্র পানিসংকট। রাজধানীতে পানির স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ২১২ ফুট নিচে চলে গেছে। যে কারণে ভবিষ্যতে এখানকার পানিতে সমুদ্রের নোনাপানি চলে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইডের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের দুই কোটিরও বেশি মানুষ নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত৷ তাদের তথ্য অনুসারে—বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সী কমপক্ষে ৪ হাজার ১০০ শিশু মারা যায় নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশন সুবিধার অভাবে৷ এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি একাধিক সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে—দেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ অনেক এলাকায়ই শুরু হয়েছে মরুকরণ। কারণ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে।

অন্যদিকে সুপেয় পানির তীব্র সংকটে মানুষের ভরসার স্থল হয়ে উঠছে বৃষ্টির পানি। ইতোমধ্যেই খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয়রা নানাভাবে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে সারা বছর পান করছেন। তবে অনিরাপদভাবে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে খাওয়াতেও ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ বৃষ্টির পানিতেও কিছু ক্ষতিকর উপাদান থাকতে পারে। পরিশোধন করে খেলে এ পানি নিরাপদ। সুপেয় পানির অভাবে দিশেহারা পাইকগাছার মানুষ

এমন একটি নিরাপদ বৃষ্টির পানি শোধনাগারের দেখা মিলেছে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের মঠবাঢী জি জি পি জি দাখিল মাদ্রাসায়। মাদ্রাসাটিতে আগে কোনও সুপেয় পানির ব্যবস্থা ছিল না। যে টিউবওয়েলটি ছিল তার পানি পান করলেই পেটের পীড়ায় ভুগতো শিক্ষার্থীরা। বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারএইড ও নবলোক যৌথভাবে এখানে রেইন ওয়াটার হারভেস্ট করে শিক্ষার্থীদের জন্য সারাবছরের পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছে।

মাদ্রাসাটির প্রধান শিক্ষক এস এম আমিনুল ইসলাম বলেন, মাদ্রাসাটিতে ছাত্র-শিক্ষক মিলিয়ে ৩৬৫ জন রয়েছে। সবাই সারা বছর এখানে সংগ্রহ করা বৃষ্টির পানি পান করে। বাচ্চারা এখন ফিল্টার করা নিরাপদ পানি খায়। শিক্ষার্থীদের পানির কষ্ট এখন আর নেই।

হোসাইন আহম্মদ নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, বাড়ির পানির চাইতে মাদ্রাসার এই পানি অনেক ভালো, খেতে মজা। ফিল্টার করা বৃষ্টির এ পানি বাজারের মিনারেল ওয়াটার থেকেও ভালো। আমাদের বাড়িতেও যদি এই পানি পাওয়া যেতো তাহলে খুব ভালো হতো।

বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইডের প্রোগ্রাম অফিসার এম এম মমশাদ বলেন, দুটি ট্যাংকে এখানে ২০ হাজার লিটার বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করা যায়। বায়োলজিক্যাল ফিল্টারসহ কয়েক ধাপে পরিশোধনের পর শিক্ষার্থীরা এই পানি পান করে। বৃষ্টির মৌসুমে সংগ্রহ করা এই পানি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সারা বছর পান করে।

/এমএস/
সম্পর্কিত
বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির জন্য বাড়ছে হাহাকার
সাজেকে রিসোর্ট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানির সংকট, অপেক্ষা বৃষ্টির
পানির সংকট নিরসনে কাজ করবে ওয়াসার ১০ মনিটরিং টিম
সর্বশেষ খবর
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!