X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অমান্য করে শরীয়তপুর স্টেডিয়ামে মাসব্যাপী মেলার আয়োজন

রাজিব হোসেন রাজন, শরীয়তপুর
২১ জানুয়ারি ২০২৪, ২১:৫৭আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ২২:৫৯

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অমান্য করে ঐতিহ্যবাহী শরীয়তপুর জেলা স্টেডিয়ামে মাসব্যাপী বাণিজ্য মেলার আয়োজন করেছে জেলা প্রশাসন। খেলাধুলা বন্ধ রেখে স্টেডিয়ামের মাঠ ও আশপাশ ভেঙেচুরে দীর্ঘ সময়ের জন্য মেলা বসানোকে ঘিরে ক্রীড়াপ্রেমী ও স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। গত পাঁচ বছরে এখানে বড় ধরনের কোনও টুর্নামেন্টের আয়োজন না হলেও সকাল-বিকাল খেলাধুলা করতো শিক্ষার্থী। এখন সেটিও বন্ধ হয়ে গেলো। মেলা ঘিরে মাঠ ওলটপালট করে ফেলায় জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তাদের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খেলোয়াড়রা। মেলার পরে এই মাঠ আর সংস্কার হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা তাদের।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, মেলা, কনসার্ট ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কারণে আলোচনায় থাকে জেলা স্টেডিয়ামগুলো। এসব অনুষ্ঠানের কারণে প্রায়ই বন্ধ রাখতে হয় জেলার বিভিন্ন খেলাধুলা। দিনের বেলায় বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে স্টেডিয়ামের গেট। তালা ঝোলার কারণে বিকালে মাঠে গিয়ে খেলতে না পারায় অনেক ছেলেমেয়ে বাজে নেশায় আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। এই কারণে ৯ বছর আগে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছিলেন খেলার মাঠে অন্য কিছু যেন না হয়। জেলার স্টেডিয়ামগুলোতে শুধু খেলাধুলাই করবে ছেলেমেয়েরা। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে দেশের ৬৪টি জেলার ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি (ডিসি) বরাবর চিঠি দিয়েছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশনা মানেননি জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তারা। স্টেডিয়ামে খেলার পরিবর্তে মেলা, কনসার্ট, নানা আয়োজন হয়ে আসছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গত ১৫ মে নতুন করে আবারও ডিসিদের চিঠি পাঠিয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। 

মাঠ খুঁড়ে তোলা হচ্ছে ইটের দেয়াল

পরিষদের পরিচালক (ক্রীড়া) এস এম শাহ হাবিবুর রহমান হাকিম স্বাক্ষরিত চিঠিতে লেখা আছে, ‘সব স্টেডিয়ামে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছাড়া অন্য কোনও কার্যক্রম যেমন–মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কনসার্ট ইত্যাদি আয়োজন না করাই ভালো হবে।’ এর সঙ্গে মৌখিকভাবে ডিসিদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে করে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে স্টেডিয়াম খুলে দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে চিঠি ডিসিদের কাছে চলে গেছে। 

এরপরও শরীয়তপুর স্টেডিয়ামে মাসব্যাপী বাণিজ্য মেলার আয়োজন করেছে জেলা প্রশাসন। এই মেলা বসানোর অনুমতি দেওয়ার কথা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ। একইসঙ্গে মেলার বসানো নিয়ে কারা প্রশ্ন তুলেছেন জানতে চেয়েছেন তিনি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা শহরে খেলাধুলার জন্য কোনও মাঠ নেই। একটি মাত্র স্টেডিয়াম। জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে সেখানে মাঠ ভেঙেচুরে বাণিজ্য মেলা বসানোর আয়োজন চলছে। আগামী ২৮ জানুয়ারি থেকে মেলা শুরু হবে। ফলে দীর্ঘ এক মাস খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হবে সবাই। এই মাঠ কবে ঠিক হবে, আদৌ সংস্কার হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে খেলোয়াড়দের।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মেলার আয়োজন ঘিরে মাঠের চার পাশের অবকাঠামোর চিত্র বদলে ফেলা হয়েছে। ইটের ওয়াল দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে মেলার প্রবেশ ও নির্গমন পথ। মাঠ খুঁড়ে নির্মাণ করা হয়েছে পানির ফোয়ারা। মাঠের অধিকাংশ স্থানেই বিছানো হয়েছে ইট। আশপাশে দেয়াল তোলার কাজ চলছে। ক্রিকেট পিচের পাশে ইট ও সিমেন্টের ঢালাই দেওয়া হয়েছে। গোলবারের দুই পাশে ইটের ঢালাই দিয়ে দেয়াল তৈরি করা হচ্ছে। চার পাশে স্টল বসানোর জন্য ছোট ছোট কক্ষ তৈরি করা হচ্ছে। সবমিলিয়ে পুরো মাঠ ওলটপালট করে ফেলা হয়েছে। খোঁড়াখুঁড়ি দেখে মনে হচ্ছে, যেন উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে।

পিচের পাশে ইট ও সিমেন্টের ঢালাই দেওয়া হয়েছে

শরীয়তপুর শহরের ধানুকায় ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জেলা স্টেডিয়ামটি। দীর্ঘদিন উন্নয়ন না হওয়ায় বেহাল দশা হয়ে যায়। এ অবস্থায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে তিন কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি দ্বিতল ভবন, ২০০ ফুট গ্যালারি ও নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করে নতুন সাজে সাজানো হয়েছিল স্টেডিয়াম। এর নাম এখন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ লে. নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ স্টেডিয়াম। তবে গত কয়েক বছর ধরে এখানে বড় কোনও টুর্নামেন্টের আয়োজন করে জেলা ক্রীড়া সংস্থা। তবে মেলা আর সার্কাসের নিয়মিত ভেন্যু বসানো হয়। নিয়মিত খেলাধুলা করতে দেওয়া হয় না ছেলেমেয়েদের। ফলে জেলায় বড় মাপের কোনও খেলোয়াড় তৈরি হচ্ছে না। সর্বশেষ ১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত জাতীয় ফুটবল দলে খেলেছিলেন মোহাম্মদ রকিব। এরপর জাতীয় দল পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি আর কেউ। ফুটবলে তবু একজন আছেন, ক্রিকেটে নেই কেউ। অনূর্ধ্ব-১৯ দল পর্যন্ত খেলেছেন কেবল নাহিদ হাসান। তবে মাঝেমধ্যে ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল ও ব্যাডমিন্টন খেলতো শিশু-কিশোর এবং শিক্ষার্থীরা। সেটিও এখন বন্ধ।

এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে অনূর্ধ্ব-১৪ দলের সাবেক খেলোয়াড় রাকিব হোসেন বলেন, ‘আমরা আগে স্টেডিয়ামে খেলাধুলা করতাম। গত কয়েক বছর খেলাধুলা করতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে বছর বছর মেলা ও সার্কাস বসে। খেলাধুলায় আমাদের উদ্বুদ্ধ না করে জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও প্রশাসন ব্যবসার আয়োজন করে যাচ্ছে। এভাবে হলে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা থেকে দূরে সরে মোবাইল গেমে আসক্ত হয়ে যাবে।’

মাঠের অধিকাংশ স্থানেই বিছানো হয়েছে ইট

স্টেডিয়ামে বাণিজ্য মেলার আয়োজন কীভাবে হলো জানতে চাইলে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম বলেন, ‘আমরা স্টেডিয়ামে মেলার অনুমোদন দিতে পারি না। জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়েই বসানোর আয়োজন চলছে। অবশ্য জেলা প্রশাসক আমাকে বলেছিলেন, মেলার আয়োজন করতে চান, তখন আমি বলেছি ঠিক আছে, করেন স্যার। এখন আমাদের খেলাধুলার কোনও আয়োজন নেই, তাই মেলা বসানোর বিষয়ে আপত্তি জানাইনি। সামনে ভলিবল ও ব্যাডমিন্টন খেলার আয়োজন করবো। এখানে না করে, সে আয়োজন শরীয়তপুর ক্লাবের মাঠে করবো।’

খেলাধুলা বন্ধ রেখে মেলা বসানোর বিষয়ে কেন আপত্তি জানাননি এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুস সালাম বলেন, ‘আসলে জেলার মানুষের জন্য বিনোদনের কোনও ব্যবস্থা নেই। তারা যাতে কিছুটা হলেও বিনোদন পান, সেজন্য মেলার আয়োজন করেছে জেলা প্রশাসন। এছাড়া মাঠের উন্নয়নমূলক কাজ চলছে। অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। জেলা ক্রীড়া সংস্থার নিজস্ব কোনও তহবিল নেই। স্টেডিয়ামে মেলার আয়োজন করায় সংস্থার তহবিলে কিছুটা হলেও অর্থ আসবে। এতে মাঠের উন্নয়নকাজগুলো করে ফেলতো পারবো আমরা। মূলত এসব বিষয় বিবেচনা করে আমরা মেলা বসাতে বলেছি। সম্ভবত ২৮ জানুয়ারি থেকে মেলা শুরু হবে।’ 

চার পাশে স্টল বসানোর জন্য ছোট ছোট কক্ষ তৈরি করা হচ্ছে

খেলার মাঠে মেলা না বসানোর বিষয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোনও চিঠি পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে আব্দুস সালাম বলেন, ‘২০১৪ সালের দিকে একটা নির্দেশনা পেয়েছিলাম। নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, না পারতে মাঠে মেলার আয়োজন করা যাবে না। না করাই ভালো হবে। কিন্তু একেবারেই করা যাবে না, এমন নির্দেশনা তো দেওয়া হয়নি। এছাড়া এ বছর এখানে খেলাধুলার আয়োজন নেই। আমাদের কোনও ভেন্যুও দেওয়া হয়নি। আন্তঃজেলা খেলাধুলার আয়োজনের সূচি নেই। কারণ মাঠের উন্নয়নকাজ কাজ চলছে।’

মেলা বসানোর বিকল্প কোনও মাঠ ছিল না, মাঠ খুঁড়ে ফেলা হলো, পিচের পাশে ইট-সিমেন্টের ঢালাই, এতে পুরো মাঠ ক্ষতিগ্রস্ত হলো; এগুলো কবে কে সংস্কার করবে জানতে চাইলে আব্দুস সালাম বলেন, ‘মাঠ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এটা সত্য। তবে মেলার পর উন্নয়নকাজ করবো আমরা। এটা কোনও বিষয় না। যেহেতু পুরো মাঠে দুই ফুট করে মাটি ফেলে উঁচু করা হবে, সেহেতু দেয়ালের ইট তুলে মাটি দিলেই কাজ হয়ে যাবে। মেলার আয়োজন থেকে যে অর্থ পাবো, তা দিয়ে মাঠের সংস্কারকাজ শুরু করবো আমরা।’

সবমিলিয়ে পুরো মাঠ উলটপালট করে ফেলা হয়েছে, খোঁড়াখুঁড়ি দেখে মনে হচ্ছে, যেন উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষা করে খেলার মাঠে মেলা বসানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ বলেন, ‘সারা দেশে মেলাগুলো খেলার মাঠেই হয়। খেলার মাঠে মেলার আয়োজন করা যাবে না, এমন কোনও বিধিনিষেধ নেই। এমন নির্দেশনা আপনারা পেলেন কোথায়? কারা মেলার আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তাদের খুঁজে বের করতে চাই। তারা এসব নির্দেশনা পেলো কোথায়? আশপাশের বহু জেলায় খেলা মাঠে মেলা বসে। খেলার মাঠে না বসলে মেলা বসবে কোথায়? ধানক্ষেতে? মেলা যেকোনো খেলার মাঠেই বসে। আমিই বসার অনুমোদন দিয়েছি, সবকিছু বিবেচনা করেই দিয়েছি। স্টেডিয়ামের মাঠে মেলার সব প্রস্তুতি চলছে। সেখানেই মেলা হবে।’

/এএম/
সম্পর্কিত
পুণ্যস্নানে হাজারো ভক্তের ভিড়, জমজমাট লোকজ উৎসব
ফাইনালে ১১ মিনিট লড়াই, জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন বাঘা শরীফ
প্রস্তুত বলী খেলার মঞ্চ, বসেছে মেলা
সর্বশেষ খবর
এসি বিক্রি বেড়েছে তিনগুণ, অনেক ব্রাঞ্চে ‘স্টক আউট’
এসি বিক্রি বেড়েছে তিনগুণ, অনেক ব্রাঞ্চে ‘স্টক আউট’
কুমিল্লার স্কুলে স্কুলে ‘পানির ঘণ্টা’ চালুর নির্দেশ
কুমিল্লার স্কুলে স্কুলে ‘পানির ঘণ্টা’ চালুর নির্দেশ
এপি'র সাংবাদিককে গ্রেফতার করলো রাশিয়া
এপি'র সাংবাদিককে গ্রেফতার করলো রাশিয়া
পূর্বাচল-ঝিলমিল বসবাসের উপযোগী না হওয়ায় সংসদীয় কমিটির অসন্তোষ
পূর্বাচল-ঝিলমিল বসবাসের উপযোগী না হওয়ায় সংসদীয় কমিটির অসন্তোষ
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে