X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

অন্ধকারে আলো জ্বালিয়েছে ৩ কিশোরী, গল্পটা একই

আতাউর রহমান জুয়েল, ময়মনসিংহ
২৮ এপ্রিল ২০২২, ১৭:৩৩আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২২, ১৮:২২

প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে বেড়ে ওঠা। অন্ধকারে আলো জ্বালিয়েছে তারা। প্রত্যেকেই যেন আলোর শিখা। তাদের মধ্যে দারুণ মিল রয়েছে। তিন জন একই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নারী ফুটবলার। দারিদ্র্যের সঙ্গে জন্ম থেকেই সংগ্রাম। বেড়ে ওঠার গল্পটাও একই।

তাদের আরও মিল হলো, তিন জনের থাকার ঘর নেই, বাবা দিনমজুর। খেয়ে না খেয়ে খেলাধুলা শিখতে হয়েছে। গ্রাম থেকে দূরে গিয়ে খেলাধুলা করতে হয়েছে। সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চলতে হয়েছে। পরিবারকে প্রতিবেশীদের কটূক্তি শুনতে হয়েছে। তবু হার মানেনি। এবার ফুটবলের প্রশিক্ষণ নিতে পর্তুগালে যাচ্ছে। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন রয়েছে এই তিন কিশোরীর।

বলছিলাম ময়মনসিংহের নান্দাইলের প্রত্যন্ত অঞ্চল পল্লিগ্রামের মেয়ে স্বপ্না, তানিশা ও শিখার সাফল্য গাঁথার কথা। ২০১৯ সালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট থেকে তাদের সফলতার শুরু। সেবার টুর্নামেন্টে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয় নান্দাইল উপজেলার শেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। চ্যাম্পিয়ন দলে ছিল স্বপ্না, তানিশা ও শিখা।

সিনহা জাহান শিখা উপজেলার শেরপুর ইউনিয়নের রাজাবাড়িয়া গ্রামের বিপ্লব মিয়ার মেয়ে, স্বপ্না আক্তার জিলি শেরপুর ইউনিয়নের ইলাশপুর গ্রামের ফয়জুউদ্দিন ও তানিয়া আক্তার তানিশা মোয়াজ্জেমপুর ইউনিয়নের কুতুবপুর গ্রামের দুলাল মিয়ার মেয়ে। তারা বর্তমানে নান্দাইল পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।

স্বপ্নবাজ তিন কিশোরীর পর্তুগাল যাওয়ার খবরে এলাকায় আনন্দের বন্যা বইছে। আগে যারা তাদের নিয়ে খারাপ মন্তব্য করতেন এখন তাদের মুখেই কিশোরীদের সফলতার গল্প। গ্রামের সবার মুখে এখন তাদের প্রশংসা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ ক্রীড়া পরিদফতরের উদ্যোগে বঙ্গমাতা নারী ফুটবলের সেরা ৪০ খেলোয়াড়কে নিয়ে বিকেএসপিতে দুই মাসের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। ৪০ জনের মধ্য থেকে ১৭ জনকে বাছাই করা হয়। বাছাইকৃতরা আগামী জুলাই মাসে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর দেশ পর্তুগালে যাবে। এদের ১১ জন মূল দলে আর ছয় জন অতিরিক্ত। তারা সেখানে গিয়ে ফুটবলের প্রশিক্ষণ নেবে। শিখা, স্বপ্না খেলবে মূল দলে আর তানিশা অতিরিক্ত ছয় জনের মধ্যে রয়েছে।  

সিনহা জাহান শিখা

শিখার বাবা বিপ্লব মিয়া টমটম চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে শিখা তৃতীয়। বড় বোন সুমাইয়া আক্তারের বিয়ে হয়েছে। মেজো বোন রিতা আক্তার শহীদ স্মৃতি আদর্শ সরকারি কলেজে পড়ে। শিখা নান্দাইল পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ও তার ছোট ভাই স্বাধীন ইমাম হোসেন নান্দাইল উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে।  

পাঁচরুখী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় শিখার মা মঞ্জিলা মারা যান। সেই থেকে নানির বাড়িতে থাকে। শিখার বাবার বাড়ি জাহাঙ্গীরপুর ইউনিয়নের দেউলডাংরা গ্রামে। মা মারা যাওয়ার পর বাবা বিপ্লব আরেকটি বিয়ে করেন। থাকেন নিজ বাড়ি জাহাঙ্গীরপুরে। সন্তানদের ভরণপোষণের খরচ দেন, নেন খোঁজখবরও। শিখা ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলায় আগ্রহী। ফুটবল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতো। সে থেকেই কোচ প্রশিক্ষক মগবুল হোসেনের মাধ্যমে উপজেলা, জেলা, বঙ্গমাতা গোল্ডকাপসহ বিভিন্ন পর্যায়ের খেলাধুলায় অংশ নেয়। খেলে লেফট উইং পজিশনে।

শিখা জানিয়েছে, ‘সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মফস্বল এলাকায় আমি থাকি। সদরে প্রতিদিন প্র্যাকটিস করতে যেতাম। এতে আসা-যাওয়ায় ৭০ টাকা খরচ হতো। এই টাকা বাবা ও নানা ডিম বিক্রি করে দিতেন। অনেক কষ্টে এই পর্যন্ত এসেছি। যে টাকা দিতো ওই টাকা গাড়ি ভাড়ায় চলে যেতো। খাওয়ার কিছুই থাকতো না। অনেক সময় পান্তাভাত খেয়ে খেলাধুলা করতে হয়েছে। পর্তুগালে প্রশিক্ষণ শেষে জাতীয় দলে খেলার ইচ্ছা আমার। এজন্য সবার কাছে দোয়া চাই।’

তানিয়া আক্তার তানিশা

তানিশার বাবা দিনমজুর। সংসারে এক ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে কষ্টে দিন পার করতে হয়। একটি টিনের ভাঙা ঘর ছাড়া কিছু নেই। বড় ছেলে ইয়াছিন আরাফাত আচারগাঁও ফাজিল মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। তানিশা তার চাচা আনিসুর রহমানের ঘরে থাকে। স্থানীয় কুতুবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে বর্তমানে নান্দাইল পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।

তানিশা ২০১৭ সালে মায়ের সঙ্গে নান্দাইলে শপিং করতে গিয়েছিল। তখন চন্ডিপাশা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে খেলোয়াড়দের প্র্যাকটিস দেখে খেলার প্রতি আগ্রহ বাড়ে। পরে প্রশিক্ষণ কোচ মকবুল হোসেনের সঙ্গে কথা বলে প্র্যাকটিস শুরু করে। অসহায় বাবা দুলাল মিয়া কষ্টে মেয়ের জন্য টাকা জোগাড় করে রাখতেন। মাঝেমধ্যে টাকা না থাকলে প্র্যাকটিসে যাওয়া হতো না তানিশার।

তানিয়া আক্তার তানিশা জানায়, ‘খেলাধুলা করতে গিয়ে অনেকের রোষানলে পড়েছি। ২০১৮ সালে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপে ভালো খেলেছি। এখন পর্তুগালে যাচ্ছি। খুব ভালো লাগছে। আমার বাবা দিনমজুর। আমাদের থাকার ঘর নেই। টাকা আয় করে একটি ঘর বানাতে চাই। মায়ের গলায় সমস্যা। অপারেশন করাতে হবে। এখন তো খেতেই পারি না ঠিকমতো, ঘর-চিকিৎসা তো দূরের কথা। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে এসে জাতীয় দলে খেলতে চাই।’

স্বপ্না আক্তার জিলি

জিলির বাড়ি উপজেলা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে শেরপুর ইউনিয়নের ইলাশপুর গ্রামে। বাবা ফয়জুউদ্দিন ফকির কৃষিকাজ ও শ্রমিকের কাজ করেন। সংসারের তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে স্বপ্না ষষ্ঠ। বড় বোন বাসনা আক্তার, শাবানা আক্তার ও বড় ভাই রায়হান মিয়া গার্মেন্টসে চাকরি করেন। আরেক বোন রোজিনার বিয়ে হয়েছে। এখন বাড়িতেই থাকেন। ছোট ভাই আবু নাঈম মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। স্বপ্না নান্দাইল পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ভাই রোহান থাকে বাড়িতে।

শেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিদ্যালয়ে বড়দের ফুটবল খেলা দেখতো। তা দেখে ফুটবল খেলার আগ্রহ বাড়ে তার। স্কুলের সহকারী শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন উজ্জলকে খেলার আগ্রহের কথা জানালে তিনি সুযোগ করে দেন। স্বপ্না আক্তার জিলি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। সংসারের খরচ জোগাতে বাবা ফয়জুউদ্দিনের অনেক কষ্ট হয়। কষ্টের কথা ভেবে তিন সন্তান চাকরি করেন গার্মেন্টেসে। এ পর্যন্ত আসার পেছনে রয়েছে তার অনেক কষ্টের গল্প। প্রতিদিন নান্দাইল এসে প্র্যাকটিস করতে হয়। দুই কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা হেঁটে ১২ কিলোমিটার গাড়িতে করে আসা-যাওয়ায় খরচ হয়েছে ৭০ টাকা। ওসব খরচ বহন করেছেন বাবা।

স্বপ্না আক্তার জিলি জানায়, ‘আমি অনেক কষ্টে এই পর্যন্ত এসেছি। প্র্যাকটিস করতে আসার টাকা পর্যন্ত জোগাতে কষ্ট হয়েছে। কিছুদিন আগে টাকার অভাবে প্র্যাকটিস করতে যেতে পারিনি। এতে অনেকদিন খেলা বন্ধ ছিল। পরে স্থানীয় এমপিকে জানালে তিনি একটা ব্যবস্থা করে দেন। আমি পর্তুগাল ও স্পেনে যাচ্ছি প্রশিক্ষণে। ফিরে এসে জাতীয় দলে খেলতে চাই।’

এ বিষয়ে তিন কিশোরীর প্রশিক্ষক মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমি তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। প্রশিক্ষণের ফলেই তারা এ পর্যন্ত আসার সুযোগ পেয়েছে। আমি তাদের সাফল্য কামনা করছি।’

নান্দাইল পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল খালেক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বিদ্যালয়ের কৃতি তিন ফুটবল খেলোয়াড় প্রশিক্ষণ নিতে পর্তুগাল যাচ্ছে। এটি গর্বের বিষয়। আমি তাদের সবসময় বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছি। তারা ভালো করুক, সেই প্রত্যাশা করি।’

/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা