‘আহেন ভাই, একটা খাইয়া যান। একবার খাইলে আরেকবার খাইতে মন চাইবো। মাত্র পাঁচ টাহায় ছিইল্ল্যা-কাইট্ট্যা লবন লাগাইয়া দিমু। বরিশাইল্ল্যা আমড়া, খাইয়া খালি কামড়া। জয় বরিশাল্যা আমড়া।’
বরিশাল নগরীর কীর্তনখোলা তীরের মুক্তিযোদ্ধা পার্কে দাঁড়িয়ে ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন স্থানীয় আমড়া বিক্রেতা হানিফ মিয়া। কেবল মুক্তিযোদ্ধা পার্ক নয়, শহরের বিনোদনের কেন্দ্রগুলোতে ঘুরে ঘুরে আমরা বিক্রি করছেন হানিফ মিয়ার মতো অসংখ্য মৌসুমি হকার।
আরেক আমড়া বিক্রেতা কাউখালী উপজেলা সদরের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেনের কাছে দেখা গেল, কাঠিতে লাগানো আমড়া ছাড়াও ছোট ছোট পনলিব্যাগেও তিনি আমড়া ভরে রেখেছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেকেই আমড়া কিনতে এসে খুব তাড়াহুড়া করেন। তাদের জন্যই এসব প্যাকেট বানিয়ে রেখেছি।’
ইসমাইলের কাছেই জানা গেল, ভ্রাম্যমাণ আমড়া বিক্রেতাদের অধিকাংশই মৌসুমি হকার। মৌসুমি ফলের ব্যবসায় লাভ বেশি হওয়ায় তারা যখন যে ফলের মৌসুম, তখন সেই ফল ফেরি করে বিক্রি করেন। এখন আমড়ার মৌসুম চলছে, তাই তারা আমড়া বিক্রি করছেন।
হানিফ বা ইসমাইলদের মতো ভ্রাম্যমাণ হকারদের মুখে আমড়া বিক্রি করে হাসি ফুটলেও বরিশাল এলাকার আমড়া চাষিদের মুখে সেই হাসির রেখাটি বিস্তৃত নয়। চাষিরা বলছেন, কৃষি অধিদফতরও বলছে, বরিশালে এবার আমড়ার বাম্পার ফল হয়েছে। আর সে কারণেই এবারে আমড়ার দাম তুলনামূলকভাবে কম। তাছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেও আমড়া বেচাকেনার মুনাফার পুরোটা ঢোকে না চাষিদের পকেটে। সে কারণেই আমড়া চাষিরা বাম্পার ফলনে খুশি হয়েও যেন খুশি নন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, আমড়া বরিশাল অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। এখানকার বেশিরভাগ বাড়িতেই আমড়ার গাছ আছে। প্রতিবছরই আমড়ার ফলনের দিক থেকে বরিশাল যেমন এগিয়ে থাকে সারাদেশে, তেমনি মিষ্টি স্বাদের জন্যও বরিশালের আমড়া সারাদেশেই একনামে পরিচিত। চলতি মৌসুমেও বরিশাল অঞ্চলে এই আমড়ার বাম্পার ফলন হয়েছে।
বাড়িতে বাড়িতে দুয়েকটা করে আমড়ার গাছ ছাড়াও বরিশাল অঞ্চলের অনেকেই পতিত জমি কেটে আইল তৈরি করে, আবার কেউ ফসলি জমিতেও বড় বড় আমড়ার বাগান তৈরি করেছেন। কোনও কোনও চাষির বাগান থেকে বছরে লাখ টাকা আয় হচ্ছে আমড়া বিক্রি করে।
আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের হিসাবে,এ বছর এ অঞ্চলে ১ হাজার ৩৩৯ হেক্টর জমিতে আমড়া চাষ হয়েছে। আনুমানিক ফলন হবে ১৯ হাজার ৮৯৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে বিভাগের পিরোজপুরের স্বরুপকাঠির আটঘর-কুড়িযানা জিন্দাকাঠি, নাজিরপুর এবং ঝালকাঠি সদরের ভিমরুলী ও কাউখালী উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে আমড়ার চাষ হচ্ছে।
সাধারণত মাঘ-ফাল্গুন-চৈত্র মাসে আমড়া গাছে মুকুল ধরে। আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র- আশ্বিন মাসে পাওয়া যায় পাকা আমড়া। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকায় আমড়া কেনা-বেচার বেপারি রয়েছে। তারা ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে কুড়ি দেখেই আগাম টাকা দিয়ে বাগান কিনে নেন। আবার অনেক চাষি নিজেরাই ভরা মৌসুমে আমড়া বিক্রি করেন।
বরিশাল আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক রামেন্দ্রনাথ বাড়ৈই বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছর আমড়ার ফলন শতকরা ১০-১৫ ভাগ বেশি হওয়ায় দামও কিছুটা কম।’
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব জেলা-উপজেলাতেই পৌঁছে যায় বরিশালের আমড়া। তবে অনেকেই বরিশালের আমড়ার কথা বলে অন্য এলাকার আমড়াও বিক্রি করেন।
কাউখালী উপজেলার প্রধান বন্দর, লঞ্চঘাট, দক্ষিণ বাজারসহ বিভিন্ন বড় বাজারে রয়েছে আমড়ার অসংখ্য আড়ত। পাইকাররা আড়ত থেকে আমড়া কিনে ঢাকা, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মেঘনাঘাট এলাকায় চালান করেন।
তবে আমড়া ব্যবসায় মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে চাষিরা মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন কাউখালী এলাকার আমড়া চাষি হোসেন আলি। তিনি বলেন, পাইকাররা এক বস্তা আমড়া ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় কিনে কাউখালী মোকামে বিক্রি করেন ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায়।
স্বরুপকাঠির আমড়া ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন জানান, গত বছর আমড়ার দাম ছিল মণপ্রতি ১৮০০-২০০০ টাকা। ফলন বেশি হওয়ায় এবার তা ৯০০-১১০০ টাকায় নেমে এসেছে।
জিন্দাকাঠির আমড়া চাষি গোকুল মজুমদার বলেন, ‘গত বছর তিন একর জমিতে আমড়া চাষ করে ১৫ লাখ টাকার আমড়া বিক্রি করেছি। এ বছরে ১০ লাখ টাকা আয় করাই মুশকিল।’
কাউখালীর ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আড়ত থেকে ঢাকা বা মুন্সীগঞ্জে এক বস্তা আমড়া পৌঁছাতে খরচ হয় ২১০ থেকে ২১৫ টাকা। এরপর আড়তে বিক্রয় মূল্যের শতকরা ১০ ভাগ আড়তদারি দিতে হয়। প্রতিটি বস্তায় ৮০০ আমড়া ধরে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটে এবার প্রতিবস্তা আমড়া বিক্রি হচ্ছে ১৫০০-১৬০০ টাকা। সব হিসাব করে এর চেয়ে কম দামে আমড়া বিক্রি করা যাচ্ছে না।’