মহান স্বাধীনতা দিবস এলেই বাঁধ ভাঙে চোখের জল, স্মৃতিকাতরতায় ডুবে যান, ঘুমহীন সময় কেটে যায় অস্থিরতায়, সহযোদ্ধাদের স্মৃতি হাতড়ে ফেরেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় দশম শ্রেণির ছাত্র কিশোর মুক্তিযোদ্ধা নবীউর রহমান পিপলুর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘প্রতিটি স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসের হাতছানি এলেই যুদ্ধদিনের স্মৃতিকাতরতায় সময় কেটে যায়। সহযোদ্ধাদের কথা মনে পড়ে। চোখের সামনে সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর দৃশ্য জীবন্ত হয়ে উঠলে দু’চোখে কান্নার বান ডাকে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে তখন।’
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে এভাবেই কথা বলেছেন নাটোর শহরের আলাইপুর এলাকার বাসিন্দা নবীউর রহমান পিপলু। জেলা হাসপাতালের তৎকালীন কর্মচারী রশিদুর রহমান এবং নূরুননেছা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন জিন্নাহ স্কুল (বর্তমানে নাটোর সরকারি বালক বিদ্যালয়)-এর দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন পিপলু। দরজায় কড়া নাড়ছিল এসএসসি পরীক্ষা। কিন্তু সব পিছুটানকে উপেক্ষা করে কিশোর বয়সেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি।
কিশোর মুক্তিযোদ্ধা নবীউর রহমান পিপলু বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে এবং পরিবারের সবার উৎসাহে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধের মাঠেই ছিলাম।
এক প্রশ্নের জবাবে পিপলু বলেন, ‘১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নাটোরে প্রবেশ করে। তাদের ভারী অস্ত্রের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হন মুক্তিযোদ্ধারা। সেসময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভারতে চলে যাই। এরপর ট্রেনিংয়ে অংশ নেই।’
এ ব্যাপারে পিপলু বলেন, ’প্রথমে পশ্চিম দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটের কামারপাড়া কুড়মাইলে পাবনার বেড়া এলাকার তৎকালীন এমসিএ অধ্যাপক আবু সাঈদ পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণ নেই। এসময় বগুড়া নট্রামসের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল মান্নানের সঙ্গে পরিচয় হয়। ওই ক্যাম্পে মাঝে মাঝে হাজির হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দিতেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের শক্তিমান অভিনেতা হাসান ইমাম, আনোয়ার হোসেন, জাফর ইকবাল ও অভিনেত্রী কবরী। এরপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের রায়গঞ্জ সেনা ক্যাম্পে যাই এবং পরবর্তীতে দার্জিলিং জেলার শিলিগুলির পানিঘাটা (বাগডোকরা) ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেই। এসব ক্যাম্পে গেরিলা, অ্যাডভান্স ও জেএলসি (জুনিয়র লিডার কোর্স) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রশিক্ষণ শেষে রায়গঞ্জের পতিরামপুর (গঙ্গারামপুর) এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দেই। সেসময় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান ওই ক্যাম্প পরিদর্শন করে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করেন।’
যুদ্ধদিনের স্মৃতির ব্যাপারে পিপলু জানান, মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের অধীনে গঠিত তুফানি ব্যাটেলিয়ানের ( ব্রেভো সেক্টর) সদস্য হিসেবে বালুরঘাটের সীমান্ত এলাকার অযোধ্যায় মাটির নিচে বাংকার করে ওই ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। সেসময় তুফানি ব্যাটেলিয়নের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন ভারতীয় সেনা সদস্য মেজর মতিলাল চৌধুরী। তার কমান্ডে মিত্র বাহিনীর সঙ্গে সেকসন কমান্ডার ছিলেন বগুড়ার এরুলিয়া গ্রামের জাকারিয়া তালুকদার। জাকারিয়ার নেতৃত্বে মিত্র বাহিনীর সঙ্গে হিলি, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট ও গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ হয়ে বগুড়া অঞ্চল এবং নওগাঁয় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযোদ্ধা নবীউর রহমান পিপলু বলেন, ‘যুদ্ধের একদিনের কথা এখনও মনে পড়ে। অযোধ্যা ক্যাম্প থেকে রাত্রিতে ভারতীয় সেনা সদস্য সুবেদার দেলবর সিংয়ের নেতৃত্বে আমিসহ ২০-২৫ জনের মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নওগাঁ সীমান্তের ফার্সিপাড়া-নওগাঁ রাস্তার ব্রিজ ধ্বংস করাসহ গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিতে রওনা হই। তীব্র শীতের রাতে রওনা হওয়ার পর পথে একটি নদী পড়ায় থামতে হয় সবাইকে। কমান্ডারের নির্দেশে বিবস্ত্র হয়ে নদী পার হতে বাধ্য হলাম। নদীটি পার হয়ে ফার্সিপাড়া ব্রিজের কাছাকাছি যেতেই আচমকা পাকসেনাদের আক্রমণের মুখে পড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। যুদ্ধকালীন বিশেষ সাংকেতিক শব্দ প্রয়োগ করে আবারও একত্রিত হলেও কমান্ডারের নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছিল না। বিক্ষিপ্তভাবে গোলাগুলি চলছিল। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের আনুমানিক অবস্থানে নিশানা করে ৬ ইঞ্চি মর্টার শেল নিক্ষেপ করি। পিছু হটতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি সেনারা। সেসময় তারা দু’টি জিপ গাড়ি ফেলে যায়। গাড়ি দু’টিতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যাই আমরা।’
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম প্রতিরোধের ব্যাপারে পিপলু বলেন, ‘২৫ মার্চ কালোরাতের পর নাটোরের রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, আদিবাসী, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা নাটোরের ট্রেজারির অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র লুট করে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজের তৎকালীন ছাত্রাবাসে (বর্তমান রাণী ভবানী মহিলা কলেজ চত্বর) মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষক হিসেবে এগিয়ে আসেন সে সময়ে নাটোর মহকুমা খাদ্য কর্মকর্তা পাবনার ক্যাপ্টেন হাবিবুর রহমান। তাকে সহায়তা করেন আনসার এবং পুলিশ সদস্যরা। কাঠের রাইফেল (ডামি অস্ত্র) দিয়ে চলতে থাকে প্রশিক্ষণ।’ অন্যান্যদের সঙ্গে ওই প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন বলেও জানান পিপলু।
এ ব্যাপারে তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান জানা আর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য শহরের কান্দিভিটা এলাকার রিক্রেয়েশন ক্লাবে স্থাপন করা হয় কন্ট্রোল রুম। হানাদার বাহিনীর নাটোরে আসার সংবাদে গড়ে তোলা হয় প্রতিরোধ। বিভিন্ন প্রবেশ পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। তৎকালীন মিনার সিনেমা হলের মোড়ে ( বর্তমানের ছায়বাণী সিনেমা হল) তেলের বড় বড় ড্রাম ও বাঁশ দিয়ে বেরিকেড তৈরি করা হয়। আর পার্শ্ববর্তী ভবনের ছাদে তীর-ধনুকসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পাহারার ব্যবস্থাও করা হয়।’
এরপর দ্রুত বদলাতে থাকে দৃশ্যপট। ২৯ মার্চ বহর নিয়ে নাটোরের দিকে এগিয়ে আসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে আগে থেকেই এ সংবাদ পেয়ে যান মুক্তিযোদ্ধারা। প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেন তারা। ঈশ্বরদী হয়ে রাজশাহী যাওয়ার পথে গোপালপুর রেলস্টেশনে বাধাপ্রাপ্ত হয় পাকিস্তানি বাহিনী। এসময় তারা লালপুর উপজেলার ময়না গ্রামের দিকে এগুতে থাকে। খবর পেয়ে ঈশ্বরদীর ইপিআর বাহিনী এবং নাটোরের পুলিশ ও আনসার সদস্যসহ শত শত মুক্তিকামী মানুষ বন্দুক, রাইফেল সহ দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ময়না গ্রামে পাক সেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধ শেষে ৩০ মার্চ পিছু হটে পাকিস্তানি সেনারা। এই যুদ্ধে নাটোরের নীচাবাজার এলাকার মঙ্গলাসহ অন্তত ৪০ জন বাঙালি শহীদ হন। তবে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেলেও পাকিস্তানি বাহিনীর ওই রেজিমেন্টের কমান্ডার রেজা খানসহ ৯ সেনা জনতার হাতে ধরা পড়লে তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে পিপলু জানান, পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় নাটোর ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ২ নম্বর সামরিক হেড কোয়ার্টার। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা নাটোরে প্রবেশ করতে পারছিল না। একারণে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর বিভিন্ন এলাকায় নাটোরের মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান পরিচালনা করেন। আর এই সুযোগে অসংখ্য মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ২৭ মার্চ তৎকালীন নাটোর টাউন পার্কে (বর্তমানের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ) সর্বদলীয় এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এসময় ন্যাপের প্রয়াত নেতা খন্দকার আবু আলীকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। শুরু হয় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কাজ। পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধের জন্য আগ্রহী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ১৩ এপ্রিল ব্যাপক গোলাবর্ষণ ও রকেট শেল নিক্ষেপ করে নাটোর শহরে প্রবেশ করে পাকসেনারা। তাদের ছোড়া রকেট শেল কাপুরিয়াপট্টি এলাকার রবি বসাকের বাড়িতে পড়লে তার স্ত্রীর দেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। শহরে প্রবেশের পর পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। এসময় অবাঙালিদের সহায়তায় শহরে বাঙালিদের বাড়ি-ঘরে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসময় ডা. হেম চন্দ্র বসাক (যিনি বলাই ডাক্তার নামে পরিচিত ছিলেন) আহতদের চিকিৎসার জন্য নাটোর সদর হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু হানাদার বাহিনী তাকে হাসপাতাল থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এসময় আরও হত্যা করা হয় শ্রী মন্মথ প্রামানিক, মুকুন্দ লাল চৌধুরী, ডা. রেবতী স্যানাল, জীবন কৃষ্ণ মানি, ভাদু, গোপাল, হারানসহ অনেক ব্যক্তিকে।
জানা যায়, পিপলুর পরিবারের ১১ ভাইবোনের মধ্যে এখন বেঁচে আছেন ১০ জন। বাবাকে ১৯৮৯ সালে ও মাকে হারিয়েছেন ২০১৫ সালে।
নবীউর রহমান পিপলু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বাবা নিজেও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ভারতে থাকার সময়ে তিনি জলঙ্গির চিকিৎসালয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। যে বাবা নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, যে বাবা আমাকে যুদ্ধে যেতে উৎসাহী করেছেন, সেই বাবার নাম আজও তালিকাভুক্ত হয়নি। এটিই আমার সবচেয়ে বড় কষ্ট’।
এ ব্যাপারে নাটোর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার শেখ মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘পিপলু একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ছাত্র থাকা অবস্তাতেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন।’