১৪ বছরের কিশোরী তাসমিনা। এক হাতে থাকে লাগাম, অন্য হাতে চাবুক আর দু’চোখ জুড়ে স্বপ্ন প্রথম হওয়ার। এরই মধ্যে ‘দ্য-হর্স গার্ল’ খ্যাত এই কিশোরী ঘোড়দৌড়ে বেশ নাম করেছে। বাজি ধরে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয় তাসমিনা। ছেলেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেও প্রথম স্থান ছিনিয়ে আনছে সে। নিজের ঘোড়া না থাকার পরও অপ্রতিরোধ্য তাসমিনা। কিন্তু দারিদ্র্য এই কিশোরীর চলা পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তাই তার আকুল আবেদন, ‘আমাকে কি কেউ একটা বড় ঘোড়া কিনে দেবেন?’
বাড়িতে ঘোড়া ছিল,তাই ছোটবেলা থেকে খেলার ছলে ঘৌড়দৌড় শেখে তাসমিনা। সেই ঘোড়া এখন নেই। কিন্তু, দরিদ্র পরিবারটির আয়ের সম্বল হয়ে উঠেছে সে। দরিদ্রতাকে জয় করতে পারলেই সে হয়ে উঠতে পারে দেশে নারী খেলোয়াড়দের পথিকৃত।
তাসমিনাকে আত্মপ্রত্যয়ী ও সাহসী করে গড়ে তুলতে কাজ করছেন তার বাবা-মা। তাসমিনার মা তহুরা বেগম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই মেয়ের ঘোড়ার শখ ছিল। ছোট একটা ঘোড়াও ছিল বাড়িতে। মেয়ে একদিন ওই ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে। দিনে দিনে ওর ভয় ভেঙে যায়। কিন্তু অভাবের কারণে ঘোড়াটি তাসমিনার বাবা বিক্রি করে দেন। পরে স্থানীয় লোকজন মেয়ের ঘোড়া চালানোর প্রতিভা দেখে বাকিতে ময়মনসিংহ থেকে ২০ হাজার টাকায় একটা ঘোড়া কিনে দেয়। এরপর যেখানেই প্রতিযোগিতা হয় সেখানেই মেয়েকে নিয়ে যায় তার বাবা। প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সব জায়গায় মেয়ে প্রথম হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, তাসমিনা এ পথ ধরে আরও বহুদূর যেতে চায়। মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখলেও তার স্বপ্ন পূরণে দরিদ্র পরিবারটির সামর্থ্য নেই। তাই মেয়ের লেখাপড়ায় সমাজের বিত্তবান ও সরকারের সহযোগিতা চান তিনি।
তাসমিনার বাবা ওবায়দুল হক বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে একমুঠো ভাত খেয়ে ঘোড়ার পিঠে ওঠে তাসমিনা। দুপুরে এসে দুটো খেয়ে আবার ঘোড়া নিয়ে বের হয়। সারাদিন ঘোড়ার পিঠেই থাকে। তার একটা বড় ঘোড়া চাই। আমরা গরিব মানুষ। ভিটে ছাড়া কিছুই নেই। কৃষিকাজ করি। বড় ঘোড়ার দাম অনেক। কোথায় পাবো? মেয়ে অন্য মানুষের বড় ঘোড়া চালায়।’
তিনি আরও বলেন, তিন বছর আগে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে মেয়েকে নিয়ে প্রতিযোগিতায় যান। একটি ঘোড়া জিতিয়ে দিয়ে মেয়ে টেলিভিশন পুরস্কার পেয়েছিল। কিন্তু ঘোড়ার মালিক সেই পুরস্কার নিয়ে নিলেন। মেয়ের মন খারাপ হয়ে গেলো।
নওগাঁ জেলা স্টেডিয়ামে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা হয় তাসমিনার। সে জানায়, শুধু দেশে না, দেশের বাইরেও প্রথম হতে চায় সে। বাবার ঘোড়া কেনার টাকা নাই, তারপরও সে বড় হয়ে ঘোড় সওয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। বড় হয়ে পুলিশের চাকরি করতে চায় সে। কারণ, স্কুলের শিক্ষকের কাছে সে শুনেছে, পুলিশে ঘোড় সওয়ার নামের পদ রয়েছে। সেখানে সে যোগ দিতে চায়। ঘোড়া চালিয়ে সে বিদেশের মাটি থেকেও দেশের সম্মান বয়ে নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখে। তাই যে কোনও মূল্যে তার একটি বড় ঘোড়া চাই। এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে দিন পার করছে সে।’ কথা প্রসঙ্গে তাসমিনা বলে, ‘আমাকে কি কেউ একটি বড় ঘোড়া কিনে দেবেন?’
তাসমিনাকে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘অশ্বারোহী তাসমিনা’ অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ফর চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়াং পিপলস-এ দেখানোর পর বিশ্বব্যাপী সে পরিচিতি পেয়েছে। প্রামাণ্যচিত্রটি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছে।
নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার পূর্বচকসুবল গ্রামের ওবায়দুল হকের মেয়ে তাসমিনা। সে উপজেলার শংকরপুর উচ্চ বিদ্যালয় ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
এ বিষয়ে নওগাঁর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদের সভাপতি ডিএম আবদুল বারী বলেন, সব প্রতিযোগিতায় তাসমিনাকে দেখতে মানুষের বিশেষ আগ্রহ দেখা গেছে। মেয়েটি যেভাবে ঘোড়া চালায় তা সত্যিই বিস্ময়কর। তাসমিনার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, পুরুষ শাসিত সমাজে তাসমিনার মতো মেয়েটি সাহসের প্রতীক। তাসমিনাকে যদি সরকারি অথবা বেসরকারিভাবে সহযোগিতা করা হয় তাহলে সে বিদেশের মাটিতেও দেশের সম্মান বয়ে আনতে পারবে।
