X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাল্যবিয়ে যেখানে ‘অনিবার্য নিয়তি’

আরিফুল ইসলাম রিগান, কুড়িগ্রাম
০৮ মার্চ ২০২২, ১৩:১০আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২২, ১৭:০৪

ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী দ্বীপচর ‘রলাকাটার চর’। গ্রামটিতে যাতায়াতের একমাত্র বাহন নৌযান। নৌ ও সড়কপথ মিলে জেলা শহরে যাতায়াত করতে সময় লাগে দুই ঘণ্টারও বেশি। এই চরে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও নেই কোনও মাধ্যমিক বিদ্যালয় কিংবা কলেজ। ফলে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে সংসারে প্রবেশ করে কিশোরীরা। বাল্যবিয়ে এখানে স্বাভাবিক নিয়ম; কিশোরীদের ‘অনিবার্য নিয়তি’। এর ব্যতিক্রম হলেই ঘটে স্বামী বিড়ম্বনা। বয়স একটু ‘বেড়ে’ গেলে কিশোরীদের পুরুষের দ্বিতীয় বিয়ের শিকার হতে হয়।

এই গ্রামেরই মেয়ে সায়মা (ছদ্মনাম)। গত বছরের শেষে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয় তার। কথা হয় এই কিশোরী গৃহবধূর মায়ের সঙ্গে। তার কথায়, ‘গরিবের মেয়ে বড় হইলে মাথার বোঝা হয়া যায়। একটু বয়স হইলে মানুষ নানা কথা কয় (বলে)। মানসম্মানের ভয়ে, সমাজের চাপে বিয়া দিতে বাধ্য হই।’

মেয়েদের যে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়া উচিত না, এই যুগে এসে অজানা থাকার কথা নয়। জানে ভুক্তভোগী কিশোরী গৃহবধূও, কিন্তু ‘অনিবার্য নিয়তি’র কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। একই গ্রামে বিয়ে হয়েছে তার, স্বামীর বাড়ির আঙিনাতেই কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। সে বলে, ‘বিয়ের দিনও জানতাম না বিয়ে হচ্ছে। নিজের ইচ্ছায় নয়, বাবা-মায়ের ইচ্ছাতেই এই বিয়ে। আমার পড়াশোনা করার ইচ্ছা ছিল।’ 

বাল্যবিয়ের শিকার কিশোরী গৃহবধূ

বাল্য বিয়ের মতো এমন নিষ্ঠুরতার শিকার ওই চরের আরেক কিশোরীর ভাবি জানান, তার ননদ পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলে আর পড়ানো সম্ভব হয়নি। গ্রামে কোনও মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় ৩ বছর বাড়িতেই ছিল। বিয়ের জন্য ভালো ঘরও মিলছিল না। এদিকে বয়সও ‘বেড়ে’ যাচ্ছে। শেষে ১৫ বছর বয়সে লালমনিরহাটে তার ননদের বিয়ে হয়। বরের প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন, ঘরে দুই সন্তান রয়েছে।

এই গৃহবধূর (কিশোরীর ভাবি) ভাষ্য, ‘একটু বয়স হইলে মানুষ নানা কথা বলে। চরের নিয়ম খারাপ, একটু বড় হইলেই বিয়া দিতে হয়। স্কুল না থাকায় আরও তাড়াতাড়ি বিয়া হয়।’

প্রত্যন্ত ওই চরে স্থানীয় কয়েকজন যুবক মিলে একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় চালুর উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে বিদ্যালয়ের পাঠদানের অনুমতি মেলেনি। উদ্যোক্তাদের একজন মুনির হোসেন। তিনি জানালেন, রলাকাটার চর থেকে যাত্রাপুরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে নৌকা ছাড়া বিকল্প নেই। এত দূরে অভিভাবকরা মেয়েদের পাঠাতে চান না।

মুনির বলেন, ‘প্রাইমারি পাস করলে এখানকার মেয়েদের গ্রামের বাইরে যাওয়া নিষেধ। তখনই বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। ৮ম-১০ম শ্রেণি পর্যন্ত কোনও মেয়ে পড়াশোনা করলে গ্রামে তাকে বুড়ি কিংবা অন্য কোনও ডাকে তিরস্কৃত হতে হয়। ‘ভাগ্যে’ জোটে সতীনের ঘর কিংবা স্ত্রী মারা যাওয়া কোনও পুরুষের দ্বিতীয় বিয়ের শিকার হতে হয় তাদের। ফলে বাল্যবিয়ে এখানে স্বাভাবিক ঘটনা।’

‘গ্রামে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন অভিভাবকরা। ফলে মানসম্মানের ভয়ে আগেই বিয়ে দিয়ে দেন’, যোগ করেন মুনির।

রলাকাটার চরের ইউপি সদস্য আব্দুল করিম জানান, ‘পূর্ব পুরুষ থেকে চলে আসা নিয়মে চরাঞ্চলে বাল্যবিয়ের প্রবণতা এখনও চলমান। হাইস্কুল না থাকায় এ সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাল্যবিয়ে ঠেকাতে গেলে অভিভাবকরা বলেন, বয়স বেশি হইলে মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। আমরা বোঝানোর চেষ্টা করি, কিন্তু গোপনে বিয়ে দিয়ে দেয়। চরে হাইস্কুল থাকলে মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারতো। তাদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি অভিভাবকরাও ভাবতেন, মেয়ে পড়াশোনা করছে, করুক।’

শুধু রলাকাটার চরই নয়, নদীবেষ্টিত কুড়িগ্রামের প্রায় সব চরের চিত্র একই। স্থানীয়রা বলছেন, চরাঞ্চলে ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা এবং দরিদ্রতার কারণে হরহামেশাই বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে। কুড়িগ্রামের প্রায় সব উপজেলাতেই এই প্রবণতা চলমান।

উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চররসুলপুর গ্রামের গৃহবধূ সেলিনা আক্তার বলেন, ‘এই এলাকা হতদরিদ্র। অভিভাবকরা মেয়েদের বাড়তি বোঝা মনে করে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেয়। বয়স বেশি হলে যৌতুকের পরিমাণ বাড়ে। কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে দিলে তেমন যৌতুক দিতে হয় না।’

বাল্যবিয়ের আলোচনায় বর ও কনেপক্ষ

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি একই ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী দ্বীপচর মশালের চর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে চর কালীরআলগা থেকে কনেপক্ষ এসেছে ছেলেপক্ষের বাড়িতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, কনের বয়স ১৩ বছর, সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী।

এত অল্প বয়সে মেয়েকে কেন বিয়ে দিবেন জানতে চাইলে তিনি জানান, তাদের পূর্বপুরুষ থেকেই এভাবে বিয়ে হয়ে আসছে। বয়স বাড়লে বিয়ে দিতে সমস্যা। আর চরেতো স্কুল নেই, বাড়িতে থেকে কী করবে?

ওই চরের বাসিন্দা ও সাবেক ইউপি সদস্য সিদ্দিক বলেন, ‘আমাদের এই চরে শুধু একটি প্রাইমারি স্কুল আছে। আশপাশের কোনও চরে হাইস্কুল নাই। ৫ম শ্রেণি পাস করার পর কিছু ছেলে বাইরে পড়তে গেলেও মেয়েদের বাইরে পড়ার কোনও সুযোগ নাই। নিরাপত্তা বিবেচনায় অভিভাবকরা ওই ঝুঁকিও নেন না। পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর কিছু দিন পরেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। চরে পর্যাপ্ত হাইস্কুল থাকলে এভাবে বাল্য বিয়ে হতো না।’

জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী জেলায় গত দেড় বছরে ৪ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। জেলার ৯ উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ২ হাজার ৯২৭ জন এবং মাদ্রাসার প্রায় ১ হাজার ২৯০ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে, যা মোট শিক্ষার্থীর ২ দশমিক ৩৪ ভাগ।

শিক্ষা অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জেলায় সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয়েছে (স্কুল ও মাদ্রাসা মিলে) সীমান্তবর্তী উপজেলা ভূরুঙ্গামারীতে, ৭৭৭টি। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ফুলবাড়ী, ৭০১টি এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নাগেশ্বরী উপজেলা, ৬৩৩টি। তবে এসব তথ্য শুধু স্কুলভিত্তিক। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে যারা মাধ্যমিকে ভর্তি হতে পারছে না তাদের বাল্যবিয়ের তথ্যের কোনও পরিসংখ্যান নেই, সরকারি ভলিউমে সেগুলোর নিবন্ধনও হচ্ছে না।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিইও) শামসুল আলম বলেন, ‘করোনাকালে জেলায় ৪ হাজারের মতো শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এত বেশি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘চরাঞ্চলের অভিভাবকদের মধ্যে সন্তানদের বাল্যবিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেশি। করোনার সময়ে চলাচল নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে গঠিত কমিটিগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারেনি। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আমরা সব পর্যায়ের কমিটিগুলোকে সক্রিয় করে এটি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে যাওয়ায় এখন বিয়ের প্রবণতা কমবে বলে আশা করছি।’

চরাঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমি কিছু ইনেশিয়েটিভ নিয়েছি। স্কুল না হলে ওখানে (চরাঞ্চলে) পড়াশোনার উন্নয়ন ঘটানো খুব কঠিন। যেসব নিম্ন মাধ্যমিক রয়েছে সেগুলোকে মাধ্যমিক পর্যায়ে নেওয়া এবং নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্তির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে ইউএনওদের বলেছি।’

/ইউআই/ইউএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য খালাস করে গেলেন যে নারী ট্রাকচালক
আইসিটি খাতে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী
নারী উদ্যোক্তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহার বিষয়ক প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!