X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

এক হাসপাতালে এক পরিবারের দাপট, জিম্মি চিকিৎসাসেবা

আরিফুল ইসলাম রিগান, কুড়িগ্রাম
১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:০০আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১৭:৪৭

দেশের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামের সিংহভাগ মানুষের দারিদ্র্যসীমায় বসবাস। ২০ লক্ষাধিক মানুষের এই জেলার অধিকাংশই স্বাচ্ছন্দ্যে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পারে না। চিকিৎসার জন্য ২৫০ শয্যার কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল তাদের একমাত্র ভরসাস্থল। চিকিৎসক সংকট নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলা এই হাসপাতালে ভোগান্তির নাম ওষুধ সংকট ও চিকিৎসা যন্ত্রপাতির অভাব। আট বছর ধরে রাজশাহীর একটি পরিবারের হাতে হাসপাতালের ওষুধসহ চিকিৎসা যন্ত্রপাতি (এমএসআর) সরবরাহ জিম্মি থাকায় ভোগান্তি  থেকে মুক্তি মিলছে না সাধারণ মানুষের।

ওষুধ ও যন্ত্রাংশ সরবরাহের নামে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বিল তুলে নিলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট বাণিজ্যে হাসপাতালের সেবার মান দিনদিন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। হাসপাতাল সূত্র ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এসব তথ্য দিয়েছেন।

হাসপাতালের প্রশাসনিক কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছর থেকে মেডিসিন ও মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট ক্রয়ের (এমএসআর) টেন্ডার প্রক্রিয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর থেকে গত আট বছর ধরে রাজশাহীর এক পরিবারের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে এমএসআর পণ্য সরবরাহ। সিন্ডিকেট বাণিজ্যের কারণে ঘুরেফিরে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিয়ে আসছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওই তিন প্রতিষ্ঠানের মালিক একই পরিবারের সদস্য। দীর্ঘ সময় ধরে চলছে তাদের দাপট। এই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা। 

দেশের বেশিরভাগ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) প্রক্রিয়ায় দরপত্র আহ্বান করলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখনও সনাতন পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করায় এই সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয় ঠিকাদারদের।

হাসপাতালের এমএসআর টেন্ডারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছর এমএসআর টেন্ডারের কার্যাদেশ পায় রাজশাহীর ‘মেসার্স টোটন ফার্মেসি’। এর মালিকের নাম মো. নাসিমুল গণি খান (টোটন)। এর পরের বছর একই ঠিকাদার (টোটন) প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে ‘মেসার্স মাইক্রো ট্রেডার্স’ নামে কার্যাদেশ পান। এরপর টানা তিন বছর একই নামে এমএসআর পণ্য সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ রাখে ‘মেসার্স মাইক্রো ট্রেডার্স’। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কিছুটা কৌশলী হয়ে টোটন তার শ্যালক জাহিদুল ইসলামের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘প্যারাগন এন্টারপ্রাইজ’সহ যৌথভাবে এই টেন্ডারের কার্যাদেশ পান। 

২০২০-২০২১ অর্থবছরে আবারও এককভাবে কার্যাদেশ পায় টোটনের ‘মেসার্স মাইক্রো ট্রেডার্স’। পরের বছর (২০২১-২০২২) শ্যালকের স্থলে নিজের বড় ভাই রফিক উদ্দিন খানের ‘মেসার্স হারামাইন এন্টারপ্রাইজ’সহ যৌথভাবে আবারও কার্যাদেশ পায় ‘মেসার্স মাইক্রো ট্রেডার্স’। বিতর্ক এড়াতে পরের বছর (২০২২-২০২৩) আরও কৌশলী হয়ে কার্যাদেশ দেওয়া হয় টোটনের বড় ভাই ও শ্যালকের নামে।

হাসপাতালের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গত বছর এমএসআর টেন্ডারে প্রায় ১২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। ঘুরেফিরে একই পরিবারের হাতে জিম্মি থাকা এমএসআর টেন্ডারে সরবরাহকৃত পণ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়ে আছে। বেশ কিছু ওষুধ সরবরাহ না করেই বিল তুলে নেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালের এমএসআর টেন্ডারে টোটনের পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য নিশ্চিত করতে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দরপত্রে ‘অভিনব’ শর্ত জুড়ে দেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক। বিগত বছরগুলোতে এই দরপত্রে গ্রুপভিত্তিক আলাদা ব্যাংক স্থিতি ও তিন বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হলেও চলতি অর্থবছরে সব গ্রুপের জন্য একক ব্যাংক স্থিতি—পাঁচ কোটি টাকা এবং চার বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। দরপত্রে অংশ নেওয়া অন্য ঠিকাদারদের অভিযোগ, মূলত সিন্ডিকেটকে কাজ পাইয়ে দিতে অভিনব শর্ত দেন তত্ত্বাবধায়ক।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের এমএসআর টেন্ডারে বিভিন্ন গ্রুপে ৪৪টি দরপত্র দাখিল হয়। তবে ‘চিরাচরিত নিয়মে’ আবারও কর্তৃপক্ষের কাছে বৈধ বিবেচিত হয় রাজশাহীর তিন প্রতিষ্ঠান—মেসার্স মাইক্রো টেডার্স, প্যারাগন এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স হারামাইন এন্টারপ্রাইজ। তবে এখনও কাউকে কার্যাদেশ দেয়নি কর্তৃপক্ষ।

দরপত্রে অংশ নেওয়া মেসার্স স্বর্ণা এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. সাহাদৎ হোসেন খন্দকার বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক তার পছন্দের ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে টেন্ডারে বিধিবহির্ভূত শর্ত দিয়েছেন। দেশের কোনও হাসপাতালের ক্রয় প্রক্রিয়ায় এ ধরনের শর্ত দেওয়া হয় না। এটা প্রহসনের টেন্ডার প্রক্রিয়া বলে আমি মনে করি।’

‘সাহিদা ট্রেডার্স’ নামে আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি গোলাম রব্বানি বিপ্লব বলেন, ‘আমরা রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ও সিলেটের ওসমানী মেডিক্যালসহ দেশের কয়েকটি বড় বড় হাসপাতালে এমএসআর পণ্য সরবরাহ করি। এ বছর সব শর্ত মেনে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের টেন্ডারে অংশ নিই। সেখানে অধিকাংশ আইটেমে আমরা সর্বনিম্ন দরদাতা হই। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দরপত্র থেকে আমাদের কাগজ সরিয়ে দিয়ে নন-রেসপনসিভ করেন। পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতেই কর্তৃপক্ষ উদ্দেশ্যমূলকভাবে এটি করেছেন।’

এ ব্যাপারে মেসার্স হারামাইন এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. রফিক উদ্দিন খানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমার ছোট ভাই আমার নামে কাজ করেন। এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন।’

পরে তার ছোট ভাই মেসার্স মাইক্রো ট্রেডার্সের মালিক মো. নাসিমুল গণি খানের (টোটন) মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি। পরে তাকে ক্ষুদে বার্তা দিলেও কোনও উত্তর দেননি।

তবে সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. শহিদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘ঠিকাদারদের অভিযোগ সঠিক নয়। আমি বিধি অনুযায়ী টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি। পিপিআর অনুযায়ী শর্তারোপ করেছি। বিগত বছরেও একই শর্ত দেওয়া হয়েছিল।’

তবে হাসপাতালের বিগত বছরগুলোর এমএসআর দরপত্রের শর্তে তত্ত্বাবধায়কের এমন দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি।

টেন্ডার প্রক্রিয়া অনলাইনে দেওয়ার প্রশ্নে তত্ত্বাবধায়ক বলেন, ‘আমরা তো চাই অনলাইনে দিতে। কিন্তু প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না মেলায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না।’

তত্ত্বাবধায়ক এমএসআরের দরপত্রে বিগত বছরগুলোতে একই ধরনের শর্ত থাকার দাবি করলেও হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। ২০২০-২০২১ এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরের দরপত্রের শর্তে দেখা গেছে, এমএসআরের দরপত্রে গ্রুপভিত্তিক কাজে ‘ক’ গ্রুপের জন্য ব্যাংক স্থিতি চাওয়া হয়েছে এক কোটি টাকা। অন্য সকল (‘খ’ থেকে ‘চ’ গ্রুপ) গ্রুপের জন্য চাওয়া হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। শুধুমাত্র ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে সব গ্রুপের জন্য ব্যাংক স্থিতি চাওয়া হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। অথচ গত অর্থবছরে ‘ক’ গ্রুপে কয়েক ধাপে বিল দেওয়া হয়েছে আট কোটি ৪৩ লাখ ২৬ হাজার ৫৮৫ টাকা। একইভাবে ‘খ’ গ্রুপে দেওয়া হয়েছে এক কোটি ২৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৬৫ টাকা, ‘গ’ গ্রুপে ৫৫ লাখ ৮৩ হাজার ১৬৪ টাকা, ‘ঘ’ গ্রুপে ৫৬ লাখ লাখ ৩৪ হাজার ৯০০ টাকা, ‘ঙ” গ্রুপে এক কোটি ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার ৩৬৫ টাকা এবং ‘চ’ গ্রুপে দেওয়া হয়েছে ২০ লাখ ৩৩ হাজার ৭০০ টাকা। 

এর মধ্যে মেসার্স হারামাইন এন্টারপ্রাইজকে দেওয়া হয়েছে আট কোটি ৬৩ লাখ ৬০ হাজার ২৮৫ টাকা। আর প্যারাগন এন্টারপ্রাইজকে দেওয়া হয়েছে তিন কোটি ৭৬ লাখ ১৭ হাজার ৭৯৪ টাকা। এসব বিল তিন ধাপে দেওয়া হয়েছে বলে হাসপাতালের হিসাব বিভাগ সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

আবার বিগত বছরগুলোতে গ্রুপভিত্তিক কাজে এমএসআর পণ্য সরবরাহে গত পাঁচ বছরের মধ্যে কমপক্ষে তিন বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হলেও চলতি অর্থবছরের দরপত্রে এই অভিজ্ঞতা চার বছরের চাওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ২ অক্টোবর কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের এমএসআর দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। একই বছরের ২ নভেম্বর দুপুর ১২টা পর্যন্ত দরপত্র জমা নেওয়া হয়। একই দিন দরপত্র খোলা হয়। এরপর দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি দরপত্র মূল্যায়ন করে রাজশাহীর একই পরিবারের তিন প্রতিষ্ঠানকে বৈধ বিবেচনা করে স্বাস্থ্য অধিদফতরে প্রতিবেদন পাঠায়। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এখনও প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদফতর। 

/এএম/
সম্পর্কিত
সমবায় সমিতির নামে কোটি টাকার দুর্নীতি: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক এমডিসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
চিকিৎসক ছাড়াই রক্ত ট্রান্সফিউশনের সময় হাজির ম্যাজিস্ট্রেট
সর্বশেষ খবর
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা