X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘খাইমু কী কইরা, বাঁচমু কী কইরা’

হিমাদ্রি শেখর ভদ্র, সুনামগঞ্জ
১৮ আগস্ট ২০১৭, ১৮:২১আপডেট : ২০ আগস্ট ২০১৭, ০৯:৫৩

বাড়িতে পানি, বাড়ি থেকে কোথাও যাওয়ার জোঁ নেই, রাস্তাতেও হাঁটু পানি (ছবি-প্রতিনিধি)

একাকার হয়ে গেছে পাহাড়ি ঢল, টানা বৃষ্টি, হাওড় উছলানো পানি আর সুনামগঞ্জবাসীর কান্না। বারবার ফসলহানির ফলে তাদের ধানের মাচা এখন খালি। ঘরে ধান-চাল বলতে কিছু নেই। কিন্তু পড়ে আছে পুরোটা বছর। সামনে একটাই উপায়, মাধুকরী হতে পারেন তারা। ভিক্ষা ছাড়া আর কোনও বিকল্প উপায় দেখছেন না হাওরের বন্যাদুর্গত মানুষেরা। তবে ভিক্ষা দেওয়ার মতো অবস্থা কারো আছে কিনা তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন তারা। সবার অবস্থাই তো একই রকম, তাহলে ভিক্ষাটা দিবে কে? ঘরে ঘরে হাত পাতলেও দু’মুঠো চাল-ডালে অঞ্জলি ভরবে কিনা, সে ব্যাপারেও সংশয় প্রকাশ করেছেন হাওড়ের মানুষেরা।

‘আমরার হাইল জমিনও গেল, আগন মাইয়াও গেল। ঘর-দুয়ারে পানি, ঘরও নাই খানি।’ রাবেয়া খাতুনের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ এটি। সুনাগঞ্জের সদর উপজেলার ছনচার গ্রামের বাসিন্দা তিনি। বন্যার দুর্ভোগ সম্পর্কে শুক্রবার (২৮ আগস্ট) বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে এভাবেই কথা বলেছেন তিনি। একই সুরে কথা বলেছেন একই গ্রামের মরিয়ম বেগম ও খালিদা খাতুন। তারা বলেন, ‘ঋণ কইরা বৈশাইখা লাগাছিলাম, বৈশাইখা ধানও কাঁচা থাকতে ডুবে গেছে। তোরা তোরা আমন লাগাইছিলাম, এই ধানও পানির তলে। আমরা খাইমু কী কইরা আর বাঁচমু কী কইরা। মাইগা খাওন ছাড়া তো আর কোনও উপায় নাই।’

খাদ্য সংকট নিরসনে উছলানো হাওরে মাছ খোঁজার চেষ্টা করছেন স্থানীয়রা (ছবি-প্রতিনিধি)

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কম বেশি সকল কৃষকই কিছু না কিছু ঋণ করে জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিকূল প্রকৃতি তাদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে গেছে। চৈত্র মাসের অকাল বন্যায় তারা হারিয়েছেন পরিণত বোরোর চারা, শ্রাবণের বন্যায় ভেসে গেছে আমনের বীজতলা। এছাড়া শিলা বৃষ্টি ও কাল বৈশাখী ঝড়ে উড়ে গেছে কাঁচা বাড়ি, আধা পাকা ঘরের টিনের চালা। একের পর এক টানা দুর্যোগে অবসাদগ্রস্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন হাওড়ের মানুষেরা। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তাদের। হানা দিচ্ছে রাজ্যের ক্ষুধা। কিন্তু ক্ষুধা মেটানোর উপকরণ নেই। বারবার ফসল হারিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা।

এ ব্যাপারে ধনপুর গ্রামের শফিকুল ইসলাম জানান, গত বন্যায় অর্ধেক ফসল কেটে ঘরে তুলতে পেরেছিলেন তিনি। তাই কোন রকমে ছয় মাসের খাবারের জোগাড়  হয়েছে। কিন্তু এবার গরু ও মানুষের খাদ্য সংকট একসঙ্গে দেখা দিয়েছে। একই গ্রামের খাইরুনেচ্ছা বলেন, ‘দুই আরা বইনায় আমার খুব ক্ষতি করছে। আমরার জমিন নাই, জামা নাই, হাতের কাজ করি চলি খাই। এবার তো কারো বাড়িতে গিয়ে ভিক্ষা করেও খাওন মিলতো না, কারণ সকলের এক দশা।’

পানির নিচে তলিয়ে গেছে বাড়ির পাশের ফসলি জমি (ছবি-প্রতিনিধি)

ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামের কৃষক মনফর আলী বলেন, ‘বোরো গেল, আমন গেল, আর কিছু যাওয়ার নাই, পাওয়ারও নাই, আমরা বাঁচতাম কী করি।’ শান্তিপুর গ্রামের আসকর আলী জানান, হাওর এলাকা ছয় থেকে সাত মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে। এ সময় মাছ ধরা ছাড়া কর্মসংস্থানের বিকল্প কোনও উপায় নাই। কিন্তু এখন হাজার হাজার মানুষ বেকার অবস্থায়  দিন কাটাচ্ছেন।

লাউড়েরগর গ্রামের সুবেদার ইসলাম জানান, জেলার কিছু মানুষ কোয়ারি থেকে বালু-পাথর তুলে জীবিকা নির্বাহ করে। এখন পানি বাড়ায় বালু-পাথর উত্তোলন বন্ধ। এজন্য কমপক্ষে বিশ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘প্রতিদিন ত্রাণের আশায় শত শত মানুষ উপজেলা সদরে ভিড় জমায়। কেউ ত্রাণ পায়, কেউ পায় না। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য সরকারি বেসরকারি ত্রাণ সহযোগিতা বাড়াতে হবে।’ দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ তালুকদারের দাবি, ‘হাওরের বিশাল জনগোষ্ঠি বছরের ছয় মাস বেকার থাকেন। তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।’

যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে প্লাবিত অঞ্চলে (ছবি-প্রতিনিধি)

ফসলহানির ব্যাপারে সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, ‘চলতি বছর জেলার ১১টি উপজেলায় ২৮ হাজার ২শ ৯৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু বন্যায় অন্তত ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এতে প্রায় ২৫ হাজার কৃষকের ৩০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’

প্রথমবারের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, ‘এ বছর দুই লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ করা হয়েছিলো। এর মধ্যে ২৮ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিলের বন্যায় ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে এক লাখ ৬৭ হাজার হেক্টর জমির কাঁচা ধান তলিয়ে যায়। এতে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়। তিন লাখ কৃষক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হন। হাওরের মাছে ও হাঁসে মড়ক দেখা দেয়।’

ডুবে আছে আমনের চারা (ছবি-প্রতিনিধি)

এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে আমন ধানের বীজ দেওয়া হবে, যাতে তারা আমন ধান চাষ করতে পারেন।’

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘প্রশাসন সব সময় দুর্গতদের পাশে রয়েছে। সরকার চাহিদা মতো ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ করছে। জেলার ১শ’ ১০ টি পয়েন্টে খোলাবাজারে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি অব্যাহত রয়েছে। প্রয়োজন হলে আরও সহযোগিতা করা হবে।’

 /এএইচ/  

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জাতীয় দল রেখে ঢাকা লিগে সাকিবের খেলার ব্যাখ্যা দিলেন নির্বাচক
জাতীয় দল রেখে ঢাকা লিগে সাকিবের খেলার ব্যাখ্যা দিলেন নির্বাচক
পাপন শুনেছেন, তামিম নাকি সামনের বছর ফিরবেন!
পাপন শুনেছেন, তামিম নাকি সামনের বছর ফিরবেন!
তিনটি গ্রাম থেকে সেনা সরিয়ে নিলো ইউক্রেন
তিনটি গ্রাম থেকে সেনা সরিয়ে নিলো ইউক্রেন
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে