দুর্নীতিমুক্ত ও গতিশীল প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রশাসনিক কার্যক্রমকে ডিজিটেইজেশন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার জন্য কাজ শুরু করেছে সরকার। তবে এখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা কাগজ-কলমে পরিপক্বতা পেলেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এরইমধ্যে সফলভাবে ডিজিটাল করে ফেলা হয়েছে পাবনা সদরের বালিয়াহালট ক্লাস্টারের সার্বিক কার্যক্রম। ২২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই ক্লাস্টারে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।
শিক্ষা প্রশাসনের সর্বনিম্ন স্তর (ক্লাস্টার)-এ চালু হওয়া এই ব্যবস্থাকে প্রথম ডিজিটাল শিক্ষা প্রশাসন হিসেবে মনে করছে পাবনার স্থানীয় প্রশাসন এবং প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর।
একজন সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. আসলাম হোসাইনের হাত ধরেই শুরু হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই সুদূরপ্রসারী স্বপ্নযাত্রা। তার দায়িত্বে থাকা ক্লাস্টারের অন্তর্ভুক্ত বিদ্যালয়গুলোতে পঠন-পাঠন থেকে শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আনাগোনা রেকর্ড পর্যন্ত ডিজিটাইজড করে ফেলেছেন তিনি।
সদর উপজেলার ‘বালিয়াহালট ক্লাস্টার’
দেশের প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের সব চেয়ে নিম্নতম স্তর হচ্ছে ক্লাস্টার। কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে একটি ক্লাস্টার গঠন করা হয়। এর দেখভালের দায়িত্বে থাকেন সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার। এমনই একটি ক্লাস্টার পাবনা সদরের ‘বালিয়াহালট ক্লাস্টার’।
এই ক্লাস্টারের ২১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি সরকারি শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ ২২টি বিদ্যালয় রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অফিসে বা ঘরে বসেই শিক্ষকদের নৈমিত্তিক ছুটি নেন ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার বা ই-মেইলের মাধ্যমে। শিক্ষককের বিভিন্ন কর্মসূচি, দৈনিক উপস্থিতি, বিদ্যালয়ের যেকোনও তথ্য আদান-প্রদান ও উপবৃত্তির তথ্য লেনদেন হয় ম্যাসেঞ্জারে। মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের আদেশ, পরিপত্র, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সরকারি যেকোনও গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনার তথ্যও লেনদেন করা হয় ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার ও ই-মেইলের মাধ্যমে। পাঠদানে দুর্বলতা থাকলে অন্য শিক্ষক বা শিক্ষা অফিসারের সহায়তাও পাওয়া যায় অনলাইনে।
যেভাবে অনলাইন কার্যক্রম শুরু
২০১৮ সালের শুরু থেকেই বালিয়াহালট ক্লাস্টারের প্রতিটি বিদ্যালয়ে অনলাইন সার্ভিস চালুর জন্য প্রস্তুতি নেন সহকারী শিক্ষা অফিসার মো. আসলাম হোসাইন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে তার ইনোভেশন প্রস্তাব জমা দেন। ইনোভেশন প্রস্তাব ছিল প্রতিটি বিদ্যালয়ে অনলাইন সার্ভিস চালু করা। প্রস্তাব জমা দিয়ে জুন মাস থেকে শিক্ষকদের প্রস্তুত করতে শুরু করেন এই কর্মকর্তা। শিক্ষকদের ই-মেইল অ্যাকাউন্ট খুলে দেন। ই-মেইল পরিচালনা শেখানোর পর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দেন শিক্ষকদের। যদিও অনেক শিক্ষক এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞ ছিলেন। সবাইকে অনলাইন বিষয়ে দক্ষ করে তোলার পর ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার টিমের মাধ্যমে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন তিনি।
এরপর থেকে শিক্ষকদের ছুটি, সরকারি তথ্য আদান-প্রদানসহ সব ধরনের প্রশাসনিক কাজ চলে ম্যাসেঞ্জার ও ই-মেইলের মাধ্যমে। অনলাইনেই চলতে থাকে শিক্ষকদের মনিটরিংসহ সব কার্যক্রম।
এ ব্যাপারে মো. আসলাম হোসাইন জানান, ইনোভেশন প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছিল ২০১৮ সালের মাঝামাঝি। অনুমোদনও দেওয়া হয়। ইনোভেশন কার্যক্রমের মেয়াদ রয়েছে ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। যদিও নির্ধারিত সময়ের আগেই বেশিরভাগ কার্যক্রম শেষ হয়েছে।
ওয়েবসাইটভিত্তিক ব্যবস্থাপনা
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ই-মেইল ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের আওতায় আনার পর তাদের প্রশাসনিক কার্যক্রম মনিটরিংসহ যাবতীয় কাজ ওয়েবসাইটভিত্তিক করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
এরই অংশ হিসেবে বালিয়াহালট ক্লাস্টারের ২২টি বিদ্যালয়কে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ‘মাল্টি স্কুল ম্যানেজমেন্ট বা ক্লাস্টার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ চালু করা হয়েছে। এই পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য প্রথমে তিনটি স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করার কাজ শুরু হয়েছে। প্রশাসনিক ও দাফতরিক সব কাজই এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই সম্পন্ন করা হবে। অনলাইনে এর ঠিকানা হচ্ছে https://baliahalotcluster.com.cutestat.com
এমনকি শিক্ষকদের ছুটির আবেদন গ্রহণ ও মঞ্জুর, তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা, অনুপস্থিত থাকলে মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ওই শিক্ষককেও অবহিত করা যাবে। এই ওয়েবসাইটে শিক্ষদের জন্য নোটিশবোর্ড থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ যে কোনও সরকারি ও সংশ্লিষ্ট নির্দেশনা সেই নোটিশবোর্ডে আপডেট পাওয়া যাবে।
এছাড়া এরই আদলে বিদ্যালয়গুলো তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে ‘সিঙ্গেল স্কুল ম্যানেজমেন্ট’ পদ্ধতি যুক্ত করতে পারবেন। সেখান থেকে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা নিজ প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন। শিক্ষকদের সমন্বয় করাসহ সার্বিক তত্ত্বাবধান করতে পারবেন প্রধানশিক্ষক। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের ছাড়পত্র, প্রশংসাপত্র, ফলাফল অনলাইনে দেওয়া সম্ভব হবে।
শিক্ষকরা এই ওয়েবসাইট ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের বিষয়ে মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে অভিভাবকদের তথ্য পাঠাতে পারবেন।
মুভমেন্ট রেজিস্টার
শিক্ষকদের মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাও চালু রয়েছে ক্লাস্টারের সব বিদ্যালয়ে। জরুরি না হলে অফিসিয়াল কাজের জন্য শিক্ষকরা বিদ্যালয় ছেড়ে কোথাও যাবেন না। কারণ অনলাইনেই সব কাজ শেষ করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পাঠ ব্যহত না হয় সেজন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কেউ প্রয়োজনে বিদ্যালয় থেকে বের হলেও তা অনলাইনে রেজিস্টার করতে হয়।
সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসার মির্জ্জা গোলাম মহম্মদ বেগ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সদর উপজেলার এই ক্লাস্টারে প্রথম ডিজিটাল প্রশাসন চালু করা হয়েছে। আমার জানা মতে, তৃণমূলে দেশের প্রথম ডিজিটাল শিক্ষা প্রশাসন এটি।’
এ ব্যাপারে পাবনার জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসলাম হোসাইনের অনেকগুলো ভালো ইনোভেশন রয়েছে। সারা দেশে তার মতো অফিসার প্রয়োজন। আমি জানি না এর চেয়েও ভালো কিছু কেউ করেছে কিনা। কিন্তু পাবনা জেলায় এই একটি ক্লাস্টারেই প্রথম অনলাইনভিত্তিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সারাদেশেই ডিজিটাল প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাচ্ছি। এমন ভালো উদ্যোগ সারাদেশে বাস্তবায়ন করতে চাই। সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসাররাই একেকটি ক্লাস্টারের প্রধান। প্রতিটি ক্লাস্টারকে যদি ডিজিটাল করতে পারি, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর যে চাওয়া তা পূরণ হবে। আজ যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে, তারাই ২০৪১ সালের বাংলাদেশে নেতৃত্ব দেবে। এই উদ্যোগটি সবক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য করা গেলে আমরা সারাদেশেই বাস্তবায়ন করবো।’
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পিইডিপি-৪) মো. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমার জানা মতে, দেশের কোনও ক্লাস্টার অনলাইনে পরিচালিত হচ্ছে না। আমরা সারা দেশের শিক্ষা প্রশাসন মনিটরিং সিস্টেম চালু করেছি। অনলাইন হাজিরা চালু হয়েছে, যদিও সব প্রতিষ্ঠানে এখনও হয়নি। তবে তৃণমূলের শিক্ষা প্রশাসনের এই উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য হলে অধিদফতর তাকে সহায়তা করবে। আমরা সারাদেশে এমন উদ্যোগ চাই।’
এ সংক্রান্ত আরও খবর: নতুন প্রজন্মের প্রাথমিক বিদ্যালয় যেমন হতে পারে