X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই সেমিস্টারে শিক্ষার্থী নিতে কেন মরিয়া ইউজিসি?

এস এম আববাস
২৭ অক্টোবর ২০২১, ১৯:০৭আপডেট : ২৮ অক্টোবর ২০২১, ১৪:৫০

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই সেমিস্টারে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন উপাচার্যরা। একই প্রশ্ন ট্রাস্টিদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির। চলমান সফল তিন সেমিস্টার পদ্ধতি কমিয়ে এনে কেন দুই সেমিস্টার করতে হবে তা বোধগম্য নয় কারও। তারা বলছেন, ‘হঠাৎ চাপিয়ে দেওয়া এই নির্দেশনা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের ওপর আর্থিক চাপ তৈরি করবে। তাহলে কার স্বার্থে মরিয়া হয়ে দুই সেমিস্টার পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে ইউজিসি?’

গত ৯ আগস্ট দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারদের চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘২০২১ সালের পর বছরে দুই সেমিস্টার ছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তি হলে কমিশনের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।’ শিক্ষার্থীদের জন্য ইউনিক পরিচিতি নম্বর তৈরির চিঠিতে এই নির্দেশনা জুড়ে দিয়েছে ইউজিসি। এতে ২০২২ সালের জুলাই থেকে দুই সেমিস্টার রাখার কথা বলা হয়।

ইউজিসি’র সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিত চন্দ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগের চিঠিতে বলা হয়েছিল ২০২১ সালের পর থেকে দুই সেমিস্টারে শিক্ষার্থী ভর্তি নিতে হবে। দ্বিতীয় চিঠিতে সেই সময় বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুলাই থেকে করা হয়েছে। দ্বিতীয় চিঠি অনুসরণ করতে হবে।’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি ও উপাচার্যদের মন্তব্য, ‘বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে তিন সেমিস্টার চালু আছে। কোথাও চার সেমিস্টারও রয়েছে। অথচ হঠাৎ বলা হচ্ছে, দুই সেমিস্টার ছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তি গ্রহণযোগ্য হবে না। শিক্ষাক্রমের বিষয়ে কোনও আলোচনা ছাড়াই এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি অনাকঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক।’

বিশ্বের অন্যান্য দেশে তিন সেমিস্টার থাকার বিষয়টি জানিয়ে মন্তব্য চাইলে ইউজিসি’র সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীরের দাবি, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তিন সেমিস্টার আছে ঠিকই, কিন্তু শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয় দুই সেমিস্টারে।’

শিক্ষার্থীদের ইউনিক পরিচিতি নম্বর প্রসঙ্গে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. চৌধুরী মোফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের একটি নিবন্ধন নম্বর থাকেই। তাহলে কেন হঠাৎ এত বড় একটি পরিচিতি নম্বর তৈরি হচ্ছে? পৃথিবীর অন্য কোথাও কিন্তু এত বড় নম্বর নেই।’

সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক বিষয় অনুমোদন দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল। অ্যাকাডেমিক বিষয়ে দুই সেমিস্টারে শিক্ষার্থী ভর্তির শর্তারোপ আইনে নেই, এ কারণে শিক্ষার্থী ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নতুনভাবে চাপ সৃষ্টি হবে। একইসঙ্গে শিক্ষাক্রমে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।

ইউজিসি’র নতুন শর্ত জুড়ে দেওয়ার বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন। তার মন্তব্য, ‘যারা নতুন বিষয় চালু করতে চায় তাদের এই শর্ত দেওয়া হচ্ছে, যা আইনের মধ্যে পড়ে না। দুই সেমিস্টার হলে শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে বেশি টাকা দিতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের ওপর আর্থিক চাপ পড়বে।’

একই মন্তব্য করেছেন কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এর ট্রাস্টি বোর্ডের জ্যেষ্ঠ অ্যাডভাইজার অধ্যাপক ড. এইচ এম জহিরুল হক। তিনি বলেন, ‘দুই সেমিস্টার চালালে শিক্ষার্থীদের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া তিন সেমিস্টার সফলভাবেই চলে আসছে। সফলভাবে চলা একটি নীতি বাদ দিয়ে নতুন প্রক্রিয়া শুরু না করাই শ্রেয়।’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতির দাবি, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তো সেভাবে ছুটি নেন না। সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মাসের পর মাস ছুটিতে থাকেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সবসময় খোলা থাকে।’

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. চৌধুরী মোফিজুর রহমানের মতে, ‘আমাদের দেশে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে সেগুলোর অধিকাংশই ট্রাই-সেমিস্টার পদ্ধতিতে চলে আসছে। দুই সেমিস্টার পদ্ধতি চালু হলে একজন শিক্ষার্থীকে ছয়-সাতটি কোর্স নিতে হবে। ফলে তাদের বেশি কোর্সের চাপ নিয়ে পড়াশোনার বিষয়টি ভাবা প্রয়োজন। এসব সামাল দিতে সেকশন বেশি রাখতে হবে, ক্লাসরুম বেশি দরকার, শিক্ষকও বেশি লাগবে। আমার মতে এর কোনও মানে নেই।’

অ্যাকাডেমিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের ক্ষমতা থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নির্দেশনা দেয় ইউজিসি। সংশ্লিষ্টদের মতে, ‘এটি ইউজিসির ক্ষমতা দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়।’

এ প্রসঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. এম. আনিছুর রহমান। তার অভিমত, ‘করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে কোনও আলোচনা ছাড়াই দুই সেমিস্টারে শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। নতুন করে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনতে হলে চাপে পড়বে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদেরও দুই দফায় পুরো বছরের টাকা পরিশোধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমনিতেই ছাত্র-ছাত্রী পাচ্ছে না, সেখানে হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় আরও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।’

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থীর মন্তব্য, ‘দুই সেমিস্টার করা হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুইবারেই একবছরের টাকা নিয়ে নেবে। সেক্ষেত্রে আমাদের ওপর আর্থিক চাপ বাড়বে। যদি তিন বা চার ভাগে টাকা নেয় তাহলে আমাদের জন্য সুবিধাজনক। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই সুযোগ রাখতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।’

দুই সেমিস্টারের কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির শঙ্কার বিষয়টি তুলে ধরলে ইউজিসি’র সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ উল্লেখ করেন, দুই সেমিস্টারের পাঠ্যসূচির জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তার পরামর্শ, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রয়োজনে সেকশন করতে পারে, আসন বাড়াতে পারে। শিক্ষক ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বিবেচনায় তা করা যেতে পারে। কিন্তু তিন সেমিস্টারে ভর্তি করানো যাবে না।’

ইউজিসি’র আরেক সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীর নতুন নির্দেশনা নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন । তার ভাষ্য, ‘একটি শিক্ষাবর্ষে তিন সেমিস্টার থাকতেই পারে। তবে মূল সেমিস্টার হবে দুটি। মূল দুই সেমিস্টারে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে হবে। যদি কোনও কারণে কোনও শিক্ষার্থী খারাপ করে তাহলে একটি সংক্ষিপ্ত সেমিস্টার থাকতে পারে। ফেল করা শিক্ষার্থীরা সংক্ষিপ্ত ওই সেমিস্টারের মাধ্যমে কাভার করবে। তৃতীয় সেমিস্টারে সংক্ষিপ্ত কোর্স চালানো যেতে পারে, তবে সাধারণ ভর্তি নয়। তিনটি সেমিস্টার হলে একটি সেমিস্টার শেষ না হতেই আরেকটি সেমিস্টার শুরু হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তিন সেমিস্টারেই শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। সে কারণে ছাত্রদের সময় কম থাকে। পাঠদান করা যায় না।’

দুই সেমিস্টারের ফলে বরং শিক্ষার্থীদের লাভ দেখছেন অধ্যাপক আলমগীর, ‘দুই সেমিস্টার করে চার বছরে শিক্ষার্থীরা শেষ করবে। বছরে দুইবার সেমিস্টারের ফি দিতে হবে তাদের। কিন্তু তিন সেমিস্টার থাকলে বছরে তিনবার সেমিস্টার ফি দিতে হবে। বাকি ক্রেডিটের টাকা তো একই থাকে। একজন শিক্ষার্থী কি শুধু ক্লাস করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়? একটি সেমিস্টার শেষের পর শিক্ষার্থীর জন্য একটি বিরতি দরকার। বিদেশে তো তিন মাস বন্ধই থাকে বিশ্ববিদ্যালয়। যারা ফেল করে ওই সময় তারা তৃতীয় সেমিস্টারে কাভার করে নেয়। পাস করা শিক্ষার্থীদের তার দরকার হয় না।’

 

 

 

 

    

/এসএমএ/এসএএস/জেএইচ/
সম্পর্কিত
হিটের প্রকল্প পরিচালক হলেন অধ্যাপক আসাদুজ্জামান
ডিআইইউ’র ১০ শিক্ষার্থী বহিষ্কার: প্রতিবাদে ইউজিসি'তে অবস্থান নেবে ডিইউজে
‘জাবিতে মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ, অন্যথায় সনদ বাতিল ও মামলা’ 
সর্বশেষ খবর
কুকি চিনকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা: নুর
কুকি চিনকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা: নুর
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী