প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কলেজ সরকারিকরণের জন্য সম্মতি দিলেও অধ্যক্ষের অনীহায় আটকে আছে এই প্রক্রিয়া। আরও ‘তিন বছর অধ্যক্ষ হিসেবে থাকার জন্য’ কলেজটি যাতে সরকারি করা না হয় সেজন্য শিক্ষকদের স্বাক্ষর নিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তবে অধ্যক্ষের দাপটের মুখে কেউ মুখ খুলছেন না।
তবে অধ্যক্ষ কানিজ মাহমুদা আকতার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী চেয়েছেন কলেজটি সরকারি হবে, ইনশাল্লাহ হবে। আমাদের একটা জমি নিয়ে সমস্যা আছে; ওই জমির জন্য আমি জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছি। জেলা প্রশাসনের নামে কিছু জমি আছে, ওইটুকু আমাদের নামে হলেই ডিড অব গিফট হিসেবে সরকারকে দিয়ে দেবো। সরকারিকরণ হচ্ছে জাতীয় একটি কাজ, এটা শুধু ওয়ান পার্টি ডিপেন্ডেন্ট নয়। এখানে তিনটা-চারটা-পাঁচটা পার্টি আছে; ছাত্রী, অভিভাবক…।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ সরকারিকরণের লক্ষ্যে ২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর সম্মতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দফতরের নির্দেশনা পেয়ে ২০২০ সালে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়ে আর্থিক সম্মতি দিতে নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের আরেক আদেশে কলেজের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সরকারের নিকট হস্তান্তর করে রেজিস্ট্রি করা দানপত্র দলিলসহ (ডিড অব গিফট) পাঠাতে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু অধ্যক্ষ কানিজ মাহমুদ আকতার তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দেননি। এ কারণে আটকে গেছে কলেজটির জাতীয়করণ প্রক্রিয়া। এমনকি কলেজটি সরকারি না করতে শিক্ষকদের কাছে আবেদনে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
যে কারণে সরকারিকরণে অনীহা
অধ্যক্ষ কানিজ মাহমুদার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ২৪ মে। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমোদন নিয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তৃতীয় ও শেষ মেয়াদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এই দায়িত্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সরকারিকরণ করবেন না। কারণ, কলেজ সরকারি হলে অধ্যক্ষ তার পদে থাকতে পারবেন না। সরকারি হলেই বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাকে পদায়ন করবে সরকার। অন্যদিকে বেসরকারি থাকায় অধ্যক্ষ ও সিনিয়র শিক্ষকরা বেশি বেতন পাচ্ছেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা একবার সরকারি বেতন-ভাতা এবং আরেকবার কলেজের বেতন পাচ্ছেন। কিন্তু সরকারি হলে এক জায়গা থেকে বেতন-ভাতা পাবেন এবং তা অঙ্কেও কমে যাবে।
পদ ধরে রাখতে দফায় দফায় সরকারি নিয়ম ভঙ্গ
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের ২০১৯ সালে জারি করা আদেশ অনুযায়ী, ৬০ বছর পূর্ণ হলে কোনও প্রতিষ্ঠানে কোনও অবস্থাতেই পুনর্নিয়োগ বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যাবে না। অধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে উপাধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ না থাকলে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু কলেজটি সরকারি অনুদানভুক্ত হলেও এ আদেশ না মেনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমোদন নিয়ে দফায় দফায় অধ্যক্ষের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।
এ বিষয়ে অধ্যক্ষ বলেন, ‘আমার চাকরি শেষ হয়েছে ২০২০ সালে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নিয়ে আমি দুই বছর, দুই বছর এবং এক বছর করে মোট পাঁচ বছর থাকতে পারবো।
সরকারি না করতে অধ্যক্ষের উদ্যোগ
কলেজের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কলেজটি যাতে সরকারি না হয় সে জন্য একটি লিখিত আবেদন তৈরি করেছেন অধ্যক্ষ ও তার অনুসারী শিক্ষকরা। বেশ কয়েকজন শিক্ষক এতে স্বাক্ষরও করেছেন। আর জোর করেও স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে কিছু শিক্ষকের। স্বেচ্ছায় স্বাক্ষর করা শিক্ষকদের মধ্যে যারা রয়েছেন তারা সিনিয়র। তবে এ বিষয়ে অধ্যক্ষ কানিজ মাহমুদা আকতার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়নি।’
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ
গত ফেব্রুয়ারিতে অধ্যক্ষ কানিজ মাহমুদা আকতারের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনে তার পুনর্নিয়োগ বাতিল করার দাবিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন এবিএম রাসেল নামে এক ব্যক্তি। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, বেআইনিভাবে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন কানিজ মাহমুদা আকতার। গত ১৪ বছর ধরে অধ্যক্ষ প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়োগ নিয়ে প্রায় তিন থেকে চার কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন অধ্যক্ষ।
জানা গেছে, ২০০৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ পান কানিজ মাহমুদা আকতার। মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আফরোজা শিরীন শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে প্রার্থী নির্বাচন বোর্ডে অনুপস্থিত থাকেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতেই নিয়োগের সুপারিশ করা হয় কানিজ মাহমুদা আকতারকে। তার নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি অভিযোগ করে তৎকালীন গভর্নিং বডির দুই সদস্য বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতেও যান।