ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) বহিষ্কার করা শিক্ষার্থীদের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে শিগগিরই বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করতে বলা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তথ্যমতে, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার ও শোকজ নোটিশ প্রত্যাহারের সুপারিশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। বুধবার (৪ জুন) ইউজিসি থেকে চিঠি প্রস্তুত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) কয়েকজন শিক্ষার্থীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ইউজিসি।
জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করা হয়েছে—এ ব্যাপারে আমরা খুব শক্ত স্ট্যান্ড নিচ্ছি। মন্ত্রণালয়কে এখনই চিঠি দিয়ে জানাচ্ছি যে শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারাদেশ শর্তহীনভাবে প্রত্যাহার করতে। স্থায়ীভাবে শিক্ষার্থীদের যে বহিষ্কার করা হয়েছে, এর চেয়ে গর্হিত কাজ আর হতে পারে না। এটি ছাত্রদের জীবন নষ্ট করে দেওয়া। আমরা ছাত্রদের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিচ্ছি। এখনও শহীদদের রক্তের দাগ মুছে যায়নি, অথচ কীভাবে এমন (স্থায়ী বহিষ্কার) সাহস হয়।’
বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার দাবি রয়েছে শিক্ষার্থীদের, এ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা চিঠিতে ওটাও বলবো। আজকেই আমরা চিঠি পাঠাচ্ছি।’
মঙ্গলবার (৩ জুন) ইউআইইউ’র সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে শিক্ষার্থী সালমান বারী রিজাল, তাকী তাহমীদ, মাশরাত ফারদিন, মেহেদী হাসান মামুনসহ অন্যান্য শিক্ষার্থীর সই করা চিঠি পাঠানো হয় ইউজিসিতে।
চিঠিতে তারা উল্লেখ করেন, ‘আমরা ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী গভীর উদ্বেগ ও চরম মানসিক চাপে পড়ে আজ আপনার দফতরে এই চিঠি নিয়ে এসেছি। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ ও পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দাবিতে ১৩ দফা উপস্থাপন করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করে। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় যৌক্তিক দাবির মুখে প্রশাসন বারবার শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে, আন্দোলন প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে, এমনকি হুমকি-ধমকির মতো অপচেষ্টাও চলে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘সবশেষে ২৬ এপ্রিল ঘটে যাওয়া ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২২ জন শিক্ষক হঠাৎ করে পদত্যাগ করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শোকজ ও বহিষ্কারের নোটিশ দেওয়া শুরু হয়।’
‘গত ২ জুন ঈদের ছুটির আগের দিন, প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থীকে মিথ্যা অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের নোটিশ দেওয়া হয়। গত ২৬ এপ্রিল শিক্ষকদের আটকে রাখার বিষয়টি একেবারেই ভিত্তিহীন এবং বিভ্রান্তিকর।’
ইউজিসির চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন জানিয়ে বলা হয়, ‘বর্তমানে আমরা চরম অনিশ্চয়তায় আছি। আমাদের শিক্ষাজীবন স্থবির হয়ে গেছে। অভিভাবকরা উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের প্রতি একের পর এক অন্যায় করে যাচ্ছে। আমরা চাই ইউজিসি দ্রুত হস্তক্ষেপ করুক।’
চিঠিতে ইউজিসির কাছে শিক্ষার্থীদের দাবি জানিয়ে বলা হয়, ‘ইউআইইউ যেন ঈদের পরপরই খুলে দেওয়া হয়। সব শিক্ষার্থীর বহিষ্কার ও শোকজ নোটিশ অবিলম্বে যেন প্রত্যাহার করা হয়। শিক্ষার্থীদের ওপর হয়রানি বন্ধে যেন কঠোর প্রশাসনিক নির্দেশনা দেওয়া হয়।’
উল্লেখ্য, গত ২৭ এপ্রিল রাতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ) অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে সই করেন রেজিস্ট্রার ড. মো. জুলফিকার রহমান।
নোটিশে বলা হয়, ‘কিছু অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ) কর্তৃপক্ষ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সব অ্যাকাডেমিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থগিত থাকবে।’
গত ২৫ এপ্রিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে উপাচার্য, ডিনসহ সব বিভাগীয় চেয়ারম্যানরা পদত্যাগ করেন। পরদিন ২৬ এপ্রিল রাত ৯টার দিকে তারা পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
ঘটনার সূত্রপাত
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, পিতার মৃত্যুতে মিডটার্ম পরীক্ষা দিতে পারেননি এক শিক্ষার্থী। পরে ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে পরীক্ষা দিতে চাইলে তার কাছ থেকে চাওয়া হয় পিতার মৃত্যুর সনদ। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক নুরুল হুদা ওই শিক্ষার্থীকে বলেন মৃত্যু সনদ সত্যায়িত করে আনতে। এ নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ওই শিক্ষার্থী বিভাগীয় প্রধানের কাছে গিয়ে তার পরীক্ষার অংশ নেওয়ার কথা জানালে তাকে পরে যোগাযোগ করতে বলা হয়। শিক্ষার্থী নির্ধারিত সময়ে বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ওই শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাননি। গত ২৫ এপ্রিল বিভাগীয় প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার কারণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই সময় ছিলেন না বলে জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একটি সূত্র।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন
মিডটার্ম পরীক্ষা দিতে না পারা শিক্ষার্থী প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স অব বাংলাদেশ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট দেন। পোস্টে ওই শিক্ষার্থী মিডটার্ম পরীক্ষা দিতে না পারা এবং বিভাগীয় প্রধানের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত এপ্রিলে বিভাগীয় প্রধানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।
শনিবার (২৬ এপ্রিল) সিএসসি বিভাগের চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে দুপুর ২টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন শিক্ষার্থীরা। তারা জানান, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রশাসনের সাড়া না পাওয়ায় উপাচার্য অধ্যাপক আবুল কাসেম মিয়া এবং বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল হুদার পদত্যাগ দাবি করেন তারা।
আন্দোলন-স্লোগানে শিক্ষকদের অসম্মান
ইউআইইউ’র শিক্ষকরা জানান, শিক্ষার্থীরা যৌক্তিক দাবি করতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের অসম্মানজনক স্লোগান দেয় তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তো রাজনৈতিক দলের মতো আচরণ করতে পারে না। আন্দোলনের নামে শিক্ষকদের অসম্মান করতে পারে না। তারা শিক্ষকের বিরুদ্ধে যেসব ভাষা ব্যবহার করেছে, তা শিক্ষার্থীরা করতে পারে না।