X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

এখনও আপনার গান শুনছি, বহুদূর যেতে হবে...

আবদুন নূর তুষার
১৮ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:২০আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:৪৩

একসঙ্গে দুজন

আইয়ুব বাচ্চুর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ছাত্রলীগ মেডিকেল কলেজ শাখার নবীনবরণ। সোলস এসেছে, আইয়ুব বাচ্চু, নকীব খান, তপন চৌধুরী, নাসিম, রনি, সোলস, মাদার অব ব্যান্ডস ইন বাংলাদেশ। মঞ্চে আমাকে দেখে বাচ্চু ভাই বলেন, কী ডাক্তার! আমি তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমাকে প্রথম ডাক্তার বলে ডেকেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। এরপর আর সেই ডাক কখনও বদলে যায় নাই।
বাচ্চু ভাইয়ের মায়ের অসুখ, ভাইয়ের অসুখ, ওষুধ খাওয়ানোর আগে বাচ্চু ভাই আমাকে ফোন করতেন।
ম্যাগাজিন শুভেচ্ছা’র দ্বিতীয় অনুষ্ঠানে গান গাইলেন বাচ্চু ভাই। সেই তুমি... প্রথম অনুষ্ঠানে মাইলসকে ডেকে আনায় তার অভিমান।
কী ডাক্তার? ভাইকে বাদ দিয়ে ম্যাগাজিন বানিয়ে ফেললেন? রসিকতা করে বললেন, আমরা চাটগাইয়া তো, ইংলিশ ভাল পারি না। বলে হা হা হা করে হাসলেন। এরপর শুভেচ্ছার প্রতিটি বিশেষ অনুষ্ঠান, ঈদ এবং প্রতি চার মাসে একবার বাচ্চু ভাই গান গাইতেন।
তার সলো অ্যালবাম বের হলো, ‘কষ্ট’। ঈদের অনুষ্ঠান শুভেচ্ছার। তিনি গাইলেন- আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি।
উড়াল দেবো আকাশে, হাসতে দেখো গাইতে দেখো, সুখেরই পৃথিবী, নির্ঘুম রাত, ঘুম ভাঙা শহরে, দরজার ওপাশে, সাড়ে তিন হাত মাটি, বাংলাদেশ.... কত যে গান। বিপাশার জন্য শচীনের গান ট্র্যাক করে দিলেন। শুভেচ্ছার ঈদ অনুষ্ঠান, আনন্দমেলার টাইটেল।
বাচ্চু ভাইয়ের এবি কিচেনের চটপটি আর ফুচকা, তার সাথে বিকেলের আড্ডা। শুভেচ্ছা জোর করে বন্ধ করে দেওয়ার পরে তার কষ্ট কে দেখে? আমাকে বললেন, আপনার জন্য বাচ্চু সারা জীবন থাকবে। সত্যি ছিলেন তিনি।
তার কালো লেভিন আর আমার পুরনো স্টারলেট দিয়ে ঢাকা চিটাগাং হাইওয়েতে পাল্লা দেওয়া। গাড়ি থেকে নূরজাহানে নেমে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, মেরেই তো ফেলতেন আমাকে আরেকটু হলে। চাটগাইয়া ভাষায় বললেন, অনর বাংগা গারির শিনার জোর আছে।
বাচ্চু ভাইয়ের সাথে একাধিকবার আমি মঞ্চে ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’ গানটি গেয়েছি। এটা গাওয়ার সময় তিনি আমি দর্শক সারিতে আছি জানলেই মঞ্চে ডেকে নিতেন।
একসাথে জাপান, ইতালি, দুবাই অনুষ্ঠান করতে গিয়েছি। জাপানে এক গিটারের দোকানে ঢুকতেই দোকানি আমাদের পাত্তা না দিয়ে অন্য কাস্টমারের সাথে কথা বলছিল। বাচ্চু ভাই বিনয়ের সাথে বললেন, মে আই প্লে দিস গিটার?
গিটারে বেজে উঠল জিমি হেনড্রিক্স, নফলার ব্রাদার্স আর সান্টানার সুর। তারপর গিটার আর থামে না। শেষে এরিক ক্ল্যাপটন। দোকানের বাইরে ভিড়। কয়েকশ’ লোক। বাচ্চু ভাই বাজিয়ে দিলেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।
গিটারের দোকানি বাচ্চু ভাইকে জড়িয়ে ধরে আর ছাড়ে না। দোতলায় নিয়ে তার দোকানের সব গিটার তাকে মেলে ধরে বলে একটা নিয়ে যাও। যে দাম খুশি সে দাম দাও।
আমি খুশিতে চোখ ভিজিয়ে ফেলেছি। বিদেশে গেলে আমাকে সাথে নিয়ে সবখানে ঘুরতেন। বলতেন ডাক্তার সাথে থাকলে আমি সেফ, বিপদ নাই।
তার মায়ের চিকিৎসাতে আমার খানিকটা ভূমিকা থাকাতে তিনি বারবার সেই কথা বলতেন। গেলাম ইটালি। সেখানে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ইতালিয়ান শ্বেতকায়। সে কোনও কথা বোঝে না। সাউন্ড চেকে বাচ্চু ভাই গেয়ে ফেললেন পরপর, মানি ফর নাথিং, সালটান অব সুইং আর বিউটিফুল টুনাইট। তারপর সাউন্ডের লোক আর তার পিছু ছাড়ে না। আমি হাসি। মাসুদ আর স্বপন ভাই হাসে আর বলে ‘বস ইজ বস’।
টুটুল এলআরবি ছেড়ে দেওয়ায় খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। এরপর এলআরবি’তে কেউ কিবোর্ড বাজায় নাই। তিনি বলতেন সে চলে গেছে যাক, তার জায়গা কাউকে দেবো না। তাকে কয়েকজন গানের শিল্পী বারবার কষ্ট দিয়ে কথা বলেছেন। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, কী করবো ডাক্তার। সব তো সন্তানের মতো। আমি বলেছিলাম, ধৈর্য ধরেন। তিনি অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। কিছুই বলেন নাই, ধৈর্য ধরেছিলেন।
বাচ্চু ভাইয়ের সাথে মাদকবিরোধী কনসার্ট। ক্যানসার সোসাইটির কনসার্ট। বাংলাদেশের ক্রিকেট কনসার্ট। আর্মি স্টেডিয়াম আর ইনডোর স্টেডিয়ামে শুভেচ্ছার ঈদ অনুষ্ঠান। চট্টগ্রামে স্টেডিয়ামে সিনটিলার কনসার্ট। মেডিকেল কলেজের অ্যালামনাই ডে-তে কনসার্ট।
বিরাট শব্দে স্পিকারে ডাক্তার শব্দটা শুনবোই।
একবার বাচ্চু ভাই ব্যাংকক এয়ারপোর্টে সবাইকে ফল কিনে খাওয়াচ্ছেন। কী ব্যাপার ভাইজান? বলেন, পকেটে এত টাকা, কোথায় খরচ করবো? এত টাকা কোথা থেকে এলো? তাই সবাইকে ফল খাওয়াচ্ছি।
একটু পরে এসে বলেন, ডাক্তার মা চলে যাওয়ার পর সব অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছি। সেজন্যই টাকা শেষ হচ্ছে না। কিছুদিন বাচ্চু ভাই সিগারেটও খান নাই।
বাচ্চু ভাই, আপনার প্রায় সব গান আমার মুখস্থ। আপনার গান, আজম খানের গান, মাকসুদ ভাই, মাইলস, ফিডব্যাক, সোলস আমার বড় হওয়ার সঙ্গী। মন খারাপের সময় আমি আপনার গানটা গাই, আমার আরেক ভাই আসিফ ইকবালের লেখা-
বহুদূর যেতে হবে
এখনো পথের অনেক রয়েছে বাকি
ভালোবাসায় বিশ্বাস রেখো
হয়তো অচেনা মনে হতে পারে আমাকে
তুমি ভয় পেওনা
তুমি থেমে যেওনা
তুমি ভয় পেওনা।
বহুদূর যাত্রা করেছেন ভাই আমার। ভয় পাবেন না। এত কোটি মানুষকে জীবনে আনন্দ আর বেদনার সময় গান গেয়ে ভাল রেখেছেন, তাদের দোয়া আপনাকে বহুদূরের সেই দেশে ভাল রাখবেই।
বেঁচে থাকলে প্রিয় বিয়োগের বেদনা হবেই।
আপনার না থাকার বেদনা বাকি সময় বহন করতেই হবে আমাকে।
আমি এখনও আপনার গান শুনছি, বহুদূর যেতে হবে...।
ভালোবাসা।
* লেখাটি  সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আব্দুন নূর তুষারের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া হয়েছে তার অনুমতি সাপেক্ষে

/এমএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কানাডার স্টেডিয়ামে রেকর্ড গড়লেন দিলজিৎ
কানাডার স্টেডিয়ামে রেকর্ড গড়লেন দিলজিৎ
আট গল্পের প্রদর্শনী ‘অল দ্যাট ওয়েদারস’
আট গল্পের প্রদর্শনী ‘অল দ্যাট ওয়েদারস’
অপু-বুবলীর ‘কথাযুদ্ধ’ চলমান, মাঝে শাকিবের বিয়ে গুঞ্জন!
অপু-বুবলীর ‘কথাযুদ্ধ’ চলমান, মাঝে শাকিবের বিয়ে গুঞ্জন!
ইরফান খান: জীবনের মোড় ঘুরেছিল ২০০ রুপির অভাবে!
প্রয়াণ দিনে স্মরণইরফান খান: জীবনের মোড় ঘুরেছিল ২০০ রুপির অভাবে!