X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভালো গানের যুদ্ধে একজন ক্যামেরা সৈনিক

সুধাময় সরকার
০৯ এপ্রিল ২০২২, ১৪:১৩আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০২২, ১৮:০৮

তিন দশক ধরে তিনি ক্যামেরার পেছনে উদয়-অস্ত সৈনিক। এরমধ্যে তিনি করেছেন পাঁচ শতাধিক নাটক, থার্টি ফাইভ মিলিমিটারের ৪০টির মতো টিভিসি আর চারটি সিনেমার কাজ। অথচ তিনি দুই দশক ধরে বাংলার হৃদয়ে ধারণ করে আছেন প্রিয় কণ্ঠশিল্পীর ভূমিকায়।

তার গাওয়া ‘তুমি আমার ঘুম’ শুনে প্রীত হননি, এমন বাংলা গানের শ্রোতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। সোহেল আরমানের কথায়, ইবরার টিপুর সুরে তৈরি অসামান্য এই গানটির জন্ম ২০০২ সালের ৯ আগস্ট। এদিন গানটি রেকর্ডিং শেষে তরুণ শিল্পী টি ডব্লিউ সৈনিক যখন মধ্যরাতে কাকরাইলের ই-কিউ স্টুডিও থেকে বাসায় ফিরছিলেন, তখন একজন শিশু পেছন থেকে ডেকে বললেন, ‘আঙ্কেল এই গানটি সুপার হিট হবে।’ শিশুটির কথা অক্ষরে অক্ষরে লেগে গেলো।

সৈনিক বলেন, ‘সেই শিশুটি আজকের হৃদয় খান। যে নিজেও বিখ্যাত এখন। সে ছিলো আমার জীবনের প্রথম গানের প্রথম শ্রোতা। এরপর তো ২০ বছর কেটে গেল। অনেক চড়াই-উতরাই পার করলাম জীবনে। জীবনের তাগিদে দিন-রাত ক্যামেরা নিয়ে ছুটেছি ক্লান্তিহীন। কিন্তু ভালো কথা-সুরের গান তৈরির নেশা আমার কাটেনি।’

সৈনিকের সাম্প্রতিক সময়ে যাওয়ার আগে পেছনের গল্পটাও জরুরি। ১৯৯০ থেকে কাজ করছেন সিনেমাটোগ্রাফার ইউনিটে। তারও আগে প্রাণের টানে লোকসংগীতে তালিম নিয়েছেন ছায়ানট বিদ্যায়তন থেকে। কিন্তু বাঁচার তাগিদে দ্রুত ঢুকে পড়তে হলো শুটিং ইউনিটে। সেই সুবাদে নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন, খেলা আর মিউজিক্যাল শোতে সৈনিকের অবাধ বিচরণ শুরু হয়। এসব ইউনিটে ফুরসত পেলেই গলা ছেড়ে গান ধরতেন সৈনিক। তার দরদী গায়কীতে মুগ্ধতায় ভাসতেন উপস্থিত শিল্পী-কুশলীরা। এভাবেই দ্রুত নজরে পড়েন ফোয়াদ নাসের বাবু, লাবু রহমান, নকীব খান, কুমার বিশ্বজিৎ, সামিনা চৌধুরীসহ অনেকের। প্রত্যেকেই উৎসাহ দিতে থাকেন- সৈনিক ক্যামেরার পেছন থেকে এবার মঞ্চে ওঠো- গাও।

ভালো গানের যুদ্ধে একজন ক্যামেরা সৈনিক সৈনিক বলেন, ‘‘এসব উৎসাহের রেশ আর মনের টানে অনেক সাহস করে তৈরি করে ফেলি আমার প্রথম গান ‘তুমি আমার ঘুম’। এই গানটি তৈরির পেছনেও রয়েছে আরেক বড় গল্প। সেটা নাহয় অন্য কোনোদিন বলবো। এটুকু বলে রাখি, এই গানটি আমার জীবনের গতি, মোড়, স্বাদ- পাল্টে দেয়। আমি ক্রমশ গুণী মানুষদের সমীহ পেতে থাকি। এই গানের জোরেই আমি বেনসন এন্ড হেজেজ আয়োজিত ২০০৪ সালের স্টার সার্চের মঞ্চে উঠি। সলো পারফর্মার হিসেবে পপুলার চয়েসে বেস্ট অ্যাওয়ার্ড পেলাম।’’

এরপর ক্লোজআপ ওয়ান প্রতিযোগিতার ক্যামেরায় কাজ করতে গিয়ে সৈনিকের কণ্ঠ দারুণভাবে নজরে আসে কুমার বিশ্বজিৎ, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ও সামিনা চৌধুরীর। অবসর পেলেই সৈনিকের কাজ ছিলো ‘তুমি আমার ঘুম’ গানটি গেয়ে শোনানো। এমনকি এই গানটি দিয়ে করা হতো সাউন্ড চেকও। একই সময়ে সৈনিক আরও একটি গান রেকর্ড করেন- ‘যৌবনেরই পানসী বেয়ে’। এটি লিখেছেন তারই বাবা আব্দুল ওয়াহাব। সুর করে ইবরার টিপু। তো এই দুটি গান নিয়ে শুটিং ইউনিটে ইউনিটে ভালোই জনপ্রিয়তা কেড়ে নেন ক্যামেরাম্যান সৈনিক। কারণ, গান দুটি কোথাও প্রকাশ হয়নি। অ্যালবাম করতে লাগে ১২টি গান। সেটি করার সময়-সুযোগ বা অভিজ্ঞতাও ছিলো না তরুণ সৈনিকের।

প্রথম অ্যালবাম তৈরির গল্পটা এমন, ‘ক্লোজআপ ওয়ান ইউনিটের ক্যামেরার কাজ করছি তখন। ২০০৩/৪ সালের দিকে। একদিক কুমার বিশ্বজিৎ দাদা ডেকে বলেন, আমরা তো গানচিল নামের একটা প্রতিষ্ঠান করছি। তোর গান কয়টা করা আছে? বললাম- দুটো। দাদা হতাশ হলেন। বললেন, লাগে তো ১২টা গান। আচ্ছা তুই আরও ৭টা গান এটলিস্ট রেডি কর। আমি তোর অ্যালবাম বের করে দিচ্ছি। দাদার সেদিনের সেই কথাটি আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত। আমি তো আনন্দে আত্মহারা। আমার একক অ্যালবাম হবে!’

এরপর বসে না থেকে টি ডব্লিউ সৈনিক দ্রুত সময়ে তৈরি করলেন আরও ৭টি গান। এরমধ্যে আরেকটি গান নিলেন সোহেল আরমান ও তার বাবা আব্দুল ওয়াহাবের কাছ থেকে। বাকি পাঁচটি গান নিলেন জুলফিকার রাসেলের কাছ থেকে। সব গানের সুর করলেন ইবরার টিপু। রেকর্ডিংয়ে তার খরচ হলো ৪২ হাজার টাকা। অবশেষে ২০০৬ সালে প্রকাশ হলো বাংলা গানের অন্যতম সুপারহিট অ্যালবাম ‘তুমি আমার ঘুম’।

কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে সৈনিক বলেন, ‘গানে আমার যেটুকু অর্জন, তার জন্য সিংহভাগ কৃতজ্ঞতা আমার বাবা আব্দুল ওয়াহাব, ভাই সোহেল আরমান, বন্ধু জুলফিকার রাসেল, ইবরার টিপু এবং কুমার বিশ্বজিৎ দাদার প্রতি। এরমধ্যে তিন গীতিকবিকে তো আমি এক পয়সাও দিতে পারিনি। জুলফিকার রাসেল বিনাবাক্যে বিনা পয়সায় তখন আমাকে ৫টি গান দিয়ে দিলো! অথচ আমি কিছুই করতে পারিনি। এটা আমার বড় দুঃখবোধ। ৪২ হাজার টাকা স্টুডিও পেমেন্ট করে আমি নিজেও তখন খানিক অসহায় ছিলাম।’

ভালো গানের যুদ্ধে একজন ক্যামেরা সৈনিক প্রকাশের পরই অ্যালবাম সুপারহিট। তার বিপরীতে শিল্পী-প্রযোজক টি ডব্লিউ সৈনিক এক টাকাও পাননি। বিপরীতে নিজের কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের জন্য ঢাকার ফ্ল্যাট ও গ্রামের জমি বিক্রি করতে হলো সৈনিককে। অভিমান চেপে মজার ছলেই বললেন, ‘অনেকেই বলে, আমি নাকি এই এক অ্যালবামের টাকা দিয়েই অডি গাড়ি চালাতে পারতাম! যদিও আমর মধ্যে এসব বিলাস কখনোই ছিলো না। আমি বরাবরই চেয়েছি ভালো কথা-সুরের কিছু গান করতে। সেটাই আমার বাঁচার অবলম্বন। যদিও কিডনি জটিলতায় পড়ে সব বিক্রি করার পর মনে হচ্ছে- টাকাটাও জীবনে একটা ফ্যাক্টর। যাইহোক, বাবা নাম রেখেছেন সৈনিক। আমিও সেই পরিচয়েই জীবনটাকে দেখি। একজন যোদ্ধার বেশে।’    

এরপর ২য় একক অ্যালবাম প্রকাশ হয় ২০১৫ সালে, ‘ঘুমের পরে মেঘ’। ঈগল মিউজিক থেকে। এই অ্যালবামের ‘কেমন করে বৃষ্টি বানাও মেঘ’ গানটি ভালো হিট করে। কাছাকাছি সময়ে লেজার ভিশন থেকে প্রকাশ হয় ফজলুর রহমান বাবু, চঞ্চল চৌধুরী ও টি ডব্লিউ সৈনিকের মিশ্র অ্যালবাম ‘মনচোরা’। এখান থেকে হিট হয় সৈনিকের ‘আমপাতা’ গানটি। আরও প্রকাশ হয় সামিনা চৌধুরীর সঙ্গে ‘মনের দুয়ার’ প্রভৃতি।

গাতক হিসেবে পেয়েছেন সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডসসহ প্রচুর স্বীকৃতি। গেয়েছেন গানবাংলার উইন্ড অব চেঞ্জ মঞ্চেও।

কিন্তু প্রথম হিট একক থেকে দ্বিতীয় একক প্রকাশে প্রায় ১০ বছর সময় লাগলো কেন? অথবা প্রথম অ্যালবাম সুপার হিটের পরে তো আরও অসংখ্য গান আর অ্যালবামে সৈনিককে পাওয়ার কথা ছিলো শ্রোতাদের। জবাবে সৈনিক বলেন, ‘অজুহাত টাইপের কারণ হলো লিরিক পছন্দ হচ্ছিলো না। আর মূল কারণ হলো থার্টিফাইভ ক্যামেরা নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ি তখন। এই ফরমেটে কাজ করে এক ধরণের নেশায় পড়ে যাই। সেজন্যই গানের কাজ করা হয়নি।’

ভালো গানের যুদ্ধে একজন ক্যামেরা সৈনিক

তবে আশার কথা এরমধ্যে সৈনিক তার তৃতীয় এককের জন্য সাতটি গান প্রায় তৈরি করে ফেলেছেন। যেগুলো ভিডিওসহ ক্রমশ প্রকাশের আলোয় আনবেন। যার বেশিরভাগ গান তিনি নিজেই লিখেছেন। যথারীতি এখানেও থাকছেন তার লাকি গীতিকবি সোহেল আরমান। আর সুরের ভার নিয়েছেন শেখ সাদী খান, ইউসুফ আহমেদ খান, সুমন কল্যাণ, রাজন সাহা, ফরহাদ, রাজবীর ও মুনতাসির তুষার।

তৃতীয় অ্যালবামের বাইরে সৈনিক আরও করছেন আঞ্চলিক একটি ঐতিহাসিক গান। যে গানটি দেশের সব অঞ্চলের ভাষায় তৈরি হচ্ছে। এরমধ্যে রংপুর অঞ্চলের গানটি গাইছেন সৈনিক। সম্প্রতি গাইলেন ‘মেঘ রোদ্দুর খেলা’ নামের সিনেমাতেও।

সৈনিক বলেন, ‘‘দুই বছর হলো কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হলো। এখন বেশ ভালো আছি। সেজন্যই আবার শুরু করছি শুরু থেকে। ঘুরে দাঁড়াতে চাই। ক্যামেরা ও গানে। জীবনের জন্য ক্যামেরা আর মনের ক্ষুধার জন্য গানটা লাগবেই। আমার স্বপ্ন আরও কিছু অসাধারণ বাংলা গান করে যেতে চাই মৃত্যুর আগে। যে গান আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। সত্যি বলি, আমি এখন যে বেঁচে আছি সেটা ‘তুমি আমার ঘুম’ গানটির জোরে। গানটি যখন অদূরে কোথাও বাজে কিংবা কেউ যদি কাছে এসে গানটির কথা আমাকে বলে- আমি প্রতিবার নতুনকরে বেঁচে উঠি।’’

না, তিন দশক ধরে সিনেমাটোগ্রাফি করলেও- নির্মাতা হওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই সৈনিকের। বললেন, ‘ওটা অনেক কঠিন কাজ। আমাকে দিয়ে হবে না। বরং আমি ক্যামেরা চালানোর ফাঁকে গানটাই গাইতে চাই প্রাণ ভরে।’

/এমএম/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
‘জংলি’ মিশনে সিয়ামের সঙ্গী বুবলী
‘জংলি’ মিশনে সিয়ামের সঙ্গী বুবলী
পুরনো লাইনআপে ফিরছে ‘ব্ল্যাক’!
পুরনো লাইনআপে ফিরছে ‘ব্ল্যাক’!
ফটোগ্রাফারদের ওপর খেপলেন নোরা ফাতেহি!
ফটোগ্রাফারদের ওপর খেপলেন নোরা ফাতেহি!
শিল্পকলায় মঞ্চায়িত হলো আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ‘হি-রোজ’
শিল্পকলায় মঞ্চায়িত হলো আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ‘হি-রোজ’
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…