X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০
সিনেমা রিভিউ

হাওয়া: পুরাণ-বর্তমান, কল্পনা-বাস্তবের মোহনীয় মিথস্ক্রিয়া

আলম খোরশেদ
০৪ আগস্ট ২০২২, ১৪:২৫আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২২, ১৯:৩২

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের আঙিনায় ক্ষীণ হলেও সুন্দর ও সুস্থির এক সুবাতাসের আনাগোনা লক্ষ করা যাচ্ছিলো। আনন্দময় সেই ‘হঠাৎ পাওয়া’ ‘হঠাৎ হাওয়া’র চিলতে ধারাটিই যেন কোনও এক জাদুবলে দীর্ঘস্থায়ী, শক্তিমত্ত ও সর্বব্যাপী স্বস্তির ঝাপটা হয়ে বয়ে এলো সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের সাহসী ডানায় ভর করে। 

নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন তার চলচ্চিত্রের উপজীব্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ব্যতিক্রমী ও বৈচিত্র্যময় একটি বিষয়- দক্ষিণবঙ্গের সমুদ্রগামী জেলেদের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনের নিত্যদিনের লড়াই, সংগ্রাম, আশা-নিরাশা, প্রেম, প্রতিহিংসা, স্বপ্ন, সংকটের কাহিনি ও কাব্যকে। 

আমার জানা মতে, বাংলা চলচ্চিত্রে নদীভিত্তিক জেলে সম্প্রদায়ের জীবনের গল্প বহুবার বহুভাবে এলেও সমুদ্রগামী মৎস্যশিকারিদের জীবন ও জগৎ নিয়ে এটাই সম্ভবত প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র। তবে মেজবাউর রহমান সুমন শুধু একটি চমকপ্রদ, চিত্তাকর্ষক বিষয় নির্বাচন করেই থেমে থাকেননি, তিনি তার সহজাত প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তায় এর সঙ্গে যুক্ত করে নেন প্রাচীন বাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয় সমুদ্র ও সর্পকেন্দ্রিক পুরাণ লোককথা- চাঁদ সওদাগর, মনসাদেবী আর বেহুলা-লখিন্দরের অমর আখ্যান। আর তাতেই ছবিটি স্রেফ সরলরৈখিক একটি গল্পের বর্ণনায় সীমাবদ্ধ না থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বহুমাত্রিক স্তরে উপনীত হয়েছে। যাকে এই রচনার শিরোনামে ‘পুরাণ-বর্তমান, কল্পনা-বাস্তবের মোহনীয় মিথস্ক্রিয়া’ বলে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছি। ছবির পোস্টার

এই চলচ্চিত্রের কাহিনিসূত্র আসলে সামান্যই। চান মিঞা (যাকে আমরা সহজেই চিনে নিতে পারি আমাদের সেই পুরাণকথিত চাঁদ সওদাগরেরই সমকালীন সংস্করণ হিসেবে) নামের এক প্রবীণ ও প্রভাবশালী মাঝি। সে মহাজনের কাছ থেকে নৌকা ও জাল ভাড়া করে, সাত-আটজন সহযোগী নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাত্রা করে। চান মাঝি বা চঞ্চল চৌধুরী  

তাদের সেই মৎস্য শিকারের দৈনন্দিন আয়োজনসমূহ ঠিকঠাকই চলছিল, একেবারে রুটিনমাফিক। ভালো ও মন্দ, ইতি ও নেতি, আলো ও অন্ধকারের স্পর্শমাখা তার সমুদয় পার্শ্বকাহিনিসুদ্ধও। কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল একদিন তাদের নৌকায় জালের সোপান বেয়ে মাছের বদলে জলজ্যান্ত এক মানবীর (নাকি খোদ মনসারূপী কোনও দেবীদুহিতার?) উঠে আসার পর। এসব পরিস্থিতিতে যা হয় আর কি, একটি ক্ষুদ্র পরিসরে আবদ্ধ বিভিন্ন বয়সী ও বিভিন্ন মানসিকতার পুরুষের মাঝখানে আচমকা একজন আকর্ষণীয় নারীর উপস্থিতিতে ক্রমে তাদের সম্পর্কের সমীকরণ বদলে যেতে থাকে। তুষি (ডানে) ও অন্যরা

কিন্তু এও তো তেমন নতুন কিংবা চমক লাগানো কিছু নয়। ইতোপূর্বে দেশি ও বিদেশি বহু গল্প, উপন্যাস, নাটকে ও চলচ্চিত্রেই তো এসবের দেখা পেয়েছি আমরা। ‘হাওয়া’র চমৎকারিত্বটুকু তাহলে কোথায়?

সেটি নিহিত রয়েছে পরিচালকের এমন শিল্পিত ও সৃষ্টিশীলভাবে আমাদের লোক ঐতিহ্যের পুরাণ-প্রতিমাকে প্রাসঙ্গিক ও সমকালীন করে তোলা এবং তার অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সমাজ-মনস্তত্ত্ব উদঘাটনের  পাশাপাশি, তাকে বৈশ্বিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করতে পারার মধ্যে। এবং সেই কাজটিও সুমন ঠিক গতানুগতিক ও একরৈখিক উপায়ে না করে কিছুটা নিরীক্ষা ও নতুনত্বের আশ্রয় নেন।

যেমন ধরা যাক, চান মিঞার (চঞ্চল চৌধুরী) চরিত্রটি। মনসামঙ্গল কাব্যে আমরা জানি চাঁদ সওদাগর কিছুতেই মনসাদেবীর পূজা করতে ও তার কাছে নতজানু হতে সম্মত হন না। যেটি এক অর্থে তার পুরুষতান্ত্রিক শ্রেষ্ঠত্বেরই অবচেতন প্রতিফলন। অথচ এখানে আমরা দেখি ঠিক তার উল্টোটা। চান মিঞাই বরং এই সমুদ্রমানবী গুলতির (প্রসঙ্গত বলি মনসাদেবীর প্রতিনিধি জলকন্যার এই শহুরে, সপ্রতিভ ‘গুলতি’ (নাজিফা তুষি) নামটি একেবারেই বেমানান মনে হয়েছে আমার কাছে। নামে কিন্তু আসলেই কিছু আসে যায়) সান্নিধ্য ও আনুকূল্য কামনা করে প্রবলভাবে, যা সে পূরণ তো করেই না উল্টো তাকে প্রত্যাখ্যান এমনকি প্রত্যাঘাতও করে। এই সচেতন ভূমিকা বদলের মাধ্যমে চলচ্চিত্রকার মনসামঙ্গলের একটি ইতিবাচক, নারীবাদী বিনির্মাণই উপহার দেন আমাদের। গুলতি বা তুষি

এর বাইরে, মনসাপুরাণের আদি আখ্যানে বর্ণিত মনসাকর্তৃক চাঁদ সওদাগরের নৌকোকে মধ্যসাগরে ডুবিয়ে দেওয়া এবং একে একে তার ছয় ছয়টি পুত্রসন্তানকে হত্যার সঙ্গে এই ছবির চরিত্র চান মিঞার নৌকাটিকে জালহারা, পালছেঁড়া ও নোঙরবিহীন করে দেওয়ার মধ্যে স্পষ্ট মিল লক্ষ করি। 

অন্যদিকে এই মনসা-ই আবার ছবির শেষ পর্যায়ে সর্পরূপে চান মিঞা ও তার সাগরেদ নাগুকে বিষাক্ত ছোবল হেনে তার অপমান ও নিপীড়নের প্রতিশোধ গ্রহণের পর নিজেকে অবলীলায় লোকায়ত বাংলার আরেক কিংবদন্তি চরিত্র বেহুলায় রূপান্তরিত করে ফেলে।

আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই আধুনিক বিনির্মাণ ও নবীকরণের মাধ্যমে তাকে একইসঙ্গে সমকালীন ও চিরকালীন করে তুলতে পারাটাই আসলে এই ছবির সবচেয়ে বড় অর্জন।

তবে একটি কথা না বললেই নয় যে, বর্তমানের সঙ্গে পুরাণের, কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের এই মিশ্রণ ও সংযুক্তিকরণের প্রক্রিয়াটি অতটা মসৃণ কিংবা স্বচ্ছন্দ না হওয়ার কারণেই সম্ভবত ছবিটি একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়ারও জন্ম দিয়েছে। দর্শকদের কেউ একে দেখেছেন একটা থ্রিলার হিসেবে, কেউবা স্রেফ একটি সামুদ্রিক অ্যাডভেঞ্চার তথা ‘হাই সি ড্রামা’ রূপে; আবার কারও কারও কাছে তা প্রতিভাত হয়েছে রূপকথা কিংবা ফ্যান্টাসির চেহারায়। কেউ কেউ এমনকি জেলে জীবনের সাদামাটা ও নিরেট বাস্তবতার সঙ্গে উপস্থাপিত ঘটনা-পরম্পরার যৌক্তিক মেলবন্ধন ঘটাতে না পেরে একে ‘গাঁজাখুরি’ আখ্যা দিতেও দ্বিধা করেননি। 

এ প্রসঙ্গে আমরা ছবির একেবারে শুরুতেই জনৈক ক্যানভাসারের কণ্ঠে বেশ দীর্ঘ ও গুরুগম্ভীর বক্তৃতার সিকোয়েন্সটির কথা স্মরণ করতে পারি। দ্রুতগতির ক্যামেরা চালনা, প্রচুর ইন্টারকাট এবং পরিপার্শ্বের উচ্চকিত শব্দসহূহের আগ্রাসনে যার অধিকাংশ কথাই ঠিকঠাক বোধগম্য হয়নি, অন্তত আমার। তবে ছেঁড়া ছেঁড়াভাবে যেটুকু অংশ কান অবধি এসে পৌঁছুতে পেরেছিল, তাতে মনে হয়েছে সেই লোক দার্শনিকের সুচয়িত বাক্যসমূহের মধ্যে, পর্দায় গল্পের গূঢ়ার্থটুকু বোঝার সুবিধার্থে দর্শকদের জন্য কিছু সহায়ক সূত্র ও নির্দেশিকা নিহিত ছিল। কিন্তু হায়, তার অনেকটাই মাঠে মারা গিয়েছিল ক্যামেরার অতিরিক্ত গতিময়তা ও উচ্চকিত আবহ সংযোজনের ফলে। এর পুনরাবৃত্তি আমরা পরে মূল ছবিতেও লক্ষ করেছি কখনও কখনও, যা ছবির পুরোপুরি রসাস্বাদনে কিছুটা বিঘ্ন ঘটিয়েছে বলা যায়।

এটি সম্ভবত ঘটেছে আমাদের অধুনা ওটিটিনির্ভর দ্রুতগতিসম্পন্ন থ্রিলারধর্মী ওয়েব সিরিজসমূহের অবচেতন প্রভাবে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার, শিল্পের জন্য গতি ও বাঙ্ময়তার প্রয়োজন যতটা, ঠিক ততটাই দরকার স্থিতি ও নীরবতারও। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দৃশ্য

কিন্তু ‘হাওয়া’ ছবির অপরাপর অনুষঙ্গসমূহ যেমন অভিনয়, চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা, আবহ, সংগীতায়োজন, শিল্প নির্দেশনা, ডিটেইলসের প্রতি মনোযোগ, প্রযুক্তি দক্ষতা ইত্যাদি প্রতিটি বিভাগে প্রভূত উৎকর্ষের স্বাক্ষর রেখেছে। যার কারণে মাঝেমধ্যেই এটিকে ঠিক বাংলাদেশের ছবি বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির এই একটি শাখা, চলচ্চিত্রকে নিয়ে যে একটা চাপা বিক্ষোভ, মর্মবেদনা এমনকি হীনম্মন্যতা কাজ করতো প্রায়শই। আজ হলফ করে বলতে পারি, ‘হাওয়া’ তার অনেকটাই কাটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে এর সর্বৈব চলচ্চিত্রিক শক্তি ও সামর্থ্যের জোরে। এ হাওয়া বইতে থাকুক নিরন্তর, নিরবধি।

 

লেখক: অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব

/এম/
সম্পর্কিত
রাজ’কীয় ছবির প্রথম ঝলক (ভিডিও)
রাজ’কীয় ছবির প্রথম ঝলক (ভিডিও)
ঈদ মিছিলে জেফারকে নিয়ে যোগ দিলেন চঞ্চল
ঈদ মিছিলে জেফারকে নিয়ে যোগ দিলেন চঞ্চল
কপি’যুদ্ধ সেরে বুবলীর রাজ’কীয় চমক!
কপি’যুদ্ধ সেরে বুবলীর রাজ’কীয় চমক!
‘ওমর’ চমক দর্শনা, কেমন জমবে রাজ-রসায়ন
‘ওমর’ চমক দর্শনা, কেমন জমবে রাজ-রসায়ন
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং
পুষ্পা: আসবে তৃতীয় কিস্তি!
পুষ্পা: আসবে তৃতীয় কিস্তি!