নায়ক শাকিব খান ও পরিচালক রায়হান রাফী ‘কেমিস্ট্রি’র নতুন ছবি ‘তাণ্ডব’। আলোচনার জন্ম দেয়া এবং সাধারণ দর্শকদের হলমুখি করা ঈদের ছবি ‘তাণ্ডব’। প্রচলিত বাংলা ছবির ঘরানায় প্রেম ও প্রতিশোধের সাথে বাস্তব ঘটনার মিশেলে ‘জনরা’ আলাদা করার এক ছবি ‘তাণ্ডব’। শাকিব খানের সাথে আফরান নিশো ও সিয়ামের পর্দা উপস্থিতির এক ছবি ‘তাণ্ডব’। একই সাথে ২০২৫ সালে ভিন্নধর্মী এক প্রশ্নের জন্ম দেয়ার ছবিও ‘তাণ্ডব’!
একটি টেলিভিশন চ্যানেলে আবহাওয়ার খবর আর বানর খেলার দৃশ্য দিয়ে শুরু হয় ছবিটি। শুরুতেই দেখা যায় একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সদস্যদের জিম্মি করে একদল লোক। জানা যায় ছবির নায়ক স্বাধীন ২২ বার ইন্টারভিউ দিয়েও চাকরি পায় না, এজন্য তার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাবে। এই ভয়ে স্বাধীন আসে চাকরির খোঁজে ঢাকায়। জিম্মিকারীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজি ও চ্যানেলের মালিককে হাজির করতে বলে টেলিভিশনে। জিম্মি বা বন্দী হওয়া মানুষকে বাঁচাতে ঐ চ্যানেলের সাবেক এক সংবাদ উপস্থাপক, মন্ত্রী, আইজি এবং চ্যানেলের মালিক আসেন টেলিভিশনে। শুরু হয় সরাসরি সম্প্রচার, একই সাথে শুরু হয় ছবির আসল গল্প। ছবির শেষেও আছে টুইস্ট বা গল্পের মোচড়। 
‘তাণ্ডব’ ছবিতে স্বাধীন চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাকিব খান। সংবাদ উপস্থাপক সায়রার চরিত্রে জয়া আহসান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকায় আফজাল হোসেন, আইজির চরিত্রে শহীদুজ্জামান সেলিম এবং টেলিভিশনের মালিকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন গাজী রাকায়েত। স্বাধীনের প্রেমিকা নিশাতের চরিত্রে সাবিলা নূর, সোয়াতের অফিসার হিসেবে এফএস নাঈম, ফজলুর রহমান বাবু, ছায়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রোজী সিদ্দিকী, আয়রন সেলের প্রধান হিসেবে শিবা সানু, টেলিভিশনের সিইও হিসেবে মুকিত জাকারিয়া, বর্তমান মন্ত্রীর চরিত্রে ডা. এজাজ এবং সুমন আনোয়ারও এই ছবিতে অভিনয় করেছেন। দুই অতিথি চরিত্রে আফরান নিশো এবং সিয়াম আহমেদ অভিনয় করেছেন। ছবিতে কম বেশি সবাই ভালো অভিনয় করেছেন। জয়া এবং নতুন ছবি হিসেবে সাবিলা নূর যেমন ভালো করেছেন তেমনি অতিথি চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন সিয়াম আহমেদ।
‘তাণ্ডব’ ছবির টাইটেল ট্র্যাক লিখেছেন ও কণ্ঠ দিয়েছেন শিফাত আবদুল্লাহ আবির এবং ‘ভালোবাসার আরেক নাম’-এর কথা, সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন অচিন মানুষ। ‘কে দিলো পীরিতের বেড়া’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন প্রীতম হাসান, জেফার রহমান, মঙ্গল মিয়া ও আলেয়া বেগম। সাত্তার পাগলার এই গানে নতুন করে কথা বসিয়েছেন প্রীতম হাসান, মেহেদী আনসারি ও তাহাসিন। এছাড়া ‘খবর দে’ শিরোনামের গানটির কথা লিখেছেন রবিউল ইসলাম জীবন।
ফর্মুলা ও মারপিট ছবি হলেও ‘তাণ্ডব’ ছবির ভালো দিক এর নির্মাণ এবং টান টান উত্তেজনা ধরে রাখার চেষ্টা। সিনেমাটোগ্রাফিও ভালো। আরেক ভালো দিক সবার অভিনয়। জয়া আহসানের মা-এর কাছ থেকে দোয়া নেয়া, রাজনৈতিক বাস্তবতা, দৃশ্যায়নসহ সব কিছুর মিশ্রণ ছবিকে জনপ্রিয় করতে পারে। 
এবার ভিন্নধর্মী প্রশ্ন তোলার পালা। পরিচালক রায়হান রাফীর ছবিগুলো সমাজ বাস্তবতা তুলে ধরে এমন দাবি করা হয়ে থাকে। ‘পরাণ’ ছবির প্রচারণায় বাস্তব ঘটনার মিশেল বলা হয়েছিল, ‘দামাল’ ছবিটাও শতভাগ বাস্তবতা, অনুপ্রেরণা ও দেশপ্রেমের ছবি। ‘তাণ্ডব’ ছবির প্রচারণায় সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার কোনও কিছু বলা না হলেও স্পষ্ট বোঝানো হয়েছে, গত পনের ষোল বছরের শাসন তথা ‘আয়না ঘর’ (যাকে ছবিতে বলা হয়েছে আয়রন সেল) গুম ও খুনের কাহিনি। দেখানো হয়েছে আয়রন সেলের ভেতরে দীর্ঘ মারপিটের দৃশ্য, যার শেষটা শিবাসানুর কাটা মাথাটা হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে যায় শাকিব খান। ছবিতে স্বাধীন চরিত্রের শাকিব খান মন্ত্রীদের সিনেমাটিক ও সরাসরি সম্প্রচারিত বিচারের পর কাভার্ড ভ্যান টাইপের এক গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দেন। সেখানে হত্যা, গুম, খুনের বিপরীতে একটা সুশাসনের দেশ কামনা করা হয়। বক্তব্য শেষে সোয়াত পুলিশের সদস্যদেরও তালি দিতে দেখা যায়।
এরপরেই আসে গল্পের টুইস্ট। জানা যায়, যে স্বাধীন এত কিছু করলো সে আসলে সেই স্বাধীন না। সে দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী মিখাইল! এখন কেউ যদি প্রশ্ন তোলে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বা জুলাই অভ্যুত্থানের সাথে কী শীর্ষসন্ত্রাসীরাও জড়িত ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর কী হবে? বাংলাদেশ ব্যাংক কি ডাকাতি করা যায়? জয়া আহসান কীভাবে তার ছেড়ে যাওয়া চ্যানেলে একটা অনুষ্ঠানে ফিরলো? স্বাধীনরূপী মিখাইলকে সে যাচাই করেনি কেন? অগণিত লোক এই জিম্মি করার দৃশ্য দেখছিল। একজন ছাড়া কেউ মিখাইলকে চিনতে পারলো না কেন?
সব মিলিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ এক ছবি ‘তাণ্ডব’।
জানি না গল্পের এই টুইস্ট পরিচালকের মাথায় ছিল কি না। হয়তো তিনি এমন না ভেবেই এই ছবি নির্মাণ করেছিলেন। ছবির অনেক দিক গোপনও রেখেছিলেন। সন্ত্রাস, খুন বা মারপিটের ফর্মুলা ছবি এ দেশে নির্মিত হতো মূলত হিন্দি ছবিকে মাথায় রেখে। হাল আমলের বাংলা ছবি দেখে মনে হয় এগুলো তামিল ছবির ছায়া, আমাদের গল্পের ছবি নয়! 
তাণ্ডব: ৬/১০
পরিচালক: রায়হান রাফী
অভিনয়ে: শাকিব খান ও সাবিলা নূর
প্রযোজনা: আলফা আই-এসভিএফ
মুক্তি: ৭ জুন ২০২৫
সমালোচক: রম্যলেখক, সাংবাদিক ও কবি
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।
আরও সমালোচনা:
‘জংলি’ ৫/১০: জন্ম না দিয়েও আদর্শ বাবা হতে পারার ছবি
‘চক্কর ৩০২’ ৭/১০: গল্পের চক্করে ভরা এক ছবি
‘দাগি’ ৭/১০: প্রায়শ্চিত্তের গ্লানি মাখা এক ছবি
‘বরবাদ’ ৫/১০: শিশুদের নিয়ে না দেখার মতো ছবি
৮৪০: রহস্যময়তার আড়ালে মজাদার এক রাজনৈতিক স্যাটায়ার
দরদ: দরদহীন নির্মাণের এক প্রশ্নবিদ্ধ ছবি!
৩৬-২৪-৩৬: সিনেমার পর্দায় ‘ওটিটি কনটেন্ট’
তুফান: সন্ত্রাসকে গ্ল্যামারাইজ করতে চাওয়া এক ছবি
ফাতিমা: সাধারণ এক নারীর ‘অসাধারণ’ সংগ্রামের ছবি
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
রাজকুমার: ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ এক বিয়োগান্তক ছবি
কাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
হুব্বা: সামথিং লাইক আ ক্রিমিনাল’স অটোবায়োগ্রাফি!
খুফিয়া: বাংলাদেশ নিয়ে ‘শঙ্কা ও ভাবনার’ ভারতীয় ছবি!
অন্তর্জাল: সাইবার থ্রিলার নিয়ে স্মার্ট ছবি
এমআর-৯: ‘মাসুদ রানা’ আছে ‘মাসুদ রানা’ নেই!
১৯৭১ সেই সব দিন: ৫৩ বছর আগের বাস্তবতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা
আম কাঁঠালের ছুটি: দুরন্ত শৈশব মনে করিয়ে দেয়া এক ছবি
প্রিয়তমা: পরিচিত গল্প আর ‘তাড়াহুড়ো’য় নির্মিত ছবি!
প্রহেলিকা: ছবিটি দেখলে কিছু প্রশ্ন উঠবেই
‘পরাণ’-এর আরেক ভার্সন ‘সুড়ঙ্গ’!
সুলতানপুর: ফর্মুলায় আক্রান্ত ধারাবাহিকতাহীন ছবি
আদিম: ‘বস্তি ঘনিষ্ঠ’ এক অপরূপ ছবি!
পাপ: শেষ না হওয়া এক থ্রিলার গল্পের ছবি
কিল হিম: বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন অনন্ত, কিন্তু সেটা নড়ে না!
লিডার: স্বস্তি আর অস্বস্তির পাঁচ-ছয়
লোকাল: রাজনীতির ব্যানারে প্রেম ও প্রতিশোধের ছবি!
জ্বীন: ‘জিন ছাড়ানো’র কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছবি!
