X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

সিনে বাজারের রুক্ষ বাস্তবতা: হল আছে, হল নেই

কামরুল ইসলাম
০১ নভেম্বর ২০২২, ১০:১১আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২২, ১৬:৪৪

শিল্প নাকি ব্যবসা, চলচ্চিত্র আসলে কী? এই প্রশ্ন বা বিতর্ক নতুন নয়। স্বাধীন নির্মাতা-শিল্পীদের কাছে এটি জীবন, সমাজ, রাষ্ট্রের নিরেট চিত্র তুলে ধরার শিল্প; অন্যদিকে প্রদর্শক-প্রযোজকদের কাছে এটি মূলত ব্যবসা। যদিও দুটো বিষয় একটা পর্যায়ে গিয়ে একই মোহনায় মিলিত হয়। কিন্তু দুটি আলাদা বিষয়ের নিরিখে যে ব্যবধান গড়ে উঠেছে, তা মাঝেমাঝেই মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।
 
যেমনটা বর্তমানে দেখা যাচ্ছে মুক্তি প্রতীক্ষিত ছবি ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে ওড়া’র ক্ষেত্রে। নির্মাতা মুহাম্মদ কাইউমের প্রায় দুই যুগের স্বপ্ন, পাঁচ বছরের সাধনার ফসল এটি। আগামী ৪ নভেম্বর ছবিটি মুক্তি দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু সিনে ব্যবসার রুক্ষ বাস্তবতার শিকার ভাটি অঞ্চলের গল্পে নির্মিত এ ছবি। মুক্তির তিনদিন আগ (৩১ অক্টোবর) পর্যন্ত একটি হলও চূড়ান্ত হয়নি ছবিটির। কারণ কোনও হল কর্তৃপক্ষ এটি প্রদর্শনে আগ্রহী হচ্ছে না। কারণ এখানে বাণিজ্যিক উপাদান নেই।
 
বিষয়টি নিয়ে নির্মাতা মুহাম্মদ কাইউমের আক্ষেপ এবং অসহায়ত্ব স্পষ্ট। বাংলা ট্রিবিউনের কাছে তিনি বললেন, ‘এখনও (৩১ অক্টোবর সন্ধ্যা) পর্যন্ত কোনও হল চূড়ান্ত হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি, পরিবেশক জাজ মাল্টিমিডিয়া চেষ্টা করছে। আসলে হল মালিকদের কাছে তো এটা ব্যবসা, যে ছবিতে বেশি মুনাফা হবে, সেটাই তারা চালাবে। তাদের ধারণা হলো, এখানে কোনও তারকা নেই, বাণিজ্যিক গানবাজনা নেই; ছবি হয়ত দর্শক দেখবে না। এজন্য তারা আগ্রহ দেখাচ্ছে না।’

‘সব সিনেমা তো একই ফর্মুলায় হবে না। কারোর ছবিতে বিনোদন বেশি থাকবে, তারকা বেশি থাকবে; আমরা জোর দিয়েছি দেশের একটা জনপদ, তাদের জীবন সংগ্রাম, লোকাচার ইত্যাদির দিকে। কীভাবে তারা দারিদ্র্য, প্রকৃতি এবং দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে, সেটাই আমরা তুলে ধরতে চেয়েছি। এখন হল মালিকরা যদি মনে করেন এসব ছবি বিক্রি হবে না, তাহলে তো জোর করে দিতে পারি না। তবে আমরা আরও কিছুদিন চেষ্টা করবো। এরপরও যদি দেখি কোনও হল নিচ্ছেই না, তখন নিজেদের উদ্যোগে শিল্পকলা একাডেমি, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বিভিন্ন জায়গার অডিটোরিয়ামে প্রজেক্টরের মাধ্যমে ছবিটি দেখানোর চেষ্টা করবো।’ যোগ করেন নির্মাতা কাইউম।

গল্পের ভিন্নতা নিয়েও ছবিগুলো সাম্প্রতিক সময়ে চলছে দারুণ এদিকে বিকল্প ঘরানার আরও একটি সিনেমা ‘দেশান্তর’ মুক্তি পাচ্ছে আগামী ১১ নভেম্বর। এটি নির্মাণ করেছেন আশুতোষ সুজন। নিজের নির্মিত প্রথম সিনেমার জন্য তিনি ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি অনুদান পেয়েছেন। এরপর কালক্ষেপণ না করে বানিয়েছেন দেশভাগ, দেশপ্রেম ও প্রেমের গল্পের ছবিটি। এই ছবিও পরিবেশনার দায়িত্বে থাকছে জাজ মাল্টিমিডিয়া। তবে এখনও হল বিষয়ে কোনও চূড়ান্ত খবর পাননি বলে জানালেন নির্মাতা সুজন। 

কথিত বাণিজ্যিক ফর্মুলায় যেসব ছবি নির্মিত হয় না, সেগুলোকে হলসংকটে পড়তে হয়। এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেন নির্মাতা আশুতোষ সুজন। তিনি বলেন, ‘পরিবেশনার জায়গায় একটা বড় চ্যালেঞ্জ আছে। ছবি শুধু বানিয়ে ফেললে হয় না। আমরা একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এখনও পর্যন্ত হল নিয়ে কোনও খবর পাইনি। তবুও আশা করছি, জাজ ভালো পরিবেশনা করবে। আমরা তো আসলে চাই ছবিটা হলে বেশি বেশি যাক, মানুষ দেখুক। এটাই একমাত্র চাওয়া।’

নিজের ছবির প্রেক্ষাপট জানিয়ে দর্শকের প্রতি সুজনের বার্তা, ‘এটা দেশভাগ, দেশপ্রেম এবং প্রেমের গল্প। সবাইকে বলবো, দলেবলে হলে যান, পরিবার নিয়ে যান। কারণ এটা পরিবার নিয়ে দেখার মতো একটা ছবি।’

বিকল্প গল্পভাবনা থেকে ‘সাঁতাও’ নামের একটি সিনেমা বানিয়েছেন খন্দকার সুমন। এর গল্প-নির্মাণশৈলিও ভিন্ন ধারার। তিনি জানালেন, তার ছবিটি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়ায় ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হবে। আগামী ২৩ থেকে ২৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে উৎসবটি। এরপর ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে হবে ন্যাশনাল প্রিমিয়ার। সবশেষে আগামী বছরের ২৭ জানুয়ারি ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেবেন। আগাম ধারণা করা যায়, হল পেতে এই ছবিটিকেও বেগ পেতে হবে। 

এই ঘরানার সিনেমার হল সংকট বিষয়ে তার মন্তব্য, ‘হল পাওয়া না পাওয়ার গল্পটা বাইরে থেকে আমরা জানি না, আমি নিজেও জানতাম না। সিনেমা হল চাইলে পাওয়া যায়, তবে সেটার জন্য কিছু অতিরিক্ত খরচ করতে হয়। প্রজেকশন ভাড়া দিতে হয় আলাদা করে। আনুমানিক বিশটা হলে (সিনেপ্লেক্স ছাড়া) যদি ছবি মুক্তি দিতে চান, তাহলে হলের পেছনে অতিরিক্ত পাঁচ লাখ টাকার মতো খরচ হয়ে যাবে। স্বাধীন নির্মাতাদের জন্য তো এই খরচ করাটা কঠিন। কারণ সে সর্বস্ব ঢেলে দিয়ে ছবিটা বানিয়েছে। তার ওপর অতিরিক্ত এই পাঁচ লাখ টাকা খরচ করার পর সেটা রিটার্ন পাওয়া যাবে কিংবা সেটার সঠিক হিসাব কেউ দেবে, এই নিশ্চয়তা তো নেই এখানে।’

ভিন্ন ধারার কিংবা অপেক্ষাকৃত ছোট পরিসরের ব্যানারে নির্মিত ছবিগুলো হল না পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী প্রেক্ষাগৃহ মধুমিতার কর্ণধার ও পরিবেশক নেতা ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের সঙ্গে। তার বক্তব্যেও পাওয়া গেলো ব্যবসা সংক্রান্ত বাক্য। অর্থাৎ হল মালিকরা স্বাভাবিকভাবে তাদের ব্যবসার দিকটাই বিবেচনা করবেন। 

হল প্রাপ্তির অপেক্ষায় ছবিগুলো নিজের হলের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বললেন, “আমাদের হলে প্রায় ১২শ সিট। এটা পূর্ণ হতে খুব কঠিন হয়ে যায়। এই যে এখন ‘দামাল’ চলছে, দর্শক সেরকম হচ্ছে না। অ্যাভারেজ দর্শক হচ্ছে। এর আগে পূজা চেরীর ‘হৃদিতা’ চালিয়েছি, চলেনি; ৫০-৬০ হাজার টাকাও আসেনি। ‘রোহিঙ্গা’ তিন দিন পর নামিয়ে দিয়েছি। আমাদের এখানে আসলে জনপ্রিয় ছবি চলে। এই ধরনের (বিকল্প ধারার) ছবি সিনেপ্লেক্সে চালানো যায়, তারা একটা-দুইটা শো করে চালাতে পারে। প্রদর্শক সমিতির নিয়ম অনুসারে আমরা কিন্তু একসঙ্গে একাধিক ছবি চালাতে পারবো না।”
 
সিনেমা চালানোর জন্য হল মালিককে অগ্রিম টাকা দিতে হয় কিনা, এ প্রসঙ্গে নওশাদের বক্তব্য, ‘না, কোনও টাকা দিতে হয় না। বরং আমরাই অগ্রিম টাকা দেই, ৫০ হাজার থেকে এক লাখ পর্যন্ত দিয়ে ছবি নিই; তবে সেটা ছবি বুঝে। এরপর সপ্তাহ শেষে শেয়ারের সঙ্গে কাটাছেঁড়া হয়। তবে এই ধরনের (ভিন্ন ধারার তারকাহীন) ছবি যদি চালাতে চান, তাহলে হলকে প্রজেকশন, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি বাবদ আগাম টাকা দিতে হবে। কারণ এসব ছবি তো ব্যবসায়িক দিক থেকে খুব ঝুঁকিপূর্ণ।’

ফেরা যাক ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে ওড়া’য়। এর বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়িতা মহলানবিশ, উজ্জ্বল কবির হিমু, সুমি ইসলাম, সামিয়া আকতার বৃষ্টি, বাদল শহীদ, মাহমুদ আলম ও আবুল কালাম আজাদ। ছবিটি নির্মাতা মুহাম্মদ কাইউম নিজেই প্রযোজনা করেছেন। সংকটের বেড়াজাল ভেদ করে তিনি নিজের ছবিটি বড় পর্দায় তুলে আনতে পারেন কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

দেশ, মাটি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও প্রকৃতির কথা বলে- এমন বিশেষ ঘরানার ছবিগুলোর প্রতি হল মালিকদের অবহেলা ও সরকার সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার বিষয়টিতে জোর দেন ‘খাঁচা’-খ্যাত নির্মাতা আকরাম খান। মাটির গল্পে গাঁথা ছবিগুলো প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার জোর দাবি জানিয়ে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের কিছু চলচ্চিত্রে দেশের ভূপ্রকৃতি ও মানুষের গল্প অকৃত্রিমভাবে মায়া-মমতায় উপস্থাপন হচ্ছে। এই ব্যাপারটা ভালো লাগছে। অভিনন্দন ‘কূড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’, ‘সাঁতাও’ ও ‘দেশান্তর’ সংশ্লিষ্টদের। দেশের মাটি থেকে চলচ্চিত্রগুলোর জন্ম, মাটির ঘ্রাণ লেগে আছে চলচ্চিত্রগুলোর শরীরে। শুনেছি কাইউম ভাই ‘কূড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ প্রদর্শনের জন্য কোনও প্রেক্ষাগৃহ পাচ্ছেন না। দায়বদ্ধতা আর স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রগুলো যদি প্রদর্শনের কোনও স্থান না পায়, তাহলে এতবছর আমাদের স্বাধীন, শৈল্পিক চলচ্চিত্রের আন্দোলনের কী অর্জন? আমরা এই ধারার চলচ্চিত্রগুলো
দেখতে চাই। সরকার ও হল মালিকদের কাছে জোরালো দাবি জানাচ্ছি, মৃত্তিকা সংলগ্ন এই চলচ্চিত্রগুলো প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হোক।’’

হল পেয়েও সুবিধা করতে পারেনি তারকাবহুল ছবিগুলো

তবে সাম্প্রতিক সময়ে উল্টো ঘটনাও ঘটেছে বেশ ক’টি। মুক্তির জন্য মাল্টিপ্লেক্স ও সিঙ্গেল স্ক্রিন পেয়েও দর্শক অনটনে প্রথম সপ্তাহের মাথায় নামিয়ে দিতে হয়েছে ভিন্ন গল্পের বেশ ক’টি ছবি। যেমন ‘বিউটি সার্কাস’, ‘হৃদিতা’, ‘রোহিঙ্গা’, ‘যাও পাখি বলো তারে’, ‘আশীর্বাদ’ প্রভৃতি। বিপরীতে ভিন্ন গল্পের অন্য চার ছবি ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’ এবং ‘দামাল’ চলছে সমানতালে! বিশ্লেষকরা বলছেন, সিনে ব্যবসার রুক্ষ বাস্তবতা এটাই- হল আছে আবার হল নেই! কারণ, পুরো বিষয়টি নির্ভর করে পরিচালক, প্রযোজক, পরিবেশক, শিল্পী আর গল্পের সমশক্তির ওপর। অথবা প্রয়োজন বাণিজ্যিক প্রেক্ষাগৃহের পাশাপাশি বিকল্প প্রদর্শনের ব্যবস্থা।

ঠিক এই দিকটায় আলোকপাত করেন বাংলাদেশে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মানজারে হাসীন মুরাদ। তার ভাষ্যে, ‘হল মালিকরা ব্যবসায়ী। তারা বিকল্প ঘরানার ছবি দেখাবে, সেই আশা করাটা ভুল। সে জন্যই বিকল্প চলচ্চিত্র প্রদর্শনের আন্দোলন করেছি আমরা। যার ইতিহাস খুব একটা বিফলে যায়নি। সমস্যা হলো সেই আন্দোলনের সূত্র ধরে নতুন সৃজনশীলতা নিয়ে সবাই ঐক্যবধ্য হয়ে কাজটি টেনে আনতে পারিনি। ফলে সিনেমা বানিয়েও সেটি প্রদর্শনের হাহাকার করতে হচ্ছে এখনও।’

/এমএম/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
সজলের মুগ্ধতা অপির চোখে, জন্মদিনে
সজলের মুগ্ধতা অপির চোখে, জন্মদিনে
সাংবাদিক হতে চেয়ে অভিনেত্রী!
সাংবাদিক হতে চেয়ে অভিনেত্রী!
মুবিতে মুক্তি দেশি মুভি
মুবিতে মুক্তি দেশি মুভি
মে দিবসে ফুঁসে উঠলেন সিনেমা শ্রমিকরা
মে দিবসে ফুঁসে উঠলেন সিনেমা শ্রমিকরা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা