X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২২ 

বাবা বলেছেন ওই টাকা দিয়ে বাড়িঘর বানানো সম্ভব না: ফারজিনা আক্তার

হিমাদ্রি শেখর ভদ্র, সুনামগঞ্জ 
১৫ নভেম্বর ২০২৩, ১৮:৩৯আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২৩, ১৯:৩১

হাওর পাড়ের মানুষের সংগ্রামী জীবন কাহিনি নিয়ে মুহাম্মদ কাইউম নির্মিত ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ ছবিতে সাবলীল অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছে শিশুশিল্পী ফারজিনা আক্তার। ফারজিনা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার ছিলানি গ্রামের আবু সায়েমের মেয়ে। ছবিতে হাওরবাসীর জীবন ও প্রকৃতি নিয়ে গল্পের কাহিনি এগিয়ে যায়, যা হুবহু মিলে যায় ভূমিহীন ফারজিনার পারিবারিক জীবনেও। একমুঠো ধান আর তিনবেলা খাবারের জন্য গোটা হাওরাঞ্চলের মানুষ যেমন প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে; বাস্তব জীবনে সেই যুদ্ধের অন্যতম অংশীদার জয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ফারজিনা ও তার পরিবার। 

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২২-এ শিশুশিল্পী শাখায় বিশেষ পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েই ফারজিনা স্বপ্ন দেখে নিজেদের একটা ভিটেবাড়ির। কারণ, অভাবের তাড়নায় অনেক আগেই একমাত্র সম্বল বসতভিটা বিক্রি করে দেন ফারজিনার বাবা। তাই তো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সঙ্গে টাকা পাওয়ার কথা শুনে চকচক করে ওঠে ছোট্ট ফারজিনার চোখ। স্বপ্ন দেখে সেই টাকায় নিজেদের একটি বাড়ি গড়ার। ফারজিনার বাবাও সন্তানের স্বপ্নের সঙ্গে সায় দেন, হয়তো তিনিও একই স্বপ্নে ডুবে যান। ১৪ নভেম্বর কন্যাকে হাতে নিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে ছুটে আসেন ঢাকায়, প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার ঘোর নিয়ে। আসলে তো পদক নয়, ফারজিনা ও তার বাবা স্যান্ডেল পায়ে ঢাকার পিচঢালা পথে পা ফেলেছিলেন নিজেদের একটা বাড়ি গড়ার স্বপ্ন বুকে চেপে।

ঠিকই ফারজিনার হাতে পদক উঠলো, গলায় সোনার মেডেল, সঙ্গে নগদ এক লাখ টাকার চেকও। তাতেও যেন ছোট্ট ফারজিনার মনের মেঘ কাটলো না। রাষ্ট্রীয় এই পদক পেয়ে যখন বিশ্বজয়ের সুখে ভাসছিলেন বিজয়ীরা, তখনও বিষণ্ণতার কালো মেঘ ছেয়ে আছে ছোট্ট ফারজিনার চোখে-মুখে-ভাষায়।   

পদক প্রাপ্তির পরদিন (১৫ নভেম্বর) ফারজিনা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‌‘আমরা এখন তাহিরপুর উপজেলার ছিলানি গ্রামে নানার বাড়িতে থাকি। সেখান থেকেই ঢাকায় এসেছিলাম। আশা করেছিলাম বড় অঙ্কের টাকা পুরস্কার পাবো। কিন্তু যা পেয়েছি, বাবা বলেছেন ওই টাকা দিয়ে বাড়িঘর বানানো সম্ভব হবে না। এখন আমি ঢাকায় বাবার সঙ্গে আছি। এখান থেকে আগামীকাল (১৬ নভেম্বর) আমরা গ্রামের বাড়ি যাবো। সেখানে গিয়ে থাকবো। আমি প্রথম শ্রেণিতে পড়ি। বাড়িঘর না থাকায় ঠিকমতো স্কুলে যেতে পারি না। তবু কষ্ট করে পড়াশোনা করে বড় মানুষ হতে চাই। আসলে গ্রামে আমাদের একটি বাড়ি খুব প্রয়োজন, কিন্তু সেটা তো নাকি সম্ভব নয়।’

পুরস্কার আসরের রিহার্সালে বাবা ও মেয়ে কেন সম্ভব নয়? বাবা কেন এত সহজেই ভেঙে দিলেন ছোট্ট ফারজিনার বাড়ি তৈরির স্বপ্ন। জবাবে বাবা আবু সায়েম বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। জায়গাজমি কিছুই নেই। অর্থের অভাবে নিজের বসতভিটা বিক্রি করে দিয়েছি। এখন শ্বশুরবাড়িতে কোনও মতে থাকি। কাইউম স্যারের (‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ সিনেমাটির পরিচালক মুহাম্মদ কাইউম) কাছ থেকে প্রথম শুনেছিলাম, মেয়ে বড় পুরস্কার পাচ্ছে। তখন মেয়ে আবদার করেছিল, পুরস্কারের টাকা দিয়ে বাড়ি করে দেওয়ার। আমিও বলেছি, পুরস্কারের টাকা পেলে জমি কিনে একটা বাড়ি করে দেবো। টাকা পেয়েছি এক লাখ। এরমধ্যে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়ায় এবং অন্যান্য খরচসহ ২০ হাজারের মতো গেছে। এখন হাতে আছে ৮০ হাজারের মতো। আসলে এই টাকা দিয়ে এলাকায় জমি কিনে বাড়ি বানানো সম্ভব নয়। জমি কিনে বাড়ি করতে অন্তত আট-দশ লাখ টাকা লাগে। এই টাকা দিয়ে কিছুই হবে না।’ 

পাঠকরা ফারজিনার বাবাকে ভুল বুঝবেন না। কারণ, তিনি যা বলছেন সেটাই আসল বাস্তবতা। সেই কঠিন বাস্তবতার মাঝেও নিজ সন্তানদের পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করার স্বপ্নটা বাঁচিয়ে রেখেছেন আবু সায়েম। ৮০ হাজার টাকা পকেটে রেখে তিনি বললেন, ‘আপাতত ঢাকা থেকে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে থাকবো। সেখানে কয়েক দিন থেকে পরে সিলেটে চলে যাবো। সেখানে গিয়ে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাবো। সঙ্গে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে যাবো। আমার দুই মেয়ে এক ছেলে। চেষ্টা করবো সিলেটে স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি করানোর। তবে রিকশা চালিয়ে তাদের পড়াশোনার খরচ চালানো আমাদের পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু ছেলেমেয়েদের পড়ানোর খুব ইচ্ছে আমার। জানি না পারবো কিনা। তবু হাতে যে টাকা আছে আর পায়ে যতদিন শক্তি আছে, চেষ্টা করবো।’

‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ ছবির একটি দৃশ্য তবু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী ফারজিনার বাবা আবু সায়েম দেশের বিত্তবানদের কাছে একটা আর্জি করেছেন, কেউ চাইলে তার মেয়েটার পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে পারেন। আবু সায়েম জানেন, মানুষের মতো মানুষ হতে হলে পড়াশোনাটা দরকার। পাশাপাশি সরকারের কাছেও আবু সায়েম আবদার রেখেছেন, ভূমিহীন হিসেবে তাদের যেন একটা বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়। তাহলে গ্রামের বাড়িতে থেকে সন্তানদের পড়াশোনা করাতে পারবেন।

এদিকে ফারজিনার স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ হাদিউজ্জামান তার শিক্ষার্থীর এমন অর্জনের খবর শুনে খুব খুশি। এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, আবু সায়েম কৃষিকাজ ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। ফারজিনার মা আফিয়া আক্তার গৃহিণী। পরিবারটির কোনও সহায় সম্পদ নেই। একই গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, বর্ষাকালে হাওরে মাছ ধরা ও শুষ্ক মৌসুমে অন্যান্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন আবু সায়েম। কাজ না থাকলে অন্যের জমিতে কামলা দিয়ে পেটের ভাত জোগাড় করেন। স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী ও শিক্ষক গোলাম সারোয়ার লিটন জানান, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এই গ্রাম আধুনিকতা থেকে অনেক দূরে রয়েছে। হয়তো প্রকৃতি ইচ্ছে করে গ্রামটি অক্ষয় করে রেখেছে। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। কৃষিকাজ আর মাছ ধরা ছাড়া বিকল্প কোনও পেশা নেই। গ্রামের নারী পুরুষ শিশু কিশোর অসচেতনতা, অজ্ঞতার কারণে জীর্ণকায়। তাদের গায়ে ওঠে না উন্নত কাপড়চোপড়। টিনশেডের বসতঘরে তারা টেনেটুনে বেঁচে আছে। দুর্গম ছিলাইন গ্রাম শীত বর্ষা গ্রীষ্ম, সবসময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এক লোকালয়।

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল জানান, ‘‘কোনও রকমের প্রাতিষ্ঠানিক অভিনয় শিক্ষা ও ন্যূনতম প্রশিক্ষণ ছাড়াই আমাদের ফারজিনা শিশুশিল্পী হিসেবে ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয় করে পুরস্কৃত হয়েছে। এটা আমাদের গ্রামের জন্য গর্ব। আমরা চাই মেয়েটির পড়াশোনা চলুক।’’

বলা দরকার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২২-এ ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ জিতেছে তিনটি বিভাগে। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য এবং বিশেষ শিশুশিল্পীর পুরস্কার। তিন বিভাগে বিজয়ীদের হাতে ট্রফি

/এমএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
৪ বছর বয়সে শুরু, জিতেছেন ১৬টি গ্র্যামি
শুভ জন্মদিন৪ বছর বয়সে শুরু, জিতেছেন ১৬টি গ্র্যামি
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
ঢাকার জ্যাম আর গরম নিয়ে প্রেমের গান!
ঢাকার জ্যাম আর গরম নিয়ে প্রেমের গান!
তামান্নার শুভ সূচনা
তামান্নার শুভ সূচনা
ওটিটিতে মঞ্চনাটক ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’
ওটিটিতে মঞ্চনাটক ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’