গত ২৯ এপ্রিল বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উদযাপন করেছে দেশের স্বনামধন্য নৃত্য সংগঠন ‘নৃত্যাঞ্চল’। অনুষ্ঠানটি তিনটি পর্বে সাজানো হয়েছিল। প্রথম পর্বে ছিলো নৃত্যাঞ্চল আয়োজিত আন্তঃক্লাস প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ। এতে প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী পুরস্কার লাভ করেন।
দ্বিতীয় পর্বে ছিলো নৃত্যাঞ্চলের প্রাণপুরুষ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর স্মরণে ‘নৃত্যাঞ্চল পদক ২০২৪’ প্রদান। নৃত্যাঞ্চল প্রতি দু’বছর অন্তর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নীরবে নিভৃতে দেশীয় সংস্কৃতি নিয়ে যারা কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের প্রতি সম্মান জানাতে পদক প্রদান করে আসছে।
এবার পদক প্রদান করেন নৃত্যাঞ্চলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক শামীম আরা নীপা ও শিবলী মোহাম্মদ। এ বছর এই পদকে ভূষিত হয়েছেন ধামাইল নাচের সাধক শ্রীমতি কুমকুম রানী চন্দ। পদক প্রাপ্তির সময় গুণী এই শিল্পী দর্শকদের উদ্দেশ্যে জনপ্রিয় একটি ধামাইল গান পরিবেশন করেন। এতো বয়সে এসেও তার এমন সুললিত কণ্ঠ মিলনায়তনের দর্শকদের একইসঙ্গে গভীর মুগ্ধতা ও হতবাক করে।
আয়োজনের তৃতীয় পর্বে ছিলো আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে বিশেষ নৃত্যানুষ্ঠান। নৃত্যানুষ্ঠানে প্রায় দুই শতাধিক নৃত্যশিল্পী অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন দেশের গানের সাথে নৃত্যাঞ্চলের শিল্পীদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা দর্শকদের মাঝে ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলে। সবশেষে ঢাকের তালে নাচে গানে দর্শক এবং শিল্পীরা মিলিতভাবে উদযাপন করে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস।
নৃত্যাঞ্চলের দুই পরিচালক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত দুই নৃত্যজন শামীম আরা নীপা ও শিবলী মহম্মদ বলেন, ‘নৃত্যাঞ্চলের প্রাণপুরুষ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর তার দেশের প্রতি, মাটির প্রতি যে দায়বদ্ধতা, তা তিনি তুলে ধরেছেন তার লেখনীর মাধ্যমে। তিনি সত্য ও সততায় বিশ্বাস করতেন। ভালোবাসতেন স্বকীয়তা, ধারণ করতেন মৌলিকত্ব। তিনি সব সময় চেয়েছেন নৃত্যাঞ্চল দেশীয় নিজস্ব মৌলিক নৃত্য ধারা গুলোকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে। মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে নৃত্যাঞ্চল এ বছর বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির ধামাইল গান ও নৃত্যের বিশিষ্ট গুণীজন ব্যক্তি হিসাবে শ্রী কুমকুম রাণী চন্দকে নৃত্যাঞ্চল পদক ২০২৪ প্রদান করেছে। আমরা নৃত্যাঞ্চলের পক্ষ থেকে গুণী এই শিল্পীর সর্বাঙ্গীণ সফলতা কামনা করছি। নৃত্যাঞ্চল শ্রীমতি কুমকুম রানী চন্দ-এর মত গুণী শিল্পীকে পদক দিতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করছি।’
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালে বাংলার ঐতিহ্যবাহী জারি নৃত্যের বিশিষ্ট গুণীজন যিনি প্রায় দীর্ঘ ৫০ বছর সাধনার মধ্য দিয়ে জারি নৃত্যের ধারাটিকে চলমান এবং সমৃদ্ধ করেছেন, নেত্রকোনার পাহাড়পুর উন্নয়ন জারি দলের দলনেতা আবদুল হেলিম বয়াতিকে নৃত্যাঞ্চল পদক প্রদান করা হয়।
বলা দরকার, কুমকুম রানী চন্দ বৈষ্ণব কবি রাধারমণের গানে নিমগ্ন এই ধামাইল শিল্পী ১৯৫২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জ জেলার বেরিগাঁও গ্রামের জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকে মায়ের সাথে বিয়ের অধিবাসে যেতেন, অধিবাসের গান শুনে বাড়ি এসে গুনগুনয়ে গাইতেন। এভাবে তার মাঝে ক্রমেই ধামাইলের প্রতি সৃষ্টি হয় গভীর প্রীতি, তৈরি হয় এক দুর্নিবার আগ্রহ। কালের পরিক্রমাই নিজেই নিজেকে একজন ধামাইল শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার স্বামী ছিলেন একজন উঁচু মানের কীর্তন শিল্পী। বলা যায় স্বামীর পারিবারিক সংগীতচর্চার পরিবেশই তাকে ধামাইল শিল্প বিকাশের পথকে আরও সুগম করে দেয়। ধামাইল একটি বিস্তীর্ণ সংগীত ভাণ্ডার। যেখানে অনেকগুলো সংগীতের প্রকাশ রয়েছে। যা আনুষ্ঠানিক দিক বিবেচনা করে উপস্থাপন করা হয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বন্দনা, আসর, বাঁশি, জলভরা, জলধামাইল, গৌররূপ, শ্যামরূপ, বিচ্ছেদ, কুঞ্জসজ্জা, কুঞ্জবিচ্ছেদ, খেদবিচ্ছেদ, মান, মানভঞ্জন, সাক্ষাৎ (দুঃখ প্রকাশ), মিলন ও বিদায়। এছাড়াও আছে ঢোল আসার গান, জামাই ও কনের মা সাজানো গান, কুলা সাজানো গান, আলপনা আঁকার গান, সম্বন্ধ মিথি, অধিবাসের টিকা দেয়ার গান, চুরপানি গান, জলে প্রদীপ ভাসানোর গান। সব গানের পদগুলো রাধারমণ-এর ধামাইল পদ। এছাড়াও ধামাইলে রয়েছে কারিকা ধামাইল, বাঁশি কারিকা, বিচ্ছেদ কারিকা ও জলভরা কারিকা।
এসব পদগুলো সম্পর্কে কুমকুম রানীর রয়েছে বিষদ সাধনা। তার কাছে প্রায় ৭০০ রাধারমণের ধামাইল শিল্পের সংগ্রহ রয়েছে। গুণী এই শিল্পীর কাছ থেকে এদেশের অনেক শিল্পীই লোক-শিল্প ধামাইল সংগ্রহ করতে আসেন।