X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
সিনেমা সমালোচনা

হুল্লোড়: চরিত্রের শরীর আছে, ‘চরিত্র’ নেই!

মাহফুজুর রহমান
৩০ জানুয়ারি ২০২০, ১০:০৯আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২০, ১৮:০১

হুল্লোড়: চরিত্রের শরীর আছে, ‘চরিত্র’ নেই! সুপ্রিয় দত্তর বাবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন পাঁচ লাখ টাকা। সেই ঋণ সুদে-আসলে একসময় দাঁড়িয়ে যায় পঞ্চাশ লাখ টাকা! ঋণ পরিশোধে সুপ্রিয়র ব্যর্থতায় ব্যাংক তার বন্ধকী বাড়ি গ্রাস করতে মুখ বাড়ায়। ব্যাংকের ইন্ধনে জমিতে শপিংমল করতে এগিয়ে আসে বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। সুপ্রিয়র পরিবারকে বাড়ি থেকে তুলে দিতে মাঠে নামে বিশ্বজিতের মেয়ে শ্রাবন্তী ও তার বর সোহম। দোকান-বাড়ি বাঁচাতে সুপ্রিয়র মেয়ে দর্শনা ধরে বসে তার প্রেমিক ও বাসার ভাড়াটিয়া ওমকে। তার গ্রামের পৈতৃক জমি বেচে হবু শ্বশুরের ঋণশোধের জন্য দর্শনার মিনতি ওমের মাথায় আনে কুবুদ্ধি। অস্তিত্বহীন পৈতৃক সম্পত্তির বড়াইয়ে বলীয়ান ওম তার দুই অকর্মা বন্ধুর সহযোগিতায় শ্রাবন্তীকে অপহরণের পরিকল্পনা করে। তাদের সঙ্গে হাত মেলায় শ্বশুরের লাথি-ঝাঁটা খাওয়া অসন্তুষ্ট জামাই সোহম। অপহরণের সঙ্গে একে একে জড়িয়ে পড়ে ভুয়া জ্যোতিষী শুভাশিষ, পুলিশ অফিসার বিশ্বনাথ ও কাঞ্চন। অপহরণ করতে গিয়ে আনাড়ি অপরাধীরা কীভাবে জট পাকায়, আর সেই জট কীভাবে খোলে, তারই চিত্রায়ণ ‘হুল্লোড়’।

কোনও রকম জট না-পাকিয়ে ‘হুল্লোড়’র সারসংক্ষেপ পেশ করা হলো। যতটা গুছিয়ে বলা সম্ভব, বলা হলো। কিন্তু থিয়েটারে আপনার মাথা নিশ্চিত জট পাকিয়ে যাবে। কিছুতেই গল্পের মাথা-মুণ্ডু ধরতে পারবেন না। এর কৃতিত্ব তিন জন কাহিনিকারের। যার মধ্যে ছবির প্রযোজকও রয়েছেন! ত্রিরত্ন মিলে গল্পের এমন ঘোট পাকিয়েছেন, দর্শকদের রীতিমতো ঘোল খাইয়ে ছেড়েছেন। শুরু থেকেই গল্পের গরু এমনভাবে গাছে চড়তে শুরু করে, এর মাটিতে নেমে আসার আশা দর্শকরা ছেড়েই দেন। এ যেন কোনোভাবে আসমানে না চড়ে যায়, তার আশায় ‘হরি’ নাম জপতে থাকেন। দর্শকদের বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে গল্পের গরু একসময় মহাশূন্যে উড়ে বেড়াতে থাকে। গল্পের বাঁকে বাঁকে উদয় হয় প্রশ্নের পর প্রশ্ন, সেসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার দায় মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে, গল্পকারত্রয়ী গল্পের গরু নিয়ে ছুটতে থাকেন ভুবন থেকে ভুবনান্তরে। দর্শকরা গল্পের গরুর পেছনে সব মেধা দিয়ে ধাওয়া করেও কোনও কূলকিনারা করতে পারেন না।
এমনই উদ্ভট, যুক্তিহীন, অসংলগ্ন গল্পের ছবি ‘হুল্লোড়’।
পরিচালক অভিমন্যু মুখার্জি সম্ভবত ভেবেছেন, গল্পের একটা কাঠামো খেয়ে না খেয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেই হলো, তারপর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পরিস্থিতি বুঝে হোক না হোক একরকম অভিনয় করে চালিয়ে নিতে পারলেই দর্শকরা থিয়েটারে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবেন। এই চিন্তা মোটা মাথায় নিয়ে প্রত্যেকটা চরিত্রকে ভাঁড় সাজিয়ে ক্যামেরার সামনে ছেড়ে দিয়েছেন পরিচালক। ছবির চরিত্ররা কী করছেন, কেন করছেন, তার কোনোরকম ব্যাখ্যার ভেতরে না গিয়ে, দর্শকদের ওপরে পেটপুরে হাসার মহান দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে দায়সারা পরিচালক। হাসবেন কীভাবে, কতক্ষণে গল্পের গরু মাঠে নেমে আসবে, আর বেহুদা হুল্লোড় থামবে, সেই ভাবনাতেই প্রেক্ষাগৃহের সিটে সিটিয়ে গিয়েছেন দর্শকরা।
সিচুয়েশনাল কমেডিতে গল্পটা চাপা পড়ে যায়, চরিত্ররা পর্দায় দাপিয়ে বেড়ায়, এমনটাই আমাদের দেখা। ‘হুল্লোড়’-এ গল্পকে অস্তাচলে পাঠিয়ে দেয়া হয় সূচনাতেই। পর্দাজুড়ে চরিত্ররা পড়ে থাকে যে যার মতো। এবার তারা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। প্রত্যেকটা চরিত্রই অন্তঃসারশূন্য। চরিত্রের শরীর আছে, কাঠামো আছে, ‘চরিত্র’ নেই। মনে হয়, এরা মানবিক বৈশিষ্ট্যবর্জিত মনুষ্য-সদৃশ জীব, মহাশূন্য থেকে সরাসরি ‘হুল্লোড়ে’র গল্পে ভূপাতিত হয়েছে।
সোহম কাজকর্মে অপটু; মেনে নেয়া গেলো। সে বোকা, স্ত্রৈণ; তাও মেনে নেয়া গেলো। কিন্তু সে হুট করে অপহরণকারী হয়ে যাবে, পণের টাকা এক কোটি থেকে দুই কোটিতে বাড়িয়ে লোভী থেকে লোভীতর হয়ে উঠবে; এ কেমন অমানুষিক চরিত্র? ওম প্রেমিকাকে পেতে অপহরণকারীর খাতায় নাম লেখালো, পণ আদায়ে যা করবার করলো, তারপর শ্রাবন্তীর দাদা ডাকে দুর্বল হলো, এ পর্যন্ত না হয় মেনে নেয়া গেলো, কিন্তু বিনা কারণে বজ্রপাতের মতো শ্রাবন্তীর কাছে হড়বড় করে সব সত্য ফাঁস করে দেবে; এ কেমন অমানুষিক চরিত্র? বিশ্বনাথ স্ত্রীর শাসনে তটস্থ, কম্পিত স্বামী, পরস্ত্রীকে দেখলেই যার জিভ লকলক করে ওঠে, সে আবার বাজারের মেয়েছেলের সঙ্গে মিশতে গিয়ে পড়িমরি করে পালায়। এভাবে করে একটা চরিত্রও কি দাঁড়ালো?

সোহম-শ্রাবন্তী এবং ওম-দর্শনা ‘হুল্লোড়’র চরিত্ররা চরিত্রের ভেতরে থাকতে পারে না। গল্পকারদের কলমের স্বেচ্ছাচারিতায় প্রত্যেকটা চরিত্র নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য ছেড়ে ‘চরিত্রবিহীন’ হয়ে ওঠে শেষ পর্যন্ত। ফলে চরিত্রগুলোর ওপরে দাঁড়ানো গল্পের কাঠামো প্রায় শুরু থেকেই ভেঙে পড়তে থাকে। গল্পের শেষে এসে গল্প বলে আর কিছু থাকে না, চরিত্ররা সব প্রায় শূন্যে মিলিয়ে যায়। দর্শকদের মাথা থেকে বিশাল ভার নেমে যায়। তারা ফাঁকা মাথায় থিয়েটার ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।
এবার চরিত্রশিল্পীদের কথা। জগতের শ্রেষ্ঠ নট-নটীরাও ‘হুল্লোড়’র চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে মাথা খুঁটে মরবেন। আর এখানে তো তারকার আগুনে তাওয়া গরম। বাসিপচা কমেডি করতে করতে সোহম এমন সয়ে গেছেন, ‘হুল্লোড়ে’র কদর্য গল্পেও তিনি নিজেকে পুরোপুরি মানিয়ে নিয়েছেন। মনে হয়, এমন জঘন্য চরিত্রে আত্মাহুতি দিতেই তার জন্ম। শ্রাবন্তীর বোধহয় কোনোমতে একটা ছবিতে মুখ দেখানোই ছিল জরুরি, তিনি সেটুকু কাজের বেশি করতে আগ্রহী ছিলেন না ‘হুল্লোড়’-এ। দুর্ভিক্ষে-পতিত শিল্পীও অমন চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হবেন না, যেমন চরিত্রটিকে দক্ষতার সঙ্গে মাটিতে গুড়িয়ে দিয়েছেন ওম। এবং দর্শনা, তাকে না লেগেছে দর্শনীয়, না তিনি অভিনয়ে হয়েছেন রমণীয়। বাকি শিল্পীরা প্রত্যেকেই নামি। প্রত্যেকেই নিজেদের নাম ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন।
আর ছবির কারিগরি দিক, সম্পাদনা, চিত্রগ্রহণ, শব্দ, আলো, এসব ব্যাপারে ভাবনার কোনও সুযোগই পরিচালক দর্শকদের দেননি। তার চিত্রনাট্যে এত ফাঁক, এত ত্রুটি, এত ভ্রান্তি, থিয়েটারে মাথা একেবারেই কাজ করে না। শুধু মিউজিকের কথা একটু বলি। ছবিতে বিনা মেঘে প্রবল বেগে দুটো গান আসে। হয়তো প্রযোজকের পকেটে টান পড়েছিল। তাই দুই জুটি একই গানে, একই লোকেশনে আলাদা আলাদাভাবে কোমর দোলায়, হাত-পা ছোড়ে, একে অন্যের সঙ্গে বাড়ি খায়। ধোপাপট্টির যে লোকেশনে গানের দৃশ্যে, কল্পনায় তারা লুকোচুরি খেলে, সেই একই লোকেশনে তারা এসে পড়ে ছবির ক্লাইম্যাক্সে। এবার গানের দৃশ্যে স্লো-মোশনে দৌড়ের বদলে ভিলেনদের সঙ্গে ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়া।
‘হুল্লোড়’ আসলে যেকোনও দর্শকের জন্য এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা। আপনি যতই কমেডি ছবির নামে ভাঁড়ামো গিলে গিলে পোক্ত হয়ে যান না কেন, আপনার স্নায়ুর চরম পরীক্ষা নিয়ে নেবে ‘হুল্লোড়’। আপনি যতই কমেডি ছবিতে ইঙ্গিতপূর্ণ সংলাপ শুনে শুনে অভ্যস্ত হোন না কেন, এ ছবির রুচিহীন, বাজারি, সস্তা সংলাপে আপনার কান স্পর্শকাতর হয়ে উঠবেই। আপনি যতই কমেডি ছবিতে পয়সা উসুলের ভাবনায় ছবিঘরে ঢুঁ মারুন না কেন, এ ছবি আপনাকে আপনার কষ্টার্জিত পয়সার সহি ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক করবেই।
টলিউড থেকে ঢালিউডে আমদানি করা ‘হুল্লোড়’- আপনার ছবি দেখার সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ছুড়ে দেবে, দেবেই।

হুল্লোড়: রিভিউ রেটিং- ৪/১০
পরিচালক: অভিমন্যু মুখার্জি
প্রযোজক: এসকে মুভিজ
আমদানিকারক: সেলিম খান
কাহিনিকার: অভিমন্যু মুখার্জি, কমলেশ কুন্তি সিং ও হিমাংশু ধানুকা
সংলাপ: অভিমন্যু মুখার্জি
শ্রেষ্ঠাংশে:
সোহম চক্রবর্তী, শ্রাবন্তী চ্যাটার্জি, ওম সাহনি, দর্শনা বণিক, শুভাশীষ মুখার্জি, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, সুপ্রিয় দত্ত, বিশ্বনাথ বসু, কাঞ্চন মল্লিক প্রমুখ
সংগীত পরিচালক: দোলন মৈনাক
চিত্রগ্রাহক: সৌভিক বসু
সম্পাদক: রবিরঞ্জন মৈত্র
পরিবেশক (বাংলাদেশ): শাপলা মুভিজ
মুক্তি (বাংলাদেশ): ২৪ জানুয়ারি ২০২০
ভাষা: বাংলা

লেখক: সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক

/এমএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং
পুষ্পা: আসবে তৃতীয় কিস্তি!
পুষ্পা: আসবে তৃতীয় কিস্তি!