X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্যাবাসন চুক্তি মিয়ানমারের প্রচারণা কৌশল, নিধনযজ্ঞ ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা

মাহাদী হাসান
২০ এপ্রিল ২০১৮, ১৭:৩০আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০১৮, ১৭:৩৯
image

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জানুয়ারিতে সম্পন্ন হওয়া মিয়ানমার-বাংলাদেশ চুক্তির আওতায় এখনও একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঢাকা-নেপিদো চুক্তি সম্পন্ন হলেও নানা অজুহাতে রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে প্রত্যাবাসনের গতি। চুক্তির আগেই বিশেষজ্ঞরা সংশয় প্রকাশ করেছিলেন এর ফলাফল নিয়ে। আন্তর্জাতিক চাপ থেকে বাঁচতেই মিয়ানমার প্রত্যাবাসনে রাজি হয়েছে বলে মত দিয়েছিলেন তারা। চুক্তির পরও রাখাইনে গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বুলডোজারে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের নজির। খবর মিলেছে সেখানে আদর্শ বৌদ্ধ গ্রাম নির্মাণ চলমান থাকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রত্যাবাসন চুক্তি ছিল একটি প্রচারণা কৌশল, যার মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ আড়ালের চেষ্টা করেছে মিয়ানমার।
পালিয়ে আাসা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ

গতবছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। জাতিগত নিধন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমার শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের বাঙালি মুসলিম আখ্যা দিয়ে নাগরিকত্ব অস্বীকার করে আসছে। তবে এবারের ঘটনায় আন্তর্জাতিক চাপ জোরালো হওয়ার এক পর্যায়ে প্রত্যাবাসন চুক্তিতে বাধ্য হয় মিয়ানমার। তবে সেই  চুক্তির পর বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও ধোঁয়াশা কাটছে না। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ৮ হাজার রোহিঙ্গার নাম প্রস্তাব করা হলেও মাত্র ৬০০ জনকে ফেরত নিতে চেয়েছে মিয়ানমার। তাদের পক্ষ থেকে প্রথম রোহিঙ্গা পরিবার ফেরত নেওয়ার দাবি করা হলেও ওই দাবি সাজানো বলে অভিযোগ উঠেছে।

বাংলাদেশের শরণার্থী কমিশনার আবুল কালাম রোহিঙ্গা পরিবার ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি সম্পর্কে বলেন, এটি সাজানো। যেই পরিবারের দাবি করা হচ্ছে সেই পরিবার বাংলাদেশে আসেনি। আবুল কালামের এই বক্তব্যে সমর্থন রয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলোরও। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশ-ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতিতে বলেছে, এ ঘটনা সম্পর্কে সংস্থার কাছে প্রত্যক্ষ কোনও তথ্য নেই। আর বিষয়টি নিয়ে সংস্থার সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি বা এটা এর সঙ্গে জড়িত নয়।

পুড়িয়ে দেওয়া রোহিঙ্গা ঘর

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইনে থাকলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। উগ্র বৌদ্ধবাদকে ব্যবহার করে সেখানকার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্থাপন করেছে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের চিহ্ন। ছড়িয়েছে বিদ্বেষ। ৮২-তে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। এরপর কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোনও নিবন্ধনপত্র, কখনও নীলচে সবুজ রঙের রশিদ, কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনও আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি নামের রং-বেরঙের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে। ধাপে ধাপে মলিন হয়েছে তাদের পরিচয়। ক্রমশ তাদের রূপান্তরিত করা হয়েছে রাষ্ট্রহীন বেনাগরিকে।

বাবা-মা হারানো রোহিঙ্গা শিশু

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অপরিহার্য শর্ত হিসেবে চাওয়া হয়েছে বৈধ কাগজপত্র। অথচ বেশিরভাগ রোহিঙ্গা পুড়ে যাওয়া সম্বল ফেলে পালিয়ে এসেছে।  হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রত্যাবাসন চুক্তিকে মিয়ানমারের ধোঁকাবাজি আখ্যা দিয়েছে। এএফপির সাবেক সাংবাদিক লিউক হান্ট কূটনীতি বিষয়ক সাময়িকী ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলেন, ৮ হাজার পরিবারের নাম মিয়ানমারের কাছে দেওয়া হয়েছ। তবে সেখান থেকে মাত্র ৬০০ জনকে ফেরত নিতে চেয়েছে মিয়ানমার।

২০১৭ সালের নভেম্বরে এশিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক এবং বাংলাদেশের একটি ইংরেজি দৈনিকের সূত্রে মালয়েশিয়াভিত্তিক স্টার অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার আগেই এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সিআর আবরার সে সময় বলেন, ‘এই চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ হয়তো মিয়ানমারের ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে।’ এই প্রত্যাবাসনের সমঝোতা করে মিয়ানমার আসলে চাইছে আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করতে। 

রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার স্যাটেলাইট ছবি

জাতিসংঘ এক প্রস্তাবের মাধ্যমে মিয়ানমারকে আহ্বান জানায় তারা যেন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়ে নিরাপদে ফিরিয়ে নেয়। সিআর আবরার বলেন, এই সমঝোতা অনুযায়ী মিয়ানমারই সিদ্ধান্ত নেবে যে কাদের তারা ফিরিয়ে নেবে কারণ এর সঙ্গে জাতিসংঘের কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই। আবরার সংশয় প্রকাশ করেন, গুতিকয়  রোহিঙ্গাকেই ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার।

স্টার অনলাইনের প্রতিবেদনে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৭৮ সালে হত্যাযজ্ঞের পর পালিয়ে এসেছিলো প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা। এক চুক্তির মাধ্যমে সবাইকে ফেরত পাঠানো হলেও ১৯৯১-৯২ সালে আবারও পালিয়ে বাংলাদেশে আসে ২ লাখ ৫০ জন।  ১৯৯২ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত মোট ২ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়। তবে ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের অব্যাহত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরতে পারেনি। এরই মধ্যে ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল আরও তিন লাখসহ গত বছরের আগস্ট থেকে পালিয়ে আসাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অন্তত ৯ লাখে। অধ্যাপক আবরার বলন, মিয়ানমার সত্যিই তাদের ফেরত নিতে চাইলে আরও বিস্তারিত প্রক্রিয়ায় যাওয়া উচিত ছিল। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরও চুক্তির আগেই বলেছিলেন, সমঝোতায় যখন বিস্তারিত কিছু থাকে না তখন আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। তিনি সে সময় বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাখাইনে অনুকূল পরিস্থিতি। কিন্তু সেটা নিশ্চিতে কার্যত কোনও পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।’ 

শরণার্থী শিবিরের বিপন্ন রোহিঙ্গারা

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনা অভিযান বন্ধের ঘোষণা দিয়ে আগস্টে আবারও ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের (শুদ্ধি অভিযান) ঘোষণা দেয় মিয়ানমার। রিগনভিত্তিক মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ইউরো এশিয়া রিভিউ চলতি বছর মার্চের শুরুতে জানায়,   ২০১৭ সালে শেষ থেকে মিয়ানমার সরকার ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কমপক্ষে ৪৫৫টি গ্রামের সব অবকাঠামো ও ফসলের ক্ষেত ধ্বংস করে দিয়েছে।  ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং মার্কিন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস-এর দাবি বলা হচ্ছিল, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক বাহিনীর নিধনযজ্ঞ আড়াল করতেই গ্রামগুলোতে বুলডোজার চালানো হচ্ছে। মার্চের শুরুতে নতুন করে অ্যামনেস্টির দেওয়া বিবৃতি থেকে অন্তত  ৩টি সামরিক ঘাঁটি ও রাস্তাঘাট নির্মাণ চলমান থাকার কথা জানা যায়। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারশন ফর হিউম্যান রাইটস এর অ্যান্দ্রে জর্জেটা এএফপিকে বলেন, প্রত্যাবাসনের ঘোষণাটি ছিল ‘একটি গণসংযোগের চাল। এর মাধ্যমে রাখাইনের হত্যাযজ্ঞ আড়াল করতে চেয়েছিল তারা। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর আগে মিয়ানমার সরকারকে সকলের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।’

অ্যাকটিভিস্টরা মনে করেন ‘স্বশাসিত রোহিঙ্গা অঞ্চল প্রতিষ্ঠা’ই সংকট নিরসনের পথ

সবশেষ মার্চে এএফপির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে রাখাইন বৌদ্ধদের জন্য ‘আদর্শ বৌদ্ধ গ্রাম’ নির্মাণের কথা। প্রতিবেদনে বলা হয়, বৌদ্ধদের অর্থায়নে এবং সেনা মদদে বেসরকারি প্রকল্প পরিচালনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাশূন্য রাখাইন গড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারশন ফর হিউম্যান রাইটস এর অ্যান্দ্রে জর্জেটা এএফপিকে বলেছেন, প্রত্যাবাসনের ঘোষণাটি ছিল ‘একটি গণসংযোগের চাল। এর মাধ্যমে রাখাইনের হত্যাযজ্ঞ আড়াল করতে চেয়েছিল তারা। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর আগে মিয়ানমার সরকারকে সকলের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।’ এজন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দলকে নজরদারির সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

/বিএ/
সম্পর্কিত
রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা চালাতে ওআইসির সহযোগিতা চাইলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
১২ ঘণ্টার মাথায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরেক যুবককে হত্যা
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুবককে হত্যা
সর্বশেষ খবর
প্রথম ধাপের প্রার্থীদের ৫৬ শতাংশই ব্যবসায়ী: টিআইবি
উপজেলা নির্বাচনপ্রথম ধাপের প্রার্থীদের ৫৬ শতাংশই ব্যবসায়ী: টিআইবি
বিজেপি ও তৃণমূলের মাথাব্যথা এখন কম ভোটার উপস্থিতি
লোকসভা নির্বাচনবিজেপি ও তৃণমূলের মাথাব্যথা এখন কম ভোটার উপস্থিতি
দিনে টার্গেট, রাতে ট্রান্সফরমার চুরি করতে লাগে ২০-২৫ মিনিট
দিনে টার্গেট, রাতে ট্রান্সফরমার চুরি করতে লাগে ২০-২৫ মিনিট
আওয়ামী লীগ এখন শূন্য মুড়ির টিন: রিজভী
আওয়ামী লীগ এখন শূন্য মুড়ির টিন: রিজভী
সর্বাধিক পঠিত
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র