রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে যুদ্ধরত ইউক্রেনীয় সেনারা ফ্রন্টলাইন থেকে পিছু হটার সময়ের ঘটনাকে ‘হরর মুভির মতো’ বলে বর্ণনা করেছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া বিস্তারিত বর্ণনায় সেনারা বলেছেন, ভারী গোলাবর্ষণ এবং রুশ ড্রোনের অবিরাম হামলার মুখে তাদের পশ্চাদপসর ‘বিপর্যয়কর’ ছিল। এ সময় সামরিক সরঞ্জামের বহর ধ্বংস হয়ে যায় এবং রাশিয়ান ড্রোনের ঝাঁক তাদের ওপর আক্রমণ চালায়।
ইউক্রেনীয় সেনারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। তাদের পরিচয় গোপন রাখতে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা সবচেয়ে বড় শহর সুজদা হারানোর পর তাদের মধ্যে ‘ধস’ নেমে আসে।
ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার কারণে পরিস্থিতির সম্পূর্ণ চিত্র পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে পাঁচ ইউক্রেনীয় সেনা বিবিসিকে যা বলেছেন, তা থেকেই যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
‘২৪ ঘণ্টা ড্রোনের আক্রমণ’
৯ মার্চ, ‘ভলোদিমির’ বিবিসিকে টেলিগ্রামে একটি বার্তা পাঠান। তিনি তখনও সুজদায় ছিলেন। তার বর্ণনায়, সেখানে ‘আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং সামনের লাইন ভেঙে পড়েছে’। ইউক্রেনীয় সেনারা ‘প্রস্থানের চেষ্টা করছে—সেনা ও সরঞ্জামের বহর। তাদের কিছু রাশিয়ান ড্রোনের আক্রমণে পুড়ে গেছে। দিনের বেলা প্রস্থান করা অসম্ভব।’
সুজদা এবং ইউক্রেনের সুমি অঞ্চলের মধ্যে একটি প্রধান রাস্তা দিয়ে সেনা, সরঞ্জাম এবং রসদপত্র চলাচল করত। ভলোদিমির বলেছেন, এক মাস আগে পর্যন্ত এই রাস্তা দিয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদে চলাচল করা সম্ভব ছিল। কিন্তু ৯ মার্চ নাগাদ এটি ‘শত্রুর গোলাবর্ষণের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে—২৪ ঘণ্টা ড্রোনের আক্রমণ। এক মিনিটে দুই থেকে তিনটি ড্রোন দেখা যায়। এটা অনেক বেশি।’
তিনিবলেন, ‘আমাদের সব রসদপত্র সুজদা-সুমি মহাসড়ক দিয়ে আসে। সবাই জানত যে রাশিয়ানরা এটা বিচ্ছিন্ন করতে চাইবে। কিন্তু আমাদের কমান্ড আবারও বিস্মিত হয়েছে।’
‘সংগঠিত পশ্চাদপসরণের নির্দেশ’
১১ মার্চ, ‘মাকসিম’ টেলিগ্রাম বার্তায় জানান, ইউক্রেনীয় বাহিনী রাস্তা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া ঠেকানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে, আমরা সংগঠিতভাবে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ পেয়েছি’। তিনি আরও বলেন, রাশিয়া শহরটি পুনর্দখল করতে একটি বড় বাহিনী জড়ো করেছে, যার মধ্যে উত্তর কোরিয়ার সেনারাও রয়েছে।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, রাশিয়া কুরস্ক পুনর্দখল করতে ৭০ হাজার সেনা জড়ো করেছে—যার মধ্যে প্রায় ১২ হাজার উত্তর কোরিয়ান সেনা রয়েছে। রাশিয়া তাদের সেরা ড্রোন ইউনিটও পাঠিয়েছে এবং কামিকাজে ও ফার্স্ট-পারসন ভিউ (এফপিভি) ড্রোন ব্যবহার করে প্রধান রসদ সরবরাহের রুটে গোলাবর্ষণের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে।
মাকসিম বলেছেন, এর ফলে শত্রু ডজন ডজন সরঞ্জাম ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে এবং ধ্বংসাবশেষ সরবরাহের রুটে জ্যাম তৈরি করেছে।
‘পরিস্থিতি বিপর্যয়কর’
১১ মার্চের পরিস্থিতিকে ‘অ্যান্টন’ বিপর্যয়কর বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি কুরস্ক ফ্রন্টের সদর দফতরে কর্মরত ছিলেন। তিনিও রাশিয়ান এফপিভি ড্রোনের ক্ষতির কথা তুলে ধরেন। তার কথায়, আগে আমরা ড্রোনে এগিয়ে ছিলাম, এখন আর নেই। নির্ভুল বিমান হামলা এবং বেশি সংখ্যক সেনা থাকায় রাশিয়া এগিয়ে রয়েছে।
অ্যান্টন বলেছেন, সরবরাহের রুট বিচ্ছিন্ন দেওয়া হয়েছে। রসদপত্র আর কাজ করছে না—অস্ত্র, গোলাবারুদ, খাদ্য ও পানির সংগঠিত সরবরাহ আর সম্ভব নয়। তিনি রাতে পায়ে হেঁটে সুজদা ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। তার কথায়, আমরা কয়েকবার মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। আকাশে সব সময় ড্রোন ঘুরছে।
এই সেনা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে ইউক্রেন কুরস্কে অবস্থান পুরোপুরি হারাবে, কিন্তু সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে, কুরস্ক নিজেকে শেষ করে ফেলেছে। এটা আর রাখার কোনও মানে নেই।
‘হরর মুভির দৃশ্য’
১১-১২ মার্চের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টে, চতুর্থ সেনা ‘দিমিত্র’ ফ্রন্ট লাইন থেকে পশ্চাদপসরণকে ‘হরর মুভির একটি দৃশ্য’ বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি লিখেছেন, রাস্তাগুলো শত শত ধ্বংসপ্রাপ্ত গাড়ি, সাঁজোয়া যান এবং এটিভি (অল টেরেইন ভেহিকল) দিয়ে ছেয়ে গেছে। অনেক আহত ও মৃত সেনা রয়েছে। তিনি বলেছেন, গাড়িগুলো প্রায়ই একাধিক ড্রোনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
তিনি তার নিজের মুক্তির গল্প বলেছেন। তিনি যে গাড়িতে ছিলেন তা কাদায় আটকে যায়। তিনি এবং তার সহযোদ্ধারা গাড়িটি মুক্ত করার চেষ্টা করছিলেন, যখন তারা আরেকটি এফপিভি ড্রোনের লক্ষ্যবস্তু হয়। এটি গাড়িটি মিস করে, কিন্তু তার একজন সহযোদ্ধাকে আহত করে। তিনি বলেছেন, তাদের দুই ঘণ্টা বনের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল, পরে উদ্ধার করা হয়।
দিমিত্র বলেছেন, অনেক ইউক্রেনীয় সেনা পায়ে হেঁটে পিছু হটেছে। ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার হেঁটেছেন অনেক সেনা। তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি কঠিন ও সংকটপূর্ণ থেকে বিপর্যয়কর হয়ে উঠেছে।
১৪ মার্চের একটি বার্তায়, দিমিত্র বলেছেন, কুরস্ক অঞ্চলে সব শেষ... অপারেশন সফল হয়নি। তিনি অনুমান করেছেন যে আগস্টে রাশিয়ায় প্রথম প্রবেশের পর থেকে হাজার হাজার ইউক্রেনীয় সেনা মারা গেছেন।
‘আমরা সিংহের মতো লড়েছি’
পঞ্চম সেনা ‘আর্তেম’ পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুটা আশাবাদী ছিলেন। ১৩ মার্চ, তিনি একটি সামরিক হাসপাতাল থেকে টেলিগ্রাম বার্তা পাঠান, যেখানে তিনি একটি ড্রোন হামলায় শার্পনেলের আঘাতের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
আর্তেম বলেছেন, তিনি পশ্চিম দিকে—লোকনিয়া গ্রামের কাছে লড়াই করছিলেন, যেখানে ইউক্রেনীয় বাহিনী কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল এবং সিংহের মতো লড়াই করেছিল। তিনি বিশ্বাস করেন যে, অপারেশনটি কিছু সাফল্য অর্জন করেছে।
তিনি বলেছেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ যে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী এই বাফার জোন তৈরি করেছে, যার কারণে রাশিয়ানরা সুমিতে প্রবেশ করতে পারছে না।
ইউক্রেনের আক্রমণের ভবিষ্যৎ কী?
ইউক্রেনের শীর্ষ জেনারেল ওলেক্সান্দ্র সিরস্কি জোর দিয়ে বলেছেন যে, ইউক্রেনীয় বাহিনী আরও অনুকূল অবস্থানে ফিরে গেছে, কুরস্কে রয়ে গেছে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত এটি প্রয়োজনীয় ও যুক্তিযুক্ত ততক্ষণ সেখানে থাকবে।
তবে এখন পরিস্থিতি গত আগস্টের চেয়ে খুব আলাদা। সামরিক বিশ্লেষকদের অনুমান, শুরুতে অর্জিত এক হাজার বর্গকিলোমিটারের দুই-তৃতীয়াংশ রাশিয়া পুনরুদ্ধার করেছে।
কুরস্ক অঞ্চলের ভূমি বিনিময়ের যে আশা ছিল ইউক্রেনের তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। গত সপ্তাহে, প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন কুরস্ক অপারেশন তার কাজ সম্পন্ন করেছে রাশিয়াকে পূর্ব দিক থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করে এবং পোক্রোভস্কের ওপর চাপ কমিয়ে দিয়ে।
কিন্তু এর মূল্য কী হয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
সূত্র: বিবিসি